মনটাকে রাখতে হবে টাটকা-তাজা
কই সঙ্গে আঁকতে ও লিখতে পারা ‘শিল্পী’র সংখ্যা সারা পৃথিবীতেই হাতে গোনা। আমাদের দেশেও ‘বিরল’ সেই সব শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম ব্যক্তিত্ব ধীরেন বল। নন্দলাল ও দক্ষবালা বলের কৃতী সন্তান ধীরেন মূলত ছিলেন অঙ্কন শিল্পী। পাশাপাশি ছোটদের ছড়া, কবিতা ও গল্প লেখাতেও তাঁর হাত ছিল বেশ পটু। আসলে মনে প্রাণে তিনি ছিলেন চিরশিশু। আর কৈশোরের ছায়াও ছিল যেন তার জীবন জুড়ে। তাইতো তিনি সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন অসাধারণ সব ‘চিত্রকথা’।

শতবর্ষের উজ্জ্বল আলোয় দীপ্ত অঙ্কন শিল্পী ও শিশুসাহিত্যিক ধীরেন বল জন্মগ্রহণ করেন বাংলাদেশের বগুড়া জেলার বারইল গ্রামে। ১৯১২ সালের ২২ জানুয়ারি।
ছোটবেলা থেকেই ছবি দেখতে ও আঁকতে খুব ভালবাসতেন। বগুড়ার গ্রামীণ বাড়িতে প্রকৃতির মধ্যেই তাঁর তুলি ও কলম যেন পাখা মেলে উড়ে বেড়াত! কখনও ঠাকুর গড়ার কাজ চলছে গ্রামে, আট-দশ বছরের ধীরেনের চোখ অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকত প্রতিমার চোখ আঁকার দৃশ্যে। অঙ্কনে মূর্তি ‘নির্মাণ’-এর এই পর্ব তাঁকে মুগ্ধ করত।

শিক্ষা জীবনের শুরু বগুড়ার করোনেশন স্কুলে। ১৯৩১ সালে রংপুরের কারমাইকেল কলেজ থেকে বিএ পাশ। পরে কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ থেকে তিন বছরের কমার্শিয়াল আর্ট-এ শিক্ষালাভ। ১৯৩৮ সাল থেকে দু’বছর তিনি ভারত সরকারের প্রচার বিভাগের শিল্পী হিসেবে সিমলায় ছিলেন। সেখানে থাকাকালীন মাটির দুর্গা ও সরস্বতী প্রতিমা গড়েছিলেন। সিমলায় সেই প্রথম মৃন্ময়ী মূর্তির পুজো হয়।

পরে ওই চাকরি ছেড়ে তিনি কলকাতায় এসে বিভিন্ন সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপন বিভাগে চিত্রশিল্পী হিসেবে কাজ শুরু করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কোকোলা, হিমানী, হিমকলন্যাস, ভিভিগ্যান, নিম সাবান ও আমলা-র বিজ্ঞাপন। এই সময় আনন্দবাজার সংস্থার বিমল ঘোষ (মৌমাছি) তাঁকে ‘আনন্দমেলা’য় নিয়ে আসেন। ১৯৪০ নাগাদ সংস্থার বর্মণ স্ট্রিটের কার্যালয়ে তাঁর প্রথম কর্মজীবন শুরু হয়। এই পত্রিকার সব বিভাগের গল্প-উপন্যাসে ছবি আঁকতেন তিনি। প্রতি সপ্তাহের আনন্দমেলাতে গল্প প্রকাশিত হত তাঁর আঁকা ছবিতে।

লেখাতেও যথেষ্ট দক্ষ ছিলেন ধীরেন বল। তাঁর সৃষ্টি ‘তুতুভূতু’ বইটি শিশু সাহিত্যে ‘অমর’ হয়ে রয়েছে। দশ বছর বয়স থেকেই তিনি ‘সন্দেশ’, ’খোকাখুকু’, ‘শিশুসাথী’র গ্রাহক ছিলেন। কলকাতা থেকে সেই সব পত্রিকা গ্রামের বাড়িতে পৌঁছাত। ওই বয়স থেকেই ‘শিশুসাথী’তে লেখা পাঠাতেন বালক ধীরেন। তবে শুধু ছবি আঁকা নয়, দশ বছর বয়সে স্কুলের খাতাকে তৈরি করেছিলেন পত্রিকা। এ রকম একটি খাতার নাম দিয়েছিলেন ‘গাঁথা’। তবে জীবনে এক বারই তিনি ‘বার্মা শেল’ কর্তৃক আয়োজিত ‘আর্ট ইন ইন্ডাস্ট্রি’তে প্রদর্শনীর জন্য মাত্র তিনটি ছবি পাঠিয়েছিলেন। সব ক’টি ছবিই পুরস্কৃত হয়। সুকুমার রায়ের কবিতা ও ছবি তাঁকে প্রেরণা জুগিয়েছিল।

আর্ট ইন ইন্ডাস্ট্রি’র সংশাপত্র কোকোলা’র বিজ্ঞাপন হিমকলন্যাস-এর বিজ্ঞাপন গাঁথা


ধীরেনবাবুর জন্ম শতবর্ষে বিদ্বজ্জনরা তো কলম ধরেছেন, এগিয়ে এসেছে বারইল গ্রামও। শিল্পী-কন্যা পৃথা বল কয়েকদিন আগে গিয়েছিলেন পিতার জন্মভূমিতে। তাঁর কাছে গ্রামীণ প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন শিল্পীকে নিয়ে তাঁদের একান্ত অনুভূতি।


মঙ্গল মণ্ডল (শিল্পীর বাংলাদেশি প্রতিবেশী): আমার বয়স তখন ষোলো কি সতেরো। সিরাজ উদ-দৌলা নাটকে ধীরেনবাবু মূল চরিত্রে এত সুন্দর অভিনয় করেছিলেন, যা আজও ভুলতে পারিনি! নিজের সাজ ছাড়া অন্য চরিত্রের সাজ-পোশাকও তিনি করাতেন। মাঠের ভেতর মাটি আর ইট দিয়ে মঞ্চ তৈরি করিয়েছিলেন। মঞ্চের পিছনে ছিল কাপড়ে তাঁরই আঁকা নানা দৃশ্য। ওই মঞ্চে নাটক হত। করোনেশন স্কুলের প্রধানশিক্ষক ধীরেন বলকে দিয়ে ছবি আঁকিয়েছিলেন। গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার পরেও বহু দিন সেগুলি স্কুলে টাঙানো ছিল। ধীরেন বল আমাদের গ্রামের গর্ব।

পৃথা বল (শিল্পী-কন্যা): কয়েকদিন আগে আমি বগুড়া গিয়েছিলাম বাবার জন্মভূমি দেখতে। এত সুন্দর গ্রাম, কেবলই মনে হচ্ছিল এই মাটি ছেড়ে চলে আসার দুঃখ বাবার মনকে কতখানি আলোড়িত করেছিল! আর সেই দুঃখের স্মৃতি জাগিয়ে রাখতে তাঁর সৃষ্টি ‘ছড়ায় ভরা গ্রাম’। জন্ম শতবর্ষে চেষ্টা চালাচ্ছি তাঁর সব কাজ একত্রিত করে প্রকাশ করতে। সম্প্রতি তাঁর কিছু আঁকা নিয়ে নন্দনে একটি প্রদর্শনীও হয়েছে। আনন্দবাজার পত্রিকা, দেশ, আনন্দমেলা, যুগান্তর, অমৃতবাজার, শুকতারা, মৌচাক, শিশুসাথী, কিশোর জ্ঞানবিজ্ঞান ও আলোর ফুলকির মতো পত্রিকাতে ছবি এঁকেছেন বাবা। তবে শুধু আঁকা নয়, বিভিন্ন বইয়ের প্রচ্ছদ অলঙ্করণও করেছেন নিপুণ হাতে।

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী (কবি ও সাহিত্যিক): একই সঙ্গে লেখা ও ছবি আঁকা, এমন ‘ক্ষমতা’ সম্পন্ন মানুষের সংখ্যা খুবই কম। কয়েকটি নাম এক বারে মনে আসে— সুকুমার রায়, শৈল চক্রবর্তী ও ধীরেন বল। ধীরেন বলের জন্ম শতবর্ষ! মনে পড়ছে রোগা পাতলা লম্বাটে গড়নের মানুষটির ছিল উজ্জ্বল চোখ। পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি, পায়ে চপ্পল। তাঁর ছড়া ও ছবি আমার যে ভাল লাগে এটা শুনে খুব খুশি হয়েছিলেন। তাঁকে প্রথম দেখি ১৯৫২তে। তখন সদ্য আনন্দবাজার পত্রিকার বার্তা বিভাগ থেকে রবিবাসরীয় বিভাগে বদলি হয়েছি। রবিবাসরীয় বিভাগের সম্পাদক ছিলেন মন্মথনাথ সান্যাল। আমি তাঁর সহকারী। আনন্দমেলার পৃষ্ঠাটি সম্পাদনা করতেন বিমল ঘোষ অর্থাৎ মৌমাছি। কাঠের পার্টিশনের মাঝখানে একটা বড়সড় ফোকর থাকায় দুই বিভাগের মধ্যে দিব্যি কথাবার্তা চলত। এক দিন সেই ফোকর দিয়ে বিমলদা বললেন, “ও নীরেন এক বার আমাদের ঘরে এসো তো। ধীরেন এসেছে, তোমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই।” সেই আলাপ। আমি তখনও ছোটদের লেখা তেমন ভাবে লিখতে শুরু করিনি। কিন্তু লিখতে যে চাই এটা শুনে বলেছিলেন, “খেয়াল রেখো, মনটা যেন বুড়িয়ে না যায়। সেটাকে সব সময় ছোটদের মতো টাটকা-তাজা রাখতে হবে।”

পার্থ ঘোষ (আবৃত্তি শিল্পী): সুকুমার রায় প্রসঙ্গে টাউনহলের এক স্মৃতিসভায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, “আমি সারা জীবন শিশুদের জন্য সেইরকমভাবে কিছু ভেবে উঠতে পারিনি। সুকুমার রায় কিন্তু সেইভাবে শিশুমনে একটা বিরাট জায়গা দখল করে নিয়েছিলেন।” আমাদের সময়ে আরও এক জন মানুষকে পেয়েছিলাম, তিনি ধীরেন বল। শিশুদের জন্য আঁকার সঙ্গে সঙ্গে এমন গল্প জমিয়ে ফেলতেন যে বড়-ছোট সকলের মনে তাঁর নানা বই আজও উজ্জ্বল হয়ে আছে। নিরহঙ্কারী, আত্মপ্রচারবিমুখ মানুষটির জন্য তাঁর জন্ম শতবর্ষে কিছু করা হলে শিশু সাহিত্য পুষ্ট হবে, এটা বিশ্বাস করি।

সৃষ্টি: ছড়া-ছবিতে গল্প, ছড়া ও ছবি আঁকার বই, ‘চেঙাবেঙা’, ‘তুতুভূতু’, ‘ঠেকে হাবুল শেখে’, ‘দেখে হাবুল শেখে’, ‘মজার দেশে মানু’, ‘দেখে এলাম ভারত’, ‘দেখে এলাম কলকাতা’, ‘এই বাংলার মেয়ে’, ‘ছড়ায় ভরা গ্রাম’, অঙ্কন শিক্ষার বই-সহ প্রায় ৫০টি বই।

পুরস্কার: ‘চেঙাবেঙা’ বইটির ছবির জন্য রাষ্ট্রীয় পুরস্কার। এ ছাড়া ভুবনেশ্বরী পদক, মৌমাছি পুরস্কার, শিশু সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার, রঞ্জিত স্মৃতি পদক। তাঁর প্রথম প্রকাশিত বই ‘তোলপাড়’ (১৯৪৭)। ‘টইটুম্বুর’-এর জন্য শিশুসাহিত্য সংসদ পুরস্কার পান।

শিল্পীর স্ত্রীর নাম প্রতিমা বল। ছয় পুত্র-কন্যা। কলকাতায় বসবাস বেলগাছিয়া অঞ্চলে। বাড়ির নাম নন্দম।


তথ্য: পাপিয়া মিত্র

 
 
 

Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player


তারাদের চোখেআমার শহরফিরে দেখাশিরোনামে শেষ তিরিশ • আনাচে-কানাচে

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.