|
|
|
|
|
|
স্মৃতির পাড়ে রোদ পোহায় |
প্রভাত দাস
(নিউ ইয়র্ক থেকে) |
চাকরি-জীবন শেষ হওয়ার পর সুযোগ পেলেই সাতসমুদ্র পেরিয়ে ছুটে আসি কল্লোলিনী গঙ্গা তীরের সদা ব্যস্ত শহরটিতে। টিকিট কেটে সস্ত্রীক প্লেনে চড়ে বসি। মেট্রো, বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়াম, সায়েন্স সিটি, উড়ালপুল, মনুমেন্ট, ভিক্টোরিয়ার কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে উড়ানে ঘুমিয়ে পড়ি!
আচমকা চোখ খুলে দেখি সবুজে ঘেরা, ধুলো-জঞ্জালমুক্ত ঝকঝকে সুন্দর এক শহরে পৌঁছেছি। যেখানে রাস্তায় কেউ বর্জ্য ফেলছে না। কিছু দূরের ব্যবধানে ‘বিন’গুলি রাখা আছে বর্জ্য ফেলার জন্য। তাদের গায়ে লেখা “দয়া করে আমায় ব্যবহার করুন”। চার দিকে পোস্টার “আপনার শহরকে পরিচ্ছন্ন রাখুন”। শহরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকায়, মেট্রো স্টেশনে, বাস স্ট্যান্ডে, মলে-বাজারে সর্বত্র জনসাধারণের ‘রেস্টরুম’ রয়েছে। সেগুলো দেখাশুনায় কর্মচারি নিয়োজিত। প্রত্যেক বড় রাস্তার নীচ দিয়ে রয়েছে ভূগর্ভস্থ নিকাশি ব্যবস্থা। নদীর ধারেই রয়েছে নিকাশি জল সংশোধিত করার প্রকল্প।
পরিশোধিত জল শহরের বিভিন্ন প্রয়োজনে ব্যবহৃত হচ্ছে। তাতে ভূগর্ভস্থ জলস্তরের উপর অহেতুক চাপ সৃষ্টি হচ্ছে না। ছোট-বড় সব বাড়ির ছাদে বৃষ্টির ধারা জলাধারে সঞ্চিত হচ্ছে। তাই বর্ষায় রাস্তা জলমুক্ত। সেই জল লাগছে দৈনন্দিন নানা কাজে। গঙ্গার দু’ধারে ফুলের বাগান ঘেরা উদ্যান গড়ে উঠেছে। দেশি-বিদেশি ভ্রমণার্থীর সমাগম সেখানে। রক্ষণাবেক্ষণের জন্য রয়েছে নিরাপত্তারক্ষী। সব কিছু তত্ত্বাবধানের জন্য প্রচুর মানুষ কর্মসংস্থানের আওতায়। পর্যটকের ভিড় রাজ্যের আয় বাড়াচ্ছে। শহরের বিভিন্ন এলাকার নির্দিষ্ট জায়গাগুলিতে হয়েছে হকার কর্নার। অফিস পাড়ায় চাকা লাগানো ট্রলিতে খাবার রান্না করে বিক্রি হচ্ছে। ফুটপাথে যেখানে সেখানে ইট পেতে পথচারীর অসুবিধা সৃষ্টি করছে না কেউ। এমন সুশৃঙ্খল, বিঘ্নহীন পরিবহণ ব্যবস্থা ও পরিবেশ অনুকূল শহরে দেশি ও বহুজাতিক ব্যবসার বিনিয়োগ বেড়েছে।
রাস্তায়, পার্কে, জলাশয়ের ধারে গৃহহীন উদ্বাস্তুদের স্বল্প ব্যয়ে পুনর্বাসন ব্যবস্থা হয়েছে। ছোটদের শিক্ষা ব্যবস্থা, প্রাপ্তবয়স্কদের কার্যকরী প্রশিক্ষণ দিয়ে নানান শিল্প-কাজে নিয়োগ করে স্বনির্ভর করে তোলা হয়েছে...
হঠাৎ মাইক্রোফোনে পাইলটের ঘোষণা। ঘুম ভেঙে গেল। বাইরে তাকিয়ে দেখি উড়ান শেষে আমরা দমদম বিমানবন্দর স্পর্শ করছি!
শহরের বাতাস শরীর ছুঁতেই মন চলে যায় শৈশবের দিনগুলিতে।
জন্ম শ্যামবাজারে। প্রায় প্রতি রবিবার কাকভোরে ট্রামে চড়ে গড়ের মাঠে যাওয়া ছিল এক উন্মাদনা। শীতের সকালে বাবা-মার হাত ধরে শিশির ভেজা সবুজ ময়দান, মাঠে দিদি দাদার সঙ্গে ছুটোছুটি করা। তখন কলকাতায় সুন্দর কুয়াশা হত, শিশির পড়ত ঘাসের ডগায়, গাছের পাতায়। এখনও নিশ্চই পড়ে!
প্রতি বছর ২৫ ডিসেম্বর নিউমার্কেট থেকে কেক কেনার ধুম, রাত্রে আলো ঝলমল পার্ক স্ট্রিট সংলগ্ন কোনও রেস্তোরাঁয় নৈশভোজ। আবার কোনও বছর ব্যান্ডেল চার্চ সংলগ্ন মাঠে সকলে মিলে চড়ুইভাতি— কী সুন্দর ছিল দিনগুলো! তার সঙ্গে মনে পড়ে শৈশবের এক ভয়ঙ্কর স্মৃতিও। ১৯৪৭ সাল। সবে দেশ ভাগ হয়েছে। হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা লেগে গেল। চর্তুদিকে আগুন, ভাঙচুর, রক্তারক্তি।
কলেজ স্ট্রিট বইপাড়ার রাস্তায় পোড়া বইয়ের স্তূপ, ভাঙা কাচ ছড়িয়ে। চতুর্দিকে কেবল ধ্বংসের চিহ্ন। তার মধ্যে দিয়ে বাবা-মায়ের হাত ধরে, আরও অন্যান্যদের সঙ্গে হেঁটে চলেছি নিরাপদ আশ্রয়ে। দু’ধারে সামরিক প্রহরা রয়েছে আমাদের নিরাপত্তার জন্য।
কৈশোরে পুজোর ছুটিতে দলবেঁধে চিড়িয়াখানায় যেতাম। খাঁচায় বাঘের চোখের দিকে তাকিয়ে জিম করবেটের রোমহর্ষক শিকার কাহিনি মনে পড়ে গায়ে কাঁটা দিত। সে সময় চিড়িয়াখানার হ্রদে নানান পরিযায়ী পাখি আসত সাইবেরিয়া থেকে। জলকেলিরত পাখিদের দেখতে দেখতে বিদেশের কত রঙিন স্বপ্ন দেখতাম। ভাবতাম, আমিও এক দিন বিদেশ যাব।
দুর্গাপুজোর কলকাতা ছিল উৎসবে মেতে ওঠা এক অপূর্ব শহর। রাত পর্যন্ত প্যান্ডেল ঘুরে প্রতিমা দর্শন, গোলদিঘির গেটের পাশে দলবেঁধে ফুচকা খাওয়া— ভাবলে এখনও জিভে জল এসে যায়। খাওয়া শেষ হত শালপাতায় একটা ‘ফাউ’ নিয়ে।
সে সব দিনে পকেটে চার-ছয় আনা পয়সা থাকলেই স্কুলের টিফিনে চিনাবাদাম, ঝালমুড়ি মজা করে বন্ধুদের সঙ্গে ভাগ করে খাওয়া যেত।
যৌবনে পা দিয়ে, রাত জেগে পাড়ায় পাড়ায় বিচিত্রানুষ্ঠানে পুজোর নতুন গান শুনতে যাওয়াতেই ছিল আনন্দ। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, মান্না দে, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, উৎপলা সেন, নির্মলা মিশ্র— নামের তালিকা অন্তহীন। আর সে সব গানের কলি— আজও নির্জনে বসে মনের মধ্যে গুনগুন করি। দীপাবলিতে যখন কলকাতা ঝলমলিয়ে উঠত, সব সম্প্রদায়ের মানুষই বাঁধা পড়ত এক মৈত্রীর বন্ধনে। বিজয়া-মহরমে, রমজান-হোলিতে পরস্পরের আলিঙ্গনে গড়ে উঠত এক মহান কৃষ্টি। এখানেই আমরা ‘ক্যালকেসিয়ান’— ভ্রাতৃত্ব ও আন্তরিকতায় ভরপুর।
কলেজ জীবনের সেরা আড্ডা ছিল কফি হাউসে। সেখানে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কেও আড্ডা দিতে দেখেছি। উন্মুখ হয়ে থাকতাম উত্তম-সুচিত্রার ছবি দেখার জন্য— প্রাচী, বিশ্বরূপা, শ্রী— কোন হলে কোন সিনেমা আসছে? লাইটহাউসে হলিউডের ‘ইউলিসিস’ দেখে, বিপদকে অতিক্রম করে জীবনে জয়লাভ করার প্রেরণা পেয়েছিলাম।
পেছনের দিকে তাকালেই মন চলে যায় যৌবনের দিনগুলিতে— চাঁদনি রাতে ময়দানে বসে সঙ্গিনীকে ভিক্টোরিয়ার চূড়ার পরীর গল্প বলা, প্রিন্সেপ ঘাটের রেলিঙে হেলান দিয়ে গঙ্গার ছলাৎ ছল শব্দ, ক্যাথেড্রালের ঘন্টাধ্বনি, দক্ষিণেশ্বরের কাঁসর-ঘন্টা, মৌলালির মসজিদের আজান... মনটা কনকন করে ওঠে।
অবসরের পর তাই প্রায় প্রতি বছরই কলকাতায় আসি।
আজও দেখি ভিক্টোরিয়ার বেঞ্চে বসা তরুণ-তরুণী হাত ধরাধরি করে ভবিষ্যতের স্বপ্নে মশগুল। ময়দানের গাছের তলায় আলোছায়ায় কপোত-কপোতি বাদাম ছাড়ানোয় বিভোর। দূর থেকে ভেসে আসে ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ। মনটা আনন্দে ভরে ওঠে। গিন্নিকে বলি, দেখ কলকাতা আছে কলকাতাতেই!
|
উত্তর কলকাতার শ্যামবাজারে জন্ম। পেশায় মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। চাকরি-জীবন শুরু এই শহরেরই এক বিদেশি সংস্থায়। আশির দশক থেকেই প্রবাসী। নিউ ইয়র্কে সরকারি চাকুরে ছিলেন। বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত। ঘুরে বেড়িয়ে সময় কাটানোটাই হবি। |
|
|
|
|
|
|