|
|
|
|
|
দেবালয় |
মর্ত্যে ‘ভূ-কৈলাস’ |
বিশাল দিঘি, তাকে ঘিরে শিব, দুর্গা ও অন্যান্য দেবদেবীর মন্দির। তাই খিদিরপুরের ঘোষাল পরিবারের আবাসস্থলকে মর্ত্যের দেবভূমি কৈলাস বা ‘ভূ-কৈলাস’ নামে অভিহিত করেছিলেন সে কালের পণ্ডিতেরা। ‘সুরধুনী’ কাব্যে ভূ-কৈলাস রাজবাড়ির বর্ণনা দিয়েছিলেন দীনবন্ধু মিত্র এই ভাবে— ‘‘ভুবনে কৈলাস-শোভা ভূ-কৈলাস ধাম,
সত্যের আলয় শুভ সত্য সব নাম’’।
খিদিরপুরের এই ঘোষাল পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা জয়নারায়ণ ঘোষালের জন্ম গড়-গোবিন্দপুর অঞ্চলে, পলাশির যুদ্ধের ঠিক পাঁচ বছর আগে, ১৭৫২য়। পিতামহ কন্দর্প ঘোষাল হাওড়ার বাকসাড়া থেকে কলকাতায় এসে গোবিন্দপুর অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন। নবাবের চাকরির পাশাপাশি তিনি নুন ও অন্যান্য ব্যবসা করতেন। পলাশির যুদ্ধের পর ইংরেজরা নতুন কেল্লা (বর্তমান ফোর্ট উইলিয়ম) তৈরি শুরু করলে কন্দর্প পরিবার নতুন জমি পেয়ে খিদিরপুরে উঠে আসে। তিন পুত্রের জ্যেষ্ঠ কৃষ্ণচন্দ্র পিতার মতোই ব্যবসায় মন দেন। মধ্যম গোকুলচন্দ্র ছিলেন সে যুগের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি। সিরাজ উদ-দৌলার কলকাতা আক্রমণে শহরের প্রভূত ক্ষতি হয়েছিল, তাই মীর-জাফর নবাব হওয়ার পর ইংরেজরা যে ক্ষতিপূরণ আদায় করেছিল তা বণ্টনের জন্য নিযুক্ত কমিশনের সদস্য ছিলেন গোকুলচন্দ্র। জ্যেষ্ঠ কৃষ্ণচন্দ্রের পুত্র জয়নারায়ণই এই রাজপরিবারের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা। ইংরেজি, আরবি, ফারসি-সহ বেশ কয়েকটি ভাষা জানার সুবাদে তিনি চাকরি পান নবাব নাজিম মোবারকদ্দৌলর দরবারে। পরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে যোগ দেন। লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস তার কাজে সন্তুষ্ট হয়ে জয়নারায়ণকে দিল্লির বাদশাহের দরবার থেকে ‘তিন হাজারি মনসবদারি’ পাইয়ে দেন। তারই স্মৃতিচিহ্ন স্বরূপ দু’খানি কামান আজও রয়েছে রাজবাড়ির প্রাঙ্গণে। চাকরির পাশাপাশি নুন, সোনা ও রত্নের ব্যবসা করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিলেন জয়নারায়ণ। তিনি আদি বাসভবনের পাশে ১০৮ বিঘা জমি কিনে পরিখা সমেত এক সুরম্য প্রাসাদ নির্মাণ করেন। সঙ্গে ‘শিবগঙ্গা’ নামে এক দিঘিও। দিঘির পূর্ব ও পশ্চিম অংশে মা ও বাবার স্মৃতিতে ১৭৮০তে প্রতিষ্ঠা করেন ‘রক্তকমলেশ্বর’ ও ‘কৃষ্ণচন্দ্রেশ্বর’ নামে দু’টি বৃহদাকার শিবলিঙ্গ। উত্তর কলকাতার নিমতলা অঞ্চলে হাটখোলা দত্তবাড়ি প্রতিষ্ঠিত ‘দুর্গেশ্বর’ ছাড়া এত বড় শিবলিঙ্গ কলকাতায় কোথাও নেই। এ ছাড়াও সেখানে রয়েছে অষ্টধাতুর হর-পার্বতী ‘পতিতপাবন’।
রক্তকমলেশ্বর শিবের আটচালা মন্দিরের গায়ের লিপিতে লেখা রয়েছে—
‘‘চৈত্রেঙ্ক পক্ষ গণিতেহনি পূর্ণিমায়াংঃ
শাকেহক্ষি শূন্য জলধীন্দুমিতে গৃ
হেহস্মিন। শ্রীযুক্ত রক্তকমলেশ্বর
নাথ লিঙ্গং বারে রবেঃ পশু
পতেঃ কৃপয়াবিরাসীত।
শকাব্দঃ ১৭০২।’’
আর পাঁচটা প্রাচীন রাজবাড়ির মতো ভূ-কৈলাস রাজপরিবারও আজ বহু-বিভক্ত। খিদিরপুর ট্রাম ডিপোর উল্টো দিকে এক অপরিচ্ছন্ন সরু গলি দিয়ে ঢুকতে হয় সাবেক রাজবাড়ি তথা আজকের ভূ-কৈলাস পাড়ায়। ঘোষাল পরিবার বর্তমানে ‘প্রথম বাড়ি’, ‘মাঝের বাড়ি’ ও ‘শেষের বাড়ি’ এই তিন তরফে ভাগ হয়ে আছে। বংশধরেরা কেউ কেউ এখানেই থাকেন, কেউ বা প্রবাসে কিংবা অন্যত্র। আবার দৌহিত্র বংশের অধিকারেও চলে গেছে কিছু অংশ। ঘোষালদের বিপুল সম্পত্তির একটা বড় অংশই ছিল জমিদারি। এই প্রথা লুপ্ত হওয়ার পর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পুরো পরিবার। শিব মন্দিরগুলির সংস্কার হয়েছে, তবে ঐতিহ্যবাহী সম্পদ রক্ষার রীতিকে লঙ্ঘন করে সেগুলির গায়ে উঠেছে নতুন পলেস্তারা। গৃহদেবতা ‘পতিতপাবন’ ও অন্যান্য দেবদেবীর সেবার জন্য ট্রাস্ট আছে বটে তবে মতপার্থক্য সেখানেও। শরিকি বিবাদের সুযোগ নিয়ে থাবা বাড়িয়েছে প্রোমোটার-রাজ। ভূ-কৈলাস পাড়ার ফাঁকা জমিতে তৈরি হয়েছে বহুতল কোথাও আইন মেনে, কোথাও না-মেনেই।
অসংখ্য দেবালয় প্রতিষ্ঠা করে মর্ত্যভূমিতে ‘কৈলাস’ নির্মাণ করেছিলেন জয়নারায়ণ। ভূ-কৈলাসের সে গরিমা আজ কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছে। পড়ে আছে শুধু অস্তমিত রাজমহিমার খণ্ড খণ্ড স্মৃতিচিত্র! |
তথ্য: গৌতম বসুমল্লিক ছবি: শেলী মিত্র |
|
|
|
|