|
|
|
|
|
মনীষালয় |
স্বামী বিবেকানন্দের বাড়ি |
১৮৬৩-র ১২ জানুয়ারি। উত্তর কলকাতার সিমলা পাড়ার ৩ গৌরমোহন মুখার্জি লেনের দত্ত বাড়িতে জন্ম নিলেন উকিল বিশ্বনাথ দত্ত ও ভুবনেশ্বরীদেবীর দশ সন্তানের ষষ্ঠ নরেন্দ্রনাথ। সে যুগের আর পাঁচটা স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানের মতোই বড় হয়েছেন নরেন্দ্রনাথ। গৌরমোহন মুখার্জি লেনের এই বাড়ি থেকেই বিদ্যাসাগরের মেট্রোপলিটন, জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইনস্টিটিউশন-এ তাঁর পড়াশোনা। এখান থেকেই দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে যাতায়াত।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে বর্ধমানের কালনা মহকুমার দরিয়াটোনা গ্রাম থেকে রামনিধি দত্ত, ছেলে রামজীবন ও পৌত্র রামসুন্দরকে নিয়ে সাবেক গোবিন্দপুর অঞ্চলে চলে আসেন জীবিকার প্রয়োজনে। ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধে জয়লাভের পরে ওই গোবিন্দপুর অঞ্চলে কেল্লা তৈরির সময়ে ইংরেজরা ওখানকার অধিবাসীদের অন্যত্র জমি দেয়। পুনর্বাসনের সেই জমি পেয়ে দত্তপরিবার উত্তর কলকাতার সিমলা অঞ্চলে উঠে আসে। রামসুন্দরের ছেলে রামমোহন দত্ত কলকাতার সুপ্রিম কোর্টের ফারসি আইনজীবী হিসেবে প্রভূত অর্থ উপার্জন করেন। তিনি প্রায় তিরিশ কাঠা জমির উপরে উঠোন, ঠাকুরদালান ও চারপাশে আরও কয়েকটি বাড়ি, বাগান-সহ তৈরি করেন এক বিশাল বাসভবন। কিন্তু কলেরায় আক্রান্ত হয়ে অকালে মৃত্যু হয় রামমোহনের। তখন সংসারের ভার পড়ে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র দুর্গাপ্রাসাদের ওপরে। কিন্তু দুর্গাপ্রসাদ সংসার না-করে অল্প বয়সেই সন্ন্যাস নিয়ে গৃহত্যাগী হন। |
|
পিতা গৃহত্যাগী হওয়ায় দুর্গাপ্রসাদের ছেলে বিশ্বনাথ, কাকার সংসারে থেকে বিএ পাশ করে এটর্নি অফিস খোলেন। পারিবারিক বিবাদের কারণে কিছু সময়ে অন্যত্র থাকা ছাড়া ওই পৈতৃক বাড়িতেই বিশ্বনাথ সপরিবারে থেকেছেন জীবনের অধিকাংশ সময়। বিশ্বনাথ দত্ত মারা যান ১৮৮৪-র ২৩ ফেব্রুয়ারি (মতান্তরে ২৪)। আর তার পরেই সমস্যার শুরু। এটর্নি হিসেবে আইন ব্যবসায় প্রচুর উপার্জন করলেও তিনি খরচও করতেন হাত খুলে। ফলে সারা জীবনে তিনি তেমন কিছু সঞ্চয় করে রেখে যেতে পারেননি। তা ছাড়া নিজে উকিল হলেও পারিবারিক বিষয়-সম্পত্তি নিয়ে স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের জন্য তেমন লিখিত-পড়িত বিলি-ব্যবস্থাও সময় কালে করে যেতে পারেননি। সুযোগ বুঝে সম্পত্তি ও বাড়ির মালিকানা নিয়ে আরম্ভ হয় মামলা-মকদ্দমা। আইনিবিরোধ এমন তিক্ত অবস্থায় পৌঁছায় যে, ভুবনেশ্বরীদেবী এক সময়ে পুত্র-কন্যাদের হাত ধরে ৭ রামতনু বোস লেনের পিতৃগৃহে উঠে যেতে বাধ্য হলেন।
স্বাভাবিক ভাবেই, পরিবারের জ্যেষ্ঠ পুত্র হওয়ার কারণে নরেন্দ্রনাথকেও নজর দিতে হয়েছিল মামলার তদারকিতে। সে দায়িত্ব তাঁকে পালন করতে হয়েছিল আমৃত্যু। বিবেকানন্দের মৃত্যু হয় ৪ জুলাই ১৯০২। তার কয়েক দিন আগে, ২৮ জুন, ওই বাড়ির অন্য শরিকদের টাকাপয়সা দিয়ে মামলার অবসান করেন তিনি। তার পরে, গৌরমোহন মুখার্জি লেনের বাড়ির কিছু অংশ দখলে আসে বিবেকানন্দের মা ভুবনেশ্বরীদেবী ও দুই ভাই মহেন্দ্রনাথ ও ভূপেন্দ্রনাথের। কিন্তু বিবেকানন্দের অন্য দুই ভাইও বিয়ে না-করায় সেই অংশও পরে চলে যায় তাঁদের বোনেদের পরিবারে। তবে, বাড়ির এক তলাতে মহেন্দ্রনাথ দত্তের গুণমুগ্ধরা তাঁর লেখা বিভিন্ন গ্রন্থের প্রকাশনা ও প্রচারের জন্য ‘মহেন্দ্র পাবলিশিং কমিটি’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। রামকৃষ্ণ মিশনের অধিকারে আসার আগে অবধি প্রকাশনা কমিটির কার্যালয় ছিল ওই বাড়িতেই। বর্তমানে সেটি সাহিত্য পরিষদ স্ট্রিটে স্থানান্তরিত হয়েছে। বাড়ির অন্যান্য অংশগুলি থেকে যায় পরিবারের বিভিন্ন সদস্যদের দখলে।
|
|
১৪৮তম জন্মবার্ষিকী অনুষ্ঠানে সেজে উঠেছে স্বামীজির জন্মভিটে। |
স্বাধীনতার পর থেকেই সরকারি ও বেসরকারি স্তরে মনীষীদের বাড়িগুলির সংস্কার সংক্রান্ত চিন্তা-ভাবনা আরম্ভ হয়েছিল। কিন্তু আইনি জটিলতার কারণে ৩ গৌরমোহন মুখার্জি লেনের স্বামী বিবেকানন্দ-মহেন্দ্রনাথ দত্ত-ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত-র ওই বাড়ি নিয়ে কিছুই প্রায় করা যায়নি দীর্ঘ কাল। নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে রামকৃষ্ণ মিশন, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের সহযোগিতায় উদ্যোগী হয় বাড়িটির অধিগ্রহণ ও সংস্কারে। মূল বাড়িটি ছিল ৩০ কাঠা জায়গার উপরে। এই পর্বে তার সঙ্গে আরও ৩৪ কাঠা অর্থাৎ মোট ৬৪ কাঠা জমি অধিগ্রহণ করে আরম্ভ হয় সংস্কারের কাজ।
শুধু বিবেকানন্দের জন্মভিটের সংস্কার নয়, পুরো চত্বরটিকে একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলাই ছিল রামকৃষ্ণ মিশনের উদ্দেশ্য। প্রকল্পের কাজ শেষ হলে, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০০৪, নবরূপে তৈরি হওয়া ‘স্বামী বিবেকানন্দের পৈতৃক ভিটা’-র উদ্বোধন করেন রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের তৎকালীন অধ্যক্ষ স্বামী রঙ্গনাথানন্দ। তার কয়েক দিন পরে, ১ অক্টোবর, ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালাম এক বিশেষ অনুষ্ঠানে বাড়িটি জনসাধারণের দর্শনের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। বর্তমানে ওই বাড়ি ও তাকে ঘিরে তৈরি হওয়া সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে রয়েছে—
১. ধ্যানকক্ষ, যেখানে নিয়মিত ধ্যান ও ধর্মীয় শিক্ষার পাঠ দেওয়া হয়।
২. প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজারেরও বেশি বই-সহ একটি পাঠ্যপুস্তক গ্রন্থাগার।
৩. ‘স্পোকেন ইংলিশ’ শিক্ষাদান কেন্দ্র।
৪. কম্পিউটার শিক্ষাদান কেন্দ্র।
৫. একটি প্রথা-বর্হিভূত শিক্ষাকেন্দ্র। সেখানে আঞ্চলিক বসতিবাসী শিশুদের খাদ্য-সহ পাঠদান করা হয়।
৬. আর্থিক-অনগ্রসর পরিবারের ছাত্রছাত্রীদের জন্য দু’টি বিনা খরচের কোচিং সেন্টার।
৭. স্বামী বিবেকানন্দের জীবন ও শিক্ষার উপর তৈরি একটি প্রদর্শশালা।
৮. একটি গবেষণাকেন্দ্র।
৯. আর্থিক-অনগ্রসর মানুষদের জন্য দাতব্য চিকিৎসালয়।
এ ছাড়াও এখানে নিয়মিত পাঠচক্র ও আলোচনাসভার আয়োজন করা হয়। পাশাপাশি রয়েছে দরিদ্র ও আর্ত মানুষদের জন্য নিয়মিত বিভিন্ন সেবা প্রকল্পের আয়োজন।
|
তথ্য: গৌতম বসুমল্লিক
নিজস্ব চিত্র |
|
|
|
|