|
|
|
|
|
|
রেখাই যেন লেখার সহোদর |
শতবর্ষ পেরিয়ে আজও বাঙালি-মনে চিত্রশিল্পী হিসেবে তাঁর অমর
সৃষ্টি
জীবন্ত। শিবরামের গল্পের সঙ্গে তাঁর সাহিত্যচিত্রণ তো অভাবনীয়।
শুধু
তাই
নয়, রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় তাঁরই গল্পের ইলাস্ট্রেশন
করে যিনি
ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছিলেন এ বারের অতীতের তাঁরায়
অবিস্মরণীয় সেই শিল্পী এবং আধুনিক পাপেটের জনক শৈল চক্রবর্তী। |
|
|
৬ ফেব্রুয়ারি ১৯০৯— চিত্রশিল্পী, কার্টুনিস্ট, ইলাস্ট্রেটর এবং গ্রন্থকার শৈল চক্রবর্তী জন্মগ্রহণ করেন হাওড়ার আন্দুল-মৌড়িগ্রামে। ‘শ্রীশৈল’ নামেই পরিচিত, তবে পুরো নাম শৈলনারায়ণ চক্রবর্তী। পিতা আন্দুল হাইস্কুলের শিক্ষক উদয়নারায়ণ চক্রবর্তী ও মা রানি চক্রবর্তী।
শ্রীশৈল আন্দুল হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক ও হাওড়া নরসিংহ দত্ত কলেজ থেকে অঙ্কে অনার্স নিয়ে বিএসসি পাশ করেন। কলেজে পড়ার সময় থেকেই কলকাতার পত্রপত্রিকা এবং লেখক-শিল্পীদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ। বন্ধু হিসেবে পাশে পেয়েছিলেন পরিমল গোস্বামী, সমর দে ও প্রমথ সমাদ্দারকে।
গত শতাব্দীর চারের দশকে আনন্দবাজার পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যায় প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের ‘ল্যাবরেটরি’ ও ‘প্রগতিসংহার’ ছোটগল্পের ইলাস্ট্রেশন করেন শৈল চক্রবর্তী। রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় এমন শিল্প-কৃতিত্ব বিরলতম। বাংলায় প্রকাশিত সত্যজিৎ রায়ের প্রথম গল্প ‘বর্ণান্ধ’-র ইলাস্ট্রেশন করেছিলেন শৈল চক্রবর্তী (অমৃতবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল ২২ মার্চ, ১৯৪২)।
সৃষ্টিশীল জগতে অনবদ্য জুটি ছিলেন শিবরাম চক্রবর্তী ও শ্রীশৈল। শৈলবাবুর ছবি আর শিবরাম চক্রবর্তীর গল্প, অসামান্য যুগলবন্দি।
বহু বছর ব্যঙ্গচিত্র আঁকার পরে কাহিনি সচিত্রকরণের কাজ শুরু করেন শ্রীশৈল। পুস্তক অলঙ্করণেও পারদর্শী ছিলেন তিনি। শেষ বয়সে পেন্টিংয়ের দিকেও ঝুঁকেছিলেন— মাধ্যম, জল ও তেল রং। প্রকৃতি ছিল তাঁর প্রিয় বিষয়। ভারত, ব্রাজিলের রিয়ো-ডি-জেনেরো এবং আমেরিকার নিউ জার্সিতে তাঁর শিল্পকর্মের একক প্রদর্শনীও হয়।
বেঙ্গল গভর্নমেন্টের ডাইরেকটোরেট অব পাবলিক ইনফরমেশন বিভাগে কিছু দিন কাজ করেছিলেন শৈল চক্রবর্তী। সচিত্র ভারত, অমৃতবাজার ছাড়া দৈনিক বসুমতীর রবিবারের পাতায় শিবরাম চক্রবর্তীর নিয়মিত লেখা ‘বাঁকা চোখে’র সঙ্গে শৈলবাবুর কার্টুন ছিল বড় আকর্ষণ। যুক্ত ছিলেন যুগান্তর পত্রিকার নানা বিভাগের সঙ্গেও।
শৈবাল চক্রবর্তী (পুত্র): বাবা প্রায় ৩৫ বছর অমৃতবাজার পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অমৃতবাজার পত্রিকায় সত্যজিৎ রায়ের দু’টি গল্পের ছবি তিনি এঁকেছিলেন— Abstractions ও Shades of grey। প্রায় পুরো জীবনটাই ফ্রিলান্সিং করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। সে এক কঠিন সময়। সেখান থেকে বেরিয়ে আসার জন্য তিনি প্রায়ই আমাদের সবাইকে নিয়ে বেড়াতে যেতেন। আর ফিরে আসতেন অসীম মানসিক উৎসাহ নিয়ে। আবার নতুন উদ্যোমে শুরু হত কাজ। বাবার জীবনটাই ছিল সংগ্রামের। ১৮-১৯ বছর বয়সে হাওড়া থেকে প্রথমে কলেজস্ট্রিট মার্কেটের কাছে একটি মেসে এসে উঠেছিলেন। পরে শ্যামবাজার শ্যামপার্কের কাছে একটি বাড়িতে সংসার-জীবন শুরু। সেখানে ছিলেন বছর আটেক। ১৯৪৫ সালে কালীঘাটের সদানন্দ রোডের বাড়িতে আমাদের বেড়ে ওঠা। পরে ১৯৫৬-৫৭ সাল নাগাদ বাবা ঢাকুরিয়াতে বাড়ি করেন। আমি আজও সেখানেই থাকি। বাবার সব সময়ের সঙ্গ পাওয়ার অনুভূতি আজও খুব মনে পড়ে। |
|
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ভাবনায় বাবা এঁকেছিলেন কলকাতা পুরসভার লোগো। বাড়িতে শিবরাম চক্রবর্তী আসতেন সব থেকে বেশি। গল্প লেখা হলেই পাণ্ডুলিপি নিয়ে চলে আসতেন বাবার কাছে। রেখা এবং লেখা বরাবরই ছিল গায়ে গায়ে। রেখাই বাঁক নিত অক্ষর বা বর্ণচিত্রে। বাবাকে পড়িয়ে, তার পর আঁকিয়ে সম্পাদকের কাছে তা পৌঁছে দিয়ে আসতেন শিবরামবাবু। বাড়িতে আসতেন সিনিয়র পি সি সরকার, মনোজ বসু, সুনির্মল বসু, দীনেশ দাস, প্রেমেন্দ্র মিত্র, আশাপূর্ণাদেবী, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, বিমলচন্দ্র ঘোষ, বিজন ভট্টাচার্য, দীপ্তেন্দ্রকুমার সান্যাল, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত প্রমুখ। নানা গল্পে জমে উঠত আসর।
চণ্ডী লাহিড়ী (কার্টুনিস্ট): আমার সঙ্গে শৈলদা’র সম্পর্ক অত্যন্ত মধুর ছিল। কিন্তু সে শুধু পেশার কারণে নয়। আমি আনন্দবাজারে আর শৈলবাবু অমৃতবাজারে ছিলেন। কাজের বাইরে আমরা নানা আলোচনা করতাম। ওঁর একটা বড় গুণ ছিল নতুন কিছু সৃষ্টি করলেই আগে ডাকতেন, বোঝাতেন। যেমন আমাদের দেশের পুতুল নাচের প্রবর্তন শুরু করেছিলেন রঘুনাথ গোস্বামী ও শৈল চক্রবর্তী। এই পুতুল নাচের কলাকৌশল ছিল একেবারে আলাদা। বাজনার সঙ্গে ‘sync’ করে পুতুল নাচের প্রবর্তন শৈলদাই শুরু করেন প্রথম। আমি নিজে যে হেতু পুতুল নাচ নিয়ে উৎসাহী ছিলাম তাই কাজের সুবিধার্থে তিনি আমেরিকা থেকে একটি বলবেয়ারিং সিস্টেম (মডেল) এনে দিয়েছিলেন আমাকে। অনেক কিছু শিখতে পেরেছি। জীবনের সামান্যতম সময়টুকুও অপচয় করতে দেখিনি ওই সৃষ্টিশীল মানুষটিকে। এক জন গতিশীল মানুষ বলতে আমার জীবনে আমি শৈলদা ছাড়া আর কাউকে পাইনি।
প্রণবেশ মাইতি (ইলাস্ট্রেটর, প্রচ্ছদ বিষয়ক গবেষক): স্কুলবেলায় যে ক’জনের আঁকা ছবি সেই জীবনকে আলোড়িত করত তার মধ্যে শৈল চক্রবর্তী অন্যতম। সমসাময়িক কিছু শিল্পীর স্মৃতি মানুষের মনে মলিন হয়ে এলেও শৈল চক্রবর্তীর নাম যেন ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠেছিল। ভেবে দেখলাম এই নিবিড়তার অন্যতম কারণ শিবরাম চক্রবর্তীর সাহিত্য। সেই সময় আমার স্থির ধারণা ছিল ওঁরা অভিন্ন কিংবা দুই সহোদর। ভুল ভাঙে অনেক পরে। রক্তের সম্পর্ক না-থাকলেও অভিন্ন ওঁরা আত্মায়-মননে। ছিলেন একে অন্যের পরিপূরকও।
এই জুটির পথচলা শুরু কবে থেকে তা গবেষণার বিষয়। তবে এ কথা নিশ্চয়ই বলা যায় শিবরাম-শৈল মানেই মজা। লেখা ও রেখার এই যুগলবন্দি যদি বলি ‘রাজযোটক’ তা হলে ভুল বলা হবে না। হর্ষবর্ধন-গোর্বধন-বিনিদের নাজেহাল অবস্থার কর্মকাণ্ড, তাদের ছটপটানি, মাঝে মাঝে যেন দুরন্তগতিতে বেরিয়ে আসতে চায় বইয়ের পাতা থেকে। উদাহরণ দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। যে কোনও সাহিত্যচিত্রণ দেখলে এর সত্যতা স্বীকার করতে হয়। এই প্রকাশের সঙ্গী শুধুমাত্র কিছু রেখা। কোনও টেকনিক বা গিমিকের আশ্রয় নিতে হয়নি। স্বশিক্ষিত এই শিল্পীর মানব-শরীর সংস্থান সম্পর্কে ছিল নিবিড় নির্ভুল জ্ঞান। তাই তিনি অনায়াসে যেতে পারতেন আপাদমস্তক যে কোনও ভঙ্গিমার চিত্রায়নে। তবে শুধু মানব-শরীর নয়, পশুপাখি এমনকী ঘরদোর কোনও কিছুই বাদ যেত না। অন্য দিকে রবীন্দ্রনাথের ‘ল্যাবরেটরি’, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হাঁসুলিবাঁকের উপকথা’, প্রবোধকুমার সান্যালের ‘বনহংসী’-র অলঙ্করণ দেখে ভাবাই যায় না এর স্রষ্টাও একই শিল্পী। এখানে তিনি ধীরস্থির। অমৃতবাজার পত্রিকায় নিয়মিত একটি কার্টুন আঁকতেন— সই করতেন ‘Alias’। এই ছদ্মনামের আড়ালে স্বয়ং শিল্পীর অধিষ্ঠান। ‘অ্যালাইস’ উল্টে নিলেই শৈল।
চিরঞ্জিৎ চক্রবর্তী (পুত্র): বাবাকে নিয়ে বলতে গেলে হরেক মজার কথা মনে পড়ে। যেমন পুজোর পরে বিজয়া দশমীর খাবার জিবেগজা তৈরি হবে, বানাবেন বাবা, কিন্তু সঙ্গে সব ভাইবোনেরা। লেচি কেটে বেলাটাও একটা আর্ট ছিল বাবার কাছে। তার পরে সেখানে ছুরি দিয়ে পশুপাখি তৈরি করতে হত। সেগুলি যখন তেলে ভেজে রসে ডুবে উঠত তখন যে কী সুন্দর দেখতে হত! আমাদের সঙ্গে সময় কাটাতেন বাবাই বেশি। বাড়িতে বাবার বন্ধুরা আসতেন এবং নানা আলোচনার মাধ্যমে দীর্ঘ সময় কাটাতেন। এরই মাঝে থাকত ‘পাপেট শো’। বাবা ছিলেন আধুনিক পাপেটের ‘জনক’। নিজে গড়তেন পুতুল। সুতোয় টানা ও পুতুলের মধ্যে আঙুল ঢুকিয়ে দু’রকম ভাবে খেলা দেখাতেন। আমাদের বাড়িতে ‘পুতুলরঙ্গম’ নামে একটি সংস্থা গড়ে উঠেছিল। আত্মীয়স্বজন ও নানা মানুষের আসা যাওয়া থাকতই। এই সমাগমে বাবাকে ‘পাপেট শো’ দেখাতেই হত। তিনিই আমাদের রঙের মধ্যে আঙুল ডুবিয়ে আঁকতে শিখিয়েছেন। ওঁর আঁকার মধ্যে ইউরোপীয়, চৈনিক, জাপানি স্টাইলের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল যামিনী রায়ও। স্বকীয়তা বজায় রেখেছেন বরাবর। গাড়ির চেহারায় এনেছেন নারীর শরীরের নমনীয়তা। বহুতল বাড়ির চিত্র এঁকেছেন, যেন ভূমিকম্পে দুলছে। আসলে তাঁর বিশেষ পছন্দ ছিল শিল্পের মধ্যে বিজ্ঞানের সংযুক্তি। |
সৃষ্টি: ‘বেজায় হাসি’, ‘চিন্তাশীল বাঘ’, ‘ঘটোৎকচ বিজয়’, ‘স্বর্গের সন্ধানে মানুষ’, ‘কার্টুন’, ‘কৌতুক’, ‘যাদের বিয়ে হল’, ‘যাদের বিয়ে হবে’, ‘আজব বিজ্ঞান’, ‘চিত্রে বুদ্ধজীবন কথা’, ‘বেলুন রাজার দেশে’, ‘কৃপণের পরিণাম’, ‘টুলটুলির দেশে’, ‘কালো পাখি’-সহ প্রায় ২৫টি রচিত গ্রন্থ।
প্রথম প্রকাশিত গল্প ‘বেজায় হাসি’।
সুনির্মল বসুর লেখা নিউ থিয়েটার প্রডাকশনের ‘মিচকে পটাশ’
অ্যানিমেশন তাঁরই সৃষ্টি।
পুরস্কার: ‘মানুষ এল কোথা থেকে’, ‘গাড়িঘোড়ার গল্প’, ‘কালো পাখি’ ও ‘ছোটদের ক্রাফ্ট’-এর জন্য রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেয়েছেন চার বার। |
|
তথ্য: পাপিয়া মিত্র |
|
|
|
|