হংস পাখায় পাখনা মেলে

(লন্ডনের ক্রয়ডন থেকে)
রস্বতীপুজো বলতে সবাই যা বোঝে আমিও তাই-ই বুঝি!
— আগের দিন রাত থেকে কাগজের শিকল বানানো, ভোর ভোর উঠে স্নান করে শাড়ি পরে অঞ্জলি দেওয়া, স্কুলে গিয়ে খিচুড়ি ভোগ খাওয়া, সবথেকে বড় পাওনার মধ্যে বছরে একটা দিন পড়তে না-বসার আনন্দ
— পাশের বয়েজ স্কুল থেকে ঠাকুর দেখতে আসার ধুম, সবে গোঁফের রেখা বেরনো ছেলেদের দু-এক ঝলক মুগ্ধ দৃষ্টি
— ঘটি বাড়ির গোটাসেদ্ধ, বাঙাল বাড়ির জোড়া ইলিশ
— আসন্ন মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য সরস্বতীর পায়ে কলম ছুঁইয়ে নেওয়া

শীতের সকাল, নরম রোদ, ছুটি, কুল, গাঁদা ফুলের তরতাজা সুগন্ধ, বই পুজো।

সব কি মেঘের আড়ালে চলে যেতে পারে? যতই ‘কোলাভেরি ডি’ আসুক বা ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’— সরস্বতী পুজোর সন্ধের বিচিত্রানুষ্ঠানে হলুদ শাড়ি আর দুই বিনুনীর জয় অব্যাহত। স্কুলে স্কুলে নিমন্ত্রণ করতে যাওয়ার চল ছিল আমাদের। কে জানে এখনও সে রকম কোনও ব্যাপার আছে কিনা! মোবাইল ফোন আর ফেসবুকের দৌলতে এই মিষ্টি রোম্যান্টিক ব্যাপারগুলো খুব মোটা দাগের যেন না হয়ে যায় হে মা সরস্বতী!

সক্কাল সক্কাল বাড়ির পুজোতে অঞ্জলি দিয়েই ইস্কুলে যাওয়া হত। এক বার মনে আছে, একটি সাহসী বান্ধবী সিনেমা গিয়েছিল তার এক ছেলে বন্ধুর সঙ্গে। সেই নিয়ে তোলপাড় হয়ে গিয়েছিল বন্ধুমহল। এখনকার ছেলেপুলেরা নিশ্চয়ই আমাদের বালখিল্যতায় হাসবে! স্কুলে যাওয়ার পথে সাইকেল করে যাওয়া বয়েজ স্কুলের ছেলে একটু তাকিয়ে হাসি ছুঁড়ে দিয়ে গেলে, সেই হাসি মেখে সারাদিন বসে থাকত মেয়েগুলো। সে নিয়ে কত ফিসফিস কথা ইস্কুলের মেয়েদের মধ্যে, খিচুড়ি খাওয়ার লাইনে দাঁড়িয়ে। সে বার, দিদির বন্ধু দেবযানীদি ওদের বাড়ির আশেপাশে কোথায় যেন স্বপনদাকে দেখা করতে বলেছে। আমরা কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। ওকে পাহারা দেওয়ার জন্য। মশা কামড়ে লাল করে দিল ফর্সা পা-গুলো। সে দিনটা আমার মনের ফ্রেমে বাঁধানো রয়ে গেছে। স্বপনদা আর দেবযানীদির আর হয়তো মনে নেই— আজ তো ওদের ছেলেই কত্তো বড় হয়েছে! সে হয়তো পার্ক স্ট্রিটের কোনও নামজাদা কফিশপে ‘ডেট’ করতে যাবে তার ‘জিএফ’-কে নিয়ে— সরস্বতী পুজোর দিনে নয়, ‘বেঙ্গলি ভ্যালেন্টাইন ডে’র দিনে। আজকাল এই সব ‘কোড ওয়ার্ড’ দিয়েই হয়তো প্রেম হয়! কে জানে! ওএমজি, ডাবলিউটিএফ— গালাগালিরাও বেশ শুদ্ধ হয়ে যায় এমনি কোডে কথা বললে!

আগের প্রজন্মের মতো নাক কুঁচকে বলতে পারতাম অনেক কিছু, কিন্তু তাই বা বলি কেমন করে! ওরা একুশ শতকের গ্লোবাল ভিলেজের ছেলেপুলে। আমাদের মতো আশির দশকে স্কুলে গেছে নাকি, যখন কালার টিভি ছিল বাড়তি পাওনা? একটু বড় হয়ে কলেজদশা শুরু হওয়ার পরে সরস্বতীপুজোর অন্য মানে হল। আশির শেষ, নব্বই দশকের শুরুর যাদবপুর! ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টিতে সরস্বতীপুজোর তেমন চল ছিল না কিন্তু এক একটা ডিপার্টমেন্টে পুজো হত। সে এক অন্য রকম গপ্পো। তাতে স্বাধীনতার স্বাদ ছিল অনেক কিন্তু সেই মিষ্টত্ব ছিল না! তার চার্ম চলে গিয়েছিল। সারবুঝ বুঝেছিলাম— সরস্বতীপুজো ছেলেবেলার বস্তু! এক বার হারিয়ে গেলে আর আসে না!

কিন্তু এ বারের সরস্বতীপুজোটা বড্ড অন্য রকম!

আমার শহর— কলকাতা, আবার ক্রয়ডন-ও আমার শহর ! ইংরেজিতে ‘সেকেন্ড হোম’ বলতে হলে এখন বড় বিভ্রান্ত হয়ে যাই, কাকে প্রথমে রাখি? কলকাতা আমার প্রাণ। তবু এখানে, ক্রয়ডনে, আমার দেহ-মন-সত্তা প্রতি নিয়ত মিশছে আকাশ-বাতাস-জল-মেঘ-মানুষের সঙ্গে। আমরা প্রবাসীরা বুকের মাঝে আজীবন একটা গঙ্গা বয়ে বেড়াই, একটা শিকড় আগলে রাখি। আমরা চেষ্টা করি যাতে আমাদের স্বপ্ন ছড়ায় শিশুদের মধ্যে— আমাদের ভাষা, সংষ্কৃতি, গৌরব বোধ যাতে পরবর্তী প্রজন্মকে ছুঁয়ে যায়, যাতে তারা বিশ্বনাগরিক হয়েও বাঙালি সত্তাকে জীবনভর সঙ্গে নিয়ে চলতে পারে। ঘর ছেড়ে তেপান্তরের মাঠ, সাত সাগর তেরো নদী পাড়ি দিয়ে যখন ক্রয়ডনে এসেছিলাম, হাসনরাজার একটি গান মনে এসেছিল—
কী ঘর বানাইমু আমি শূন্যের মাঝার,
লোকে বলে, বলেরে ঘরবাড়ি ভালা নাই আমার!
সেই শূন্য ঘর আজ এত দিন পরে পূর্ণতায় ভরে উঠেছে। আমাদের ঘর গড়ে উঠেছে ঘরের বাইরে, বহু দূরে! এখন আর আমরা একা নই, আমরা সবাই আছি সবার জন্য— ‘সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’। ‘ক্রয়ডন বেঙ্গলি কানেকশান’-এর আজ যাত্রা শুরু হল বীণাপাণিকে প্রণাম করে। সাউথ লন্ডনে বসবাসকারী ভারতীয় বাঙালিদের জন্যে তৈরি এক প্রতিশ্রুতি নিয়ে। চালু হল www.cbc-london.org ওয়েবসাইট। এতে খাগের কলমে জলের দাগে লেখা হল নতুন ভাবনার কথা। আজকেই। আজ যে সরস্বতীপুজো। ভাগাভাগি করে খিচুড়ি, বাঁধাকপি, আলুর দম, লুচি, চাটনি রান্নার মজাই আলাদা। পুজোর আগের দিন রাত এগারোটা অবধি নাড়ু বানানো, সরস্বতী সাজানো, পুরোহিতের জন্যে মন্ত্র ডাউনলোড করা, গানের নাচের রিহার্সাল... সে এক অন্য মজা। অন্য গল্প। অঞ্জলির পরে সেই হলুদ শাড়ির মেলায় শুরু হল আমাদের ঘরোয়া ফাংশান। বয়স দুই থেকে চার— আদৃতা, অস্মিত, জিয়া, প্রাঞ্জল, রিতিকা, শুভম এবং তেজষ্কা নাচল ‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে’। স্যাক্সোফোনে কবিগুরুর সুর শোনাল বারো বছরের সোহম ও অন্বেষা। আর লোকনৃত্যে সাত বছরের সুদিপ্তা এবং তানিশা।

মাঝ বয়সে সরস্বতীপুজো কি আর ভ্যালেন্টাইন পুজো হয়? কে জানে! কিন্তু এত দিনের বিয়ে করা পুরনো বরটাকেই আবার এক ঝলকে হঠাৎ যেন নতুন মনে হল— হলুদ সিল্কের শাড়ি আর কপালে আঁকা সিঁদুরের টিপ পরে আয়নায় মুখ তুলে দেখি কাঁধের কাছে মুগ্ধ চোখ! হোক না সম্বচ্ছরে এক বার! তবু মনে পড়ে গেল আশির দশকের শেষের দিকের একটা আলতুসী বিকেল আর হলুদ শাড়ি পরা এক কিশোরীকে। এটাই অনেক পাওয়া। কলকাতা ফিরে এল বসন্ত পঞ্চমীর আধভাঙা চাঁদের জ্যামিতিতে।



 
 
 

Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player


প্রথম পাতাঅতীতের তাঁরাতারাদের চোখেফিরে দেখাশিরোনামে শেষ তিরিশ • আনাচে-কানাচে • ক্যামেরা-বন্দি

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.