‘স্বীকৃতি দিতে জানে এ শহর’

গায়িকা

ভোররাত থেকেই কলকাতার সেই রাস্তা ধোওয়ার আওয়াজ এখনও কানে বাজে আমার। তার পরেই দূরের একটা চায়ের দোকান থেকে ভেসে আসা আকাশবাণীর দিনের অনুষ্ঠান শুরুর সেই প্রারম্ভিক সঙ্গীতের সুর। আর সে সময় থেকে আমাদের শোভাবাজারের বাড়িতেও শুরু হয়ে যেত সকালের প্রস্তুতি। বাড়ির নাম ‘সুরমন্দির’, সেখানে সকালের ব্যস্ততা যে হারমোনিয়াম আর তানপুরাকে ঘিরে, তা বলাই বাহুল্য! বাবা হরিহর শুক্ল সে যুগের শাস্ত্রীয় সঙ্গীত জগতে ছিলেন অতি পরিচিত ব্যক্তিত্ব। ফলে সেই বাড়ির মেয়ে যখন হাঁটতে শিখেছে কি শেখেনি, বাবার সঙ্গে নিয়ম করে গলা মেলাতে হত। তাও যে-সে গানের রেওয়াজ নয়, খেয়াল-ঠুমরি-ভজন!

সত্যি কথা বলতে কী, আমার প্রিয় কলকাতার সকালবেলাটাই এক অন্য অনুভূতি তৈরি করত মনে। বাড়িময় ছড়িয়ে পড়ত সোনালি রোদ। পাশাপাশি আমার আর বাবার গলাও চড়তে থাকত ধীরে ধীরে। জীবনের শুরুতেই মনে হয়েছিল, এমন সুন্দর শহরে একদিন আমার গানও সবাই শুনবে। এ শহরে ভাল গানেরও তো অনেক কদর! আমাদের শোভাবাজারের বাড়িতে প্রায়ই অনেক গুণী জনেরা আসতেন। আমার উৎসাহ আরও বেড়ে যেত তাঁদের সান্নিধ্যে এসে। গান ছিল যেমন জীবন জুড়ে, তেমনই শহরটাও ছিল আমার মন জুড়ে!

ছোটবেলা থেকেই যে কোনও ছুটির দিনে আমরা সবাই কোথাও না কোথাও বেড়াতে যেতাম। আমার সবচেয়ে বেশি ভাল লাগত চিড়িয়াখানা। এখনও ভাল লাগে। কিন্তু যেতে পারি না, এত পরিচিতির মধ্যে কিছুটা অসুবিধা হয়। ছোটবেলার মতো দক্ষিণেশ্বর মন্দির, কালীঘাট বা ধর্মতলার গির্জার পরিবেশ আজও আমাকে টানে। কত মানুষ আসেন। কী শান্তি! মনে হয়, ছোটবেলায় ঠিক যেমন দেখেছিলাম আজ এত দিন পরেও তার কিছুই বদলায়নি। তবে দুঃখ একটাই— ট্রাম চড়ার সেই মজাটা এখন আর নেই। আগে উত্তর কলকাতা থেকে ট্রামে চেপে সোজা পৌঁছে যেতাম বালিগঞ্জ। আবার ফিরতামও একই ভাবে। ওই আড়াই ঘন্টার আনন্দ-সফর আজও ভুলতে পারি না। বাবা যে দিন একটু ফাঁকা থাকতেন সে সব দিনেই আমরা ট্রামে চেপে বসতাম। ট্রামের জানলা থেকেই দেখতাম গোটা কলকাতায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কী সুন্দর সব হোর্ডিং। সেগুলো পড়তে আমার খুব মজা লাগত! এখন ট্রামের তো সেই গুরুত্ব নেই। তবুও পথে ট্রাম দেখলে মনে জেগে ওঠে কত স্মৃতি, পুরনো না হতে চাওয়া কত কথা!

কলকাতা ছুটছে। আর তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঘড়ি ধরে ছুটছে সহ-নাগরিকরাও। মেট্রো রেল কলকাতার গতি আরও যেন বাড়িয়ে দিয়েছে। সব সময় আমার মেট্রো চড়া হয় না। কিন্তু যে কয়েক বার চড়েছি, তার অনুভূতি বেশ রোমাঞ্চকর!

বাবার কোলে চড়ে যাতায়াতের পথে বহু বার আকাশবাণী দেখেছি। তখন তো ঘরে ঘরে এই রেডিও স্টেশন খুবই জনপ্রিয়। প্রথম আকাশবাণীতে পা রেখেছিলাম মাত্র পাঁচ বছর বয়সে। শিশুমহলে ইন্দিরাদেবী আমার গান শুনে প্রায় কোলে তুলে নিয়েছিলেন। সেই শুরু। কলকাতার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ল আমার গান ও প্রশংসা।

গরম কালের বিকেলে গঙ্গা পাড়ের সৌন্দর্য যে কী অপূর্ব তা বলে বোঝাতে না-যাওয়াই ভাল! আর এখানেই পেয়েছিলাম আমার জীবনের অনেক ভাল লাগা ক্ষণের একটি অপার্থিব মুহূর্ত। বাড়ির সবাই মিলে আমরা সে দিন হইহই করে পড়ন্ত বিকেলে সূর্যাস্ত দেখতে ব্যস্ত, আর তার মাঝেই পুরনো বটগাছের গোড়ায় একটি চায়ের দোকানে চলতে থাকা রেডিওয় হঠাত্ বেজে উঠেছিল আমার গান! উফ্! শরীর-মন সব একসঙ্গে নেচে উঠেছিল! সে যে কী আনন্দ! আজ এই বয়সেও সেই অনুভূতি তাড়া করে বেড়ায় আমায়।

তখন কলকাতায় বিভিন্ন সংস্থা সঙ্গীত প্রতিযোগিতার আয়োজন করত। বিশিষ্ট শিল্পীরা সেই সব জায়গায় বিচারক হতেন। আর তাঁদের হাত থেকে পুরস্কার তুলে নেওয়ার রোমাঞ্চ— সে সব অনুভূতি আজও আমাকে উৎসাহ দেয়। ১৯৬৪ সালে আকাশবাণীতে প্রথম সরাসরি রাগপ্রধান গান গাওয়ার সুযোগ পেয়ে গেলাম। অনুভব করলাম নিজেকে এক জন পরিপূর্ণ শিল্পী হিসেবে। তার পর খেয়াল ও ঠুমরি। কলকাতাকে আমি এত ভালবাসি কেন, জানেন? এখানে সুস্থ সংস্কৃতির দারুণ কদর আছে। স্বীকৃতি দিতে জানে এ শহর। এত মানুষ, এত শুভেচ্ছা, আমি ভুলতে পারব না কখনও।

তখন শ্রোতৃমহলে পিন্টু ভট্টাচার্যের খুব কদর। কলকাতার এক গলির জলসায় তাঁর সঙ্গে আমার হঠাত্ আলাপ হয়ে গেল। তিনি উৎসাহ দিলেন আধুনিক গান গাইবার জন্য। এমনকী, বেশ কিছু দিন রেওয়াজ ও চর্চাও করালেন আমাকে দিয়ে। তার পরে পাঠিয়ে দিলেন আকাশবাণীতে। সরাসরি আধুনিক গান গাইলাম শ্রোতাদের দরবারে।

আমার ফেলে আসা কলকাতায় গলির জলসাগুলোর এক অন্য রকম দাপট ছিল। ছোট বড় সব শিল্পীই গান গাইতেন সে সব আসরে। তবে আমার ভাল লাগত অন্য কারণে। কলকাতায় কত গলি আছে, আমরা বাইরে থেকে চট করে তা বুঝতে পারি না। কিন্তু কোনও অনুষ্ঠান হলে কোথা থেকে যে সবাই এসে ভিড় করতেন! এমন ‘গলি কালচার’ অন্য কোনও শহরে ভাবাই যায় না।

কলকাতা আমার খুব প্রিয় যেমন, তেমন, লাকিও। ১৯৭২ সালে আমার প্রথম আধুনিক গানের রেকর্ড বেরোল বাজারে। আর শুরুতেই হিট করে গেল শৈলেন মুখোপাধ্যায়ের সুরে ও পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় ‘এ তো কান্না নয় আমার’। আধুনিকের পাশাপাশি বাংলা ছায়াছবির গানেও প্রবেশ করলাম এর পর, সালটা ১৯৭৪। তখন তো উত্তমকুমার মানেই এক দারুণ উত্তেজনা! ওই পর্বেই মহানায়ক অভিনীত ‘আমি সে ও সখা’ ছবিতে আমার গান গাওয়া— ‘এমন স্বপ্ন কখনও দেখিনি আমি’।

তাই জীবনের একটা সময় যখন সুদূর মুম্বই থেকে হিন্দি গান গাইবার আমন্ত্রণ পেলাম, তখন মনে হয়েছিল, আমি আমার কলকাতার মুখ রেখেছি। পরে ওড়িশা থেকেও সেখানকার ফিল্মি গানে গাইবার অনেক আমন্ত্রণ পেয়েছি।

এখন এই শহরে গান-বাজনার রেওয়াজ বা চর্চার পরিবেশ তেমন নেই। আশির দশক থেকেই নানা ঘাটতি নতুন গানে। কথা ও সুরের সেই মেলবন্ধন অনেকটাই যেন কেটে গেছে। ফলে চট করে কোনও গান শ্রোতাদের আর বেশি দিন ভাল লাগছে না। আমার মনে হয়, অনেক প্রতিকূলতা কাটিয়েও আমরা শিল্পীরা থেমে থাকি না। আবারও ফিরে আসবে বাংলা গানের ‘নস্টালজিক’ অনুভূতি, বিশ্বাস করি। কলকাতা যে কখনও বিমুখ করে না কাউকে!


 
 

Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player


প্রথম পাতা অতীতের তাঁরাফিরে দেখাশিরোনামে শেষ তিরিশ • আনাচে-কানাচেক্যামেরা-বন্দি

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.