মনীষালয়
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি
২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ, সোমবার, রাত্রি ২টো ২৮ মিনিটে (ইংরেজি মতে ৭ মে ১৮৬১) জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের পারিবারিক ভদ্রাসন, ৬ দ্বারকানাথ ঠাকুর লেনের বাড়িতে রবীন্দ্রনাথের জন্ম। তার আশি বছর পরে, ২২ শ্রাবণ, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দে (৭ অগস্ট, ১৯৪১) তাঁর প্রয়াণও হয় সেই বাড়িতেই।

পুরনো ইতিহাস থেকে জানা যায়, পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে যশোহর জেলার চেঙিগুটিয়ার জমিদার দক্ষিণানাথ রায়চৌধুরীর চার পুত্র, কামদেব, জয়দেব, রতিদেব ও শুকদেবের মধ্যে প্রথমোক্ত দু’জন মুসলিম শাসক পীর আলির চক্রান্তে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন। তত্কালীন সমাজনীতি অনুসারে অপর দুই ভাইয়ের স্বধর্ম বজায় থাকলেও তাঁরা সমাজচ্যুত হয়ে পিরালী (বা পীরালি)-ব্রাহ্মণ হিসেবে পরিচিত হন। সমাজচ্যুত হওয়ায় অন্য ব্রাহ্মণ পরিবারের সঙ্গে তাঁদের বিবাহাদি বন্ধ হয়ে যায় ফলে তাঁরা পুত্র-কন্যাদের বিয়ে দেওয়ার জন্য নানা কৌশল অবলম্বন আরম্ভ করেন। সে ভাবেই কনিষ্ঠ শুকদেব রায়চৌধুরী পিঠাভোগের জমিদার জগন্নাথ কুশারী নামে এক উচ্চ শ্রেণির ব্রাহ্মণের সঙ্গে তাঁর কন্যার বিয়ে দেন। জমিদার হলেও পিরালী-কন্যাকে বিবাহের অপরাধে জগন্নাথ সমাজ পরিত্যক্ত হয়ে শুকদেবের সহায়তায় বারোপাড়া গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। এই জগন্নাথ কুশারীই ঠাকুর বংশের আদিপুরুষ। জোব চার্নকের কলকাতা আগমনের সমসাময়িক কালে অর্থাত্ সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে জগন্নাথের এক উত্তর-পুরুষ পঞ্চানন এবং তাঁর কাকা শুকদেব ভাগ্যান্বেষণে কলকাতা অঞ্চলে আসেন। কলকাতা তখন নেহাতই এক পরগনা মাত্র কিন্তু ডাচ, পর্তুগিজ বণিকদের দৌলতে ব্যবসা-বাণিজ্যের একটা বড় কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। হাটখোলা-সুতানুটি অঞ্চল ছিল তার অন্যতম ঘাঁটি। কাকা-ভাইপো কলকাতায় এসে বিদেশি বণিকদের জাহাজে মালপত্র সরবরাহের কাজ আরম্ভ করেন। তার পর কলকাতা গ্রামের দক্ষিণে গোবিন্দপুরে জমি কিনে বসতবাড়ি তৈরি করেন। বর্ণে ব্রাহ্মণ বলে সহকর্মী গ্রামবাসীরা তাঁদের ঠাকুরমশাই বলে সম্বোধন করত। সেই দেখে সাহেবরাও তাঁদের ওই ঠাকুর বলেই ডাকত। কালক্রমে সেই ঠাকুর সাহেবি উচ্চারণে টেগোর-এ রূপান্তরিত হল।
পলাশির যুদ্ধের পর ইংরেজরা গোবিন্দপুর অঞ্চলে নতুন কেল্লা তৈরির জন্য আরও অনেক পরিবারের সঙ্গে ঠাকুরদেরও ঠাঁইনাড়া হতে হল। ক্ষতিপূরণের টাকায় পঞ্চাননের পৌত্র নীলমণি পাথুরিয়াঘাটায় জমি কিনে বাড়ি তৈরি করেন— সূত্রপাত হল পাথুরিয়াঘাটা-ঠাকুর পরিবারের। কিন্তু কিছু কাল পরে ভাই দর্পনারায়ণের সঙ্গে সম্পত্তি নিয়ে মতান্তরের কারণে নীলমণি গৃহদেবতা লক্ষ্মী-জনার্দনকে নিয়ে সপরিবারে পাথুরিয়াঘাটা ত্যাগ করলেন। সাবেক মেছুয়া বাজারের অন্তর্গত জোড়াসাঁকো অঞ্চলে এক বিঘা জমির উপর বাড়ি তৈরি করলেন পঞ্চানন কুশারীর উত্তর পুরুষ নীলমণি কুশারী। উত্সর্গ করলেন লক্ষ্মী-জনার্দনের নামে। জমি দিয়েছিলেন বৈষ্ণবচরণ শেঠ। ১৭৮৪ সালের জুন মাসে প্রতিষ্ঠা হল জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি।

নীলমণির নাতি দ্বারকানাথ ঠাকুরের সময় থেকেই এই পরিবারের স্বর্ণযুগের সূচনা। পুরনো ঐতিহ্যবাহী বাড়িগুলির মধ্যে নীলমণির তৈরি করা আদি বাড়িটি (এখন ‘মহর্ষি ভবন’ নামে পরিচিত) ছাড়াও এই চত্বরে এখন রয়েছে ‘রাম ভবন’, ‘বিচিত্রা ভবন’, ‘বকুলতলা ভবন’- এর একাংশ এবং জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের তৈরি করা নামহীন বাড়িটি। গত শতকের ষাটের দশকের গোড়া পর্যন্ত জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি ছিল ঠাকুর পরিবারের দখলে। জীর্ণ সেই বাড়িতে পরিবারের কেউ কেউ বাস করতেন আর বাকি অংশে ছিল নানা দোকান ও গুদামঘর। স্বাধীনতার পরে রাজ্য সরকার বাড়িটি অধিগ্রহণ করে। প্রতিষ্ঠিত হয় ‘রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়’ এবং একটি প্রদর্শশালা।

বিটি রোডে আছে পাথুরিয়াঘাটা ঠাকুরবাড়ির যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের ‘মরকত কুঞ্জ’। সত্তরের দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ক্যাম্পাস তৈরি হয় এখানে। জোড়াসাঁকো থেকে বিভিন্ন বিভাগ সেখানে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে জোড়াসাঁকোর বাড়িটি পুরোটাই রবীন্দ্র-প্রদর্শশালা হিসাবে ব্যবহৃত হতে থাকে (শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রভবনেও রয়েছে আরও একটি রবীন্দ্র-প্রদর্শশালা)।
বিশ্ববিদ্যালয়ের দখলে থাকলেও জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির আগাগোড়া সংস্কার কোনও কালেই করা হয়নি। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি পর্বে বাড়িটি একেবারে ভেঙে পড়ার উপক্রম হলে রাজ্য সরকারের উদ্যোগে খানিকটা সংস্কারের কাজ হয় মাত্র। সেই শেষ। তার পর দীর্ঘ তিন দশকেরও বেশি সময় কালে তেমন কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে।
রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের উদ্যোগে পুরো বাড়িটিকে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ‘হেরিটেজ প্রিজারভেশন’ নামের এই সংস্কার প্রকল্পটিতে পুরো ঠাকুরবাড়ি চত্বরের হারিয়ে যাওয়া স্থাপত্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠনপাঠনের প্রয়োজনে এক সময়ে পুরনো বাড়িগুলির পাশে আধুনিক স্থাপত্যরীতিতে তৈরি করা হয়েছিল ‘প্রশাসনিক ভবন’ ও ‘সঙ্গীত ভবন’-এর মতো বাড়িগুলি। আপাতদৃষ্টিতে পুরনো ঐতিহ্যের সঙ্গে বেমানান বাড়িগুলি ছাড়া অন্য পুরনো ভবনগুলিকে আগের মতো রূপ দেওয়ার চেষ্টাও হয়েছে।

ঐতিহ্যবাহী এই বাড়ির প্রতিটি ইট, কাঠ, পাথরের মধ্যেই ছড়িয়ে আছে শিল্প এবং ঐতিহ্য। দীর্ঘ দিনের অবহেলায় বাড়ির বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে থাকা কাঠের আসবাব, কাস্ট আয়রন, পোর্সেলিন টাইলস প্রভৃতি শিল্পবস্তুগুলি নষ্ট হতে বসে ছিল। ওই প্রকল্পে বাড়ির স্থাপত্যগত রক্ষণাবেক্ষণের পাশাপাশি বাড়ির বিভিন্ন দেওয়ালের কারুকার্য, স্থাপত্যিক লিপি, রেলিং, সিলিং, গার্ডেন-ফার্নিচার, সিঁড়ি ইত্যাদির সংস্কার ও সংরক্ষণও করা হয়েছে। সেই সঙ্গে ঠাকুরবাড়ির পুরনো ঐতিহ্যের একটা দৃশ্যমান রূপ দেওয়া হচ্ছে, যাতে দর্শকেরা এই বাড়িতে ঢুকে সেই দ্বারকানাথ থেকে রথীন্দ্রনাথ পর্যন্ত প্রবাহিত ঠাকুরবাড়ির পুরনো ঐতিহ্যকে অনুভব করতে পারেন।

তথ্য ও ছবি: গৌতম বসুমল্লিক

 
 
 

Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player


প্রথম পাতাঅতীতের তাঁরাতারাদের চোখেআমার শহরফিরে দেখাশিরোনামে শেষ তিরিশ

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.