...নববর্ষে করিল পদার্পণ

(আটলান্টা থেকে)
ববর্ষ মানেই গালভরা প্রতিশ্রুতির ঝুড়ি। নববর্ষ বললেই, চোখে ভেসে ওঠে, সামনে সম্ভাবনার উত্তুরে হাওয়ার হাতছানি, আর পিছনে নস্টালজিয়ার আঁচল ধরে পিছুটান।

ছেলেবেলায় অতশত বুঝতাম না। বারোটা মাস হাপিত্যেশ করে বসে থাকার পর, শেষে কর গুণতাম, এই নববর্ষ এল বলে! হয়তো চাইলাম ‘ম্যাক্সি’, জুটল ‘ঘটিহাতের জামা’, আবদার ছিল ‘কাফতান’, প্যাকেট খুলে দেখা গেল ‘স্কার্ট’, দাবি ছিল ‘বেলবটম’, আচমকা এসে পড়ল ‘শাড়ি’। তবু মনের মেঘ মুহূর্তে তাড়িয়ে দেয় নতুন কড়কড়ে উপহারের গন্ধ। যাই হোক, গায়ে নতুন পরে, আমি দাঁড়াই আয়নার উল্টো দিকে আমার ‘অচেনা আমি’র সামনে। অমন গোলগাল মুখ কবে ডিম্বাকার হতে শুরু করল, যাকে সাজাতে বসতে হয় টিপে ঝুমকোয়! মাথায় লাল ফিতে দিয়ে বেড়াবেণী নিয়ে ‘পার্চমাস্ট’-এ ‘ডাইনা মোড়’ ‘বাঁয়া মোড়’ করতে করতে প্রতি নববর্ষই হয়তো এ ভাবেই সবাইকে কাঁথা থেকে জামা, আর জামা থেকে শাড়ি জড়িয়ে বড় হওয়ার অলিগলি চিনিয়ে, অন্ধিসন্ধি বাতলে দেয়। দিন বদলের পালায় কোথায় যেন পালিয়ে যায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রণাম করা আর মিষ্টি খাওয়ার নানা রঙের দিনগুলি। বাড়ির বারান্দায় এলোমেলো পর্দা দেওয়া মঞ্চে ভীষ্মলোচন শর্মারাও রবাহুত অতিথি। কুছ পরোয়া নেই!

নব আনন্দে, নব কিরণের আলোয় কেউ বছরের এই প্রথম দিনে অবাঞ্ছিত বা অপাঙক্তেও নয়। এ দিন যে সবার রঙে রঙ মেলাবার দিন। সেই রঙে রঙিন হয়েই না পাড়ার অস্থায়ী শামিয়ানার তলায় ‘ফাংশন’-এ কাজল পরা দু’চোখ ক্ষণস্থায়ী চোখাচোখিতে মশগুল! প্রভাতফেরীর মতো লোকজন জড়ো করা ফেরিওয়ালার জুড়ি কোথাও নেই। সেখানে হাজিরা দেওয়া চাই। দুরুদুরু বুকের ভেতর উড়ু উড়ু মনটা যে তখন তাথৈ নাচছে।

বছরের নতুন দিনে ঘুমটা ভাঙে নরম মেজাজ নিয়ে। স্কুল-কলেজ-অফিস চিচিং বনধ, তাই এ দিন সখের আড়া়মোড়া ভাঙার দিন। সোফার গায়ে হেলানো আয়েসে যেন লেপ্টে থাকার দিন। দুনিয়ার সব ‘বিশেষ’গুলো যেন যেন ‘জি হুজুর’ বলার অপেক্ষায় ট্রে হাতে সারি বেঁধে পর পর দাঁড়িয়ে। পছন্দের খাবার, মনমাফিক পোশাক, উপহারের ঢল— সব চকচকে রাংতায় মোড়া প্যাকেজে আসে এই চুমকি-চমক দিনে। সুরে-বেসুরে মনপসন্দ গুনগুনানি গান, শুধু স্নানঘরে বন্দি না থেকে ছড়িয়ে যায় সারা বাড়িতে। টিভির পর্দায় ছড়ানো ছেটানো উদযাপনের হাট। উফ্, আনন্দ ও উদ্দীপনার লিস্টির যেন কোনও শেষ নেই। অন্য দিনগুলো যদি বা সমঝোতার বনসাই হয়ে ম্যাড়মেড়ে ঠেকে, আজকের দিনটি নির্দ্বিধায়,
‘‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে,
সব গাছ ছাড়িয়ে
উঁকি মারে আকাশে...’’।
সারা বছর অগুণতি অবকাশ আছে জেনেও, মানুষ টাইম বোমা ফাটিয়ে বলে, ‘নববত্সরে করিলাম পণ’।

ইংরেজি তারিখ মেনে পাশ্চাত্যেও এর হিড়িক কম নয়। গত সপ্তাহের চিল-চিত্কার ভুলে এবং সামনের বছরে সম্পর্ক চিরবিচ্ছেদের দিকে ধাবমান জেনেও, মনুষ্যরূপী কপোত কপোতীরা মধ্য রাতে ‘লং ড্রাইভ’ করে শীতে কাঁপতে কাঁপতে, চোখ বুজে, ওই ‘কনফেত্তি’ ভরা বলের পুষ্পবৃষ্টির সামনে, প্রেমে ভাইরাস ঢুকে পড়েছে জেনেও, হাজার হাজার লোক সাক্ষী রেখে দীর্ঘ চুম্বন সারতে ভোলে না। নাই বা পরিণতি পেল চিরন্তন সম্পর্ক! তাতে বয়েই গেল!

দেশ কালের সীমা ছাড়িয়ে কী ‘রেজলিউশন’ নেওয়া হল— তা জানার কৌতূহল লোকের চোখের কোণায় উপচে পড়ে।

‘মাস ইন্টারভিউ’ বা গণ সাক্ষাত্কার বা জেরার দিনও নববর্ষ। ওই দিনটির পর, হিসেব জানার পাততাড়ি গোটানো লোকেদের আর টিকিটি পাওয়া যায় না। চড়ক পুজোর শিব-গৌরীর নাচ আর লাগ ভেল্কি লাগের ধুন্ধুমারের পর পরই নিশ্চিত হবে না জেনেও, ‘অনেক কিছু করব’ ভাবার দিন নববর্ষ।

ভাল থাকার, ভাল রাখার ইচ্ছেগুলোকে অক্ষয় রাখার সদিচ্ছা পাকাপোক্ত করতে, গায়ে মাখে নতুন জামার কড়কড়ে গন্ধ। রসুন পেঁয়াজে মাখামাখি রোববারের লাল-ঝাল মাংস আরও কষা, আরও সুস্বাদু হয়ে উঠে আসে খাবার টেবলে। আর সেই সবুরের ফল মেওয়া। মেওয়া নইলে তো সবই আলুনি! সারা বছর যাতে এই দিনটার ‘রেপ্লিকা’ বা ‘ফোটো কপি’ হয়, তার জন্য সব ‘ঠিকঠাক’ করার হুজ্জোত যেন পড়ে যায়। সব জমা বিষে নীলকণ্ঠ হয়ে, গলার স্বরের চিরতা এতটুকু যাতে মাথাচাড়া দিতে না পারে— তার জন্য বুকে হাত রেখে বলুন তো, নববর্ষের দিনে সপরিবারে তোড়জোড় নেন না কোন বাঙালি?

নববর্ষের কথা ভেবেই চৈত্রের ‘সেল’ (ছাড়)-এ কিছু কড়কড়ে নোট জলাঞ্জলি দেওয়া বরাদ্দ রাখে মানুষ। ‘ফিক্সড প্রাইস’-এর উত্তর যুগে, মফসসলে দেখেছি, সারা বছর দরাদরি করতেন যে ব্যবসায়ীরা, হালখাতার দিনে, প্রসন্ন মুখে অমায়িক মিষ্টি বিতরণ করতেন তাঁরাই। দোকান থেকে দোকানান্তরে ঘুরে মিষ্টি খাওয়ার অমলিন স্বর্গবাসের শৈশব মুখর সেই দিনগুলি ‘সোনার খাঁচায় রইল না’, সে তো রাখতে পারলাম না বলেই! ছেঁকা খাওয়া বৈশাখের ভাগ্যে ঋতুরাজ না হয় নাই জুটল, তার মাথার মুকুটমণির তারিখটি তো পঁচিশে বৈশাখ! নববর্ষের পেছন পেছন সেও তো এলো বলে! বাঙালি জাতিকে আলোর পথে নিয়ে যাওয়ার রথের রশি যার হাতে, সেই রবীন্দ্রনাথ তো সারা জাতির হয়ে শান্তি সস্তায়ণ মন্ত্র তো পড়েই দিয়েছেন:
‘জীর্ণ পুরাতন যাক ভেসে যাক, যাক ভেসে যাক’
আবার...
‘বত্সরের আবর্জনা, দূর হয়ে যাক যাক যাক’

ভাবুক-বাঙালির কাছে নববর্ষ উদযাপনে আকাশের তারা যথেষ্ট নয়। ‘ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা’ পোড়াবার সঙ্গে সঙ্গে সে পোড়ায় আতসবাজিও, আকাশমুখী আলোর রোশনাই। আর ওই রকেটে ছুটে চলে সে আর তার ঊর্দ্ধগামী মন।

নববর্ষের যথাযোগ্য স্থানে যথাযোগ্য সম্ভাষণ জানিয়ে ‘শ্রীচরণেষু-সুচরিতাসু’ ‘অবসোলেট টার্ম’ –এ লেখা চিঠির প্রজন্ম উবে গিয়েছে মহাশূন্যে। সেই মুগুর ভাজা ষণ্ডা ষণ্ডা আবলুশ কালো ফোনের যুগ থেকে, হাতের মুঠোয় বন্দি মাউস মাপের ভ্রাম্যমাণ ফোনের যুগেও, ঐতিহ্য বজায় রেখে ‘হ্যাল্লো, ভাল্লো?’ সেই সাতসকালের রেওয়াজ অক্ষুণ্ণ। ব্যস্ত যান্ত্রিক জীবনের মধ্যে এও এক বড় পাওয়া।

হালখাতা, গণেশ ঠাকুর, আমপাতা জোড়া জোড়ায় সিঁদুরের টিপ— এক বছর বেড়ে যাওয়া, হয়তো চুলে রুপোলি টান— সে তো আছে, থাকবেও। তবু বাঙালি বছরে এক দিন অন্তত, নিজের জীবনের অঙ্ক খাতার আয়নায় মুখোমুখি হয়, হিসেব কষে, অজান্তে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, দ্বিগুণ উদ্যমে তৈরি হয় এবং আবেগতাড়িত হয়ে শপথও নিয়ে ফেলে! মোদ্দা কথা, অন্তত নববর্ষকে কেন্দ্র করে, উপলক্ষ করে বাঙালি আবার ভাবে, সব ভুল নস্যাত করে, সব দ্বিধা পায়ে মাড়িয়ে, দ্বিতীয় বার বেঁচে উঠি। পুনর্মুষিক হওয়ার গ্লানি থেকে মুক্তি খুঁজে সে স্বপ্ন দেখে পুনর্জন্মের।

বছর পুরনো কাসুন্দি ও আচারের মতো। নেড়ার বার বার বেলতলা যাওয়ার গপ্পো বা কচলানো নেবু তেতো হওয়ার প্রবাদের সাবধানবাণী, এর কাছে হয়ে য়ায় অবান্তর ও নস্যি।

জন্মভূমি অসম, কর্মভূমি আটলান্টা। পেশা শিক্ষকতা— শুরু হয়েছিল কলকাতা ও আমেরিকার কলেজে অধ্যাপনা দিয়ে, এখন কচিকাঁচাদের পড়িয়েই সময় কাটে। হাত নিশপিশ করে কাগজ-কলম নিয়ে বসতে না পারলে, শখটাই তো কাগজের গায়ে কলমের ফুলঝুরি ছড়ানো। নিজস্ব ভাবনাকে মঞ্চে তুলে ধরাও আর এক নেশা, অনুষ্ঠান উপস্থাপনার সূত্রে দর্শকদের সঙ্গে আলাপচারিতা।


 
 
 

Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player


প্রথম পাতাঅতীতের তাঁরাতারাদের চোখেফিরে দেখাশিরোনামে শেষ তিরিশ • আনাচে-কানাচে

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.