ঐতিহাসিক হার ইস্টবেঙ্গলের
গতি আর ফিটনেসের সামনে অসহায় আত্মসমর্পণ মোগাদের
ধানমন্ডি ৩ (এমেকা, সনি, ওয়েডসন)
ইস্টবেঙ্গল ০
খেলা শেষ হওয়ার পনেরো মিনিট আগে প্রবল বিরক্তিতে ভিভিআইপি বক্স থেকে নেমে গেলেন মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য। চলে গেলেন বাড়িতে। “আর দেখা যাচ্ছিল না। ইস্টবেঙ্গলকে কখনও এত খারাপ খেলতে দেখিনি। কোনও লড়াই-ই দিতে পারল না! টিমটার কোনও মোটিভেশন আছে বলে তো মনে হল না,” হতাশ গলা ইস্টবেঙ্গলকে প্রথম বার আই লিগ জেতানো কোচের।
লাল-হলুদের ঘরের ছেলের ‘আর্তনাদ’ ম্যাচের শেষে অন্য ভাষা নিয়ে আছড়ে পড়ল যুবভারতীর বাইরে। বহুদিন পর কোচের নামে ‘গো ব্যাক’ আওয়াজ ফিরল ইস্টবেঙ্গলে। মোগা-তুলুঙ্গাদের গাড়ি মাঠ ছেড়ে বেরোনোর সময় গোটাকয়েক চাপড়ও পড়ল। ফুটবলারদের ঘিরে ধরে সমর্থকেরা প্রশ্ন তুললেন, “খেলাটাই ভুলে গেছিস না কি?” কলকাতা লিগের ডার্বি ম্যাচ হারের পরেও যে অসংখ্য লাল-হলুদ মুখ ‘সহ্য’ করেছিল, ধানমন্ডির কাছে আর্মান্দো ব্রিগেডের অসহায় আত্মসমর্পণ দেখে সেই মুখগুলোতেই শোনা গেল স্লোগান “মর্গ্যান লাও ক্লাব বাঁচাও।”
দু’বছর আগে ট্রেভর জেমস মর্গ্যানের এনে দেওয়া শিল্ড ফের তাঁবুতে তোলার আশা হাতছাড়া হওয়ার পর হতাশায় ডুবে গিয়েছিল ইস্টবেঙ্গল গ্যালারি। বাংলাদেশের সনি-এমেকা-মামুনদের জন্য অবশ্য হাততালি পড়েছে কিছু। হাজার হোক, ওপার বাংলার টিম তো!
লাল-হলুদ ডিফেন্স ভেঙে সনির গোল।
মার্কোস ফালোপার আয়ু ছিল ১১ ম্যাচ। সাফল্যের শতাংশ প্রায় পঞ্চাশ। তাঁর বড় অবদান ছিল ইস্টবেঙ্গলকে প্রথম বার এএফসি কাপ সেমিফাইনালে তোলা। তা সত্ত্বেও ফালোপা নন, ইস্টবেঙ্গলের সাফল্যের রেখচিত্র ক্রমশই নিম্নমুখী হতে দেখে ট্রেভর মর্গ্যানের প্রথম বছরের সঙ্গে তুলনায় চলে আসছে আর্মান্দো জমানা-র প্রথম মরসুম।
অস্ট্রেলিয়া থেকে এসে প্রথম বছরই মর্গ্যান ইস্টবেঙ্গল তাঁবুতে এনেছিলেন তিনটি ট্রফি ফেড কাপ, কলকাতা লিগ আর জুবিলি কাপ।
সেখানে আর্মান্দো কোলাসোর ৭৯ দিনের মার্কশিট?
কলকাতা লিগ: চ্যাম্পিয়ন হলেও ডার্বি হারের কাঁটার তীব্র খচখচানি।
আই লিগে ছয় ম্যাচ: তিনটে জয়। আপাতত লিগ টেবিলে সাত নম্বরে।
ফেড কাপ: গ্রুপ লিগ থেকেই বিদায়। জয় মাত্র এক ম্যাচে।
আইএফএ শিল্ড: সেমিফাইনালে লজ্জাজনক হার। ক্লাবের ৯৪ বছরের ইতিহাসে বাংলাদেশের কোনও দলের কাছে এত বড় ব্যবধানে হারেনি ইস্টবেঙ্গল। শেষ হারই তো ’৯৯-এ। এয়ারলাইন্স কাপে ঢাকা মহমেডানের কাছে।
বাংলাদেশের ফেড কাপ চ্যাম্পিয়নদের কাছে চিডি-মোগারা পর্যুদস্ত মঙ্গলবার ইস্টবেঙ্গলের হাল দেখে এই লাইনটাও জুতসই বলে মনে হচ্ছে না। ‘অসহায় আত্মসমর্পণ’ কথাটাই মনে হয় ঠিক।
ধানমন্ডির কাছে ইস্টবেঙ্গল কতটা ‘মণ্ড’ পাকিয়ে গিয়েছিল তা বোঝাতে বাংলাদেশের কোচ এবং স্ট্রাইকারের মন্তব্য তুলে দেওয়া যেতে পারে।
সান্ত্বনা। ম্যাচ শেষে দুই কোচ।
“এত সহজে জিতব ভাবিনি। মোহনবাগান তবুও লড়েছিল, এরা তো কিছুই করতে পারল না,” কার্যত নাচতে নাচতে ড্রেসিংরুমে যাওয়ার পথে বললেন ধানমন্ডির নাইজিরিয়ান স্ট্রাইকার এমেকা। যার কিছুক্ষণ পর সাংবাদিকদের সামনে এসে কোচ জোসেফ আফুসি-র মন্তব্য, “একটাই প্ল্যানিং নিয়ে কেউ মাঠে নামলে এ রকমই হয়। জিততে হলে ‘প্ল্যান বি’-ও তৈরি রাখতে হয়।” ইঙ্গিতটা যে আর্মান্দোর দিকে, সেটা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
আর প্ল্যানিং? আর্মান্দোর এ দিনের প্ল্যানিংয়ের নাম হতেই পারত হ-জ-ব-র-ল। প্রথম একাদশ? সেটাও তো ভুলে ভরা।
বাংলাদেশি টিমে তিন জন আগুনে মেজাজের বিদেশি স্ট্রাইকার ছিলেন এমেকা, ওয়েডসন আর সনি নর্ডি। আর্মান্দো তাঁদের বিরুদ্ধে কিনা নামিয়েছিলেন চার দুবলাপাতলা ডিফেন্ডারকে! অর্ণব, অভিষেক, রবার্ট, রাজুরা বিপক্ষ অ্যাটাকারদের জার্সি টেনে, মারামারি করেও আটকাতে পারলেন না। তিন গোল হজম করতেই হল। পারবেনই বা কী করে? সনি-এমেকাদের রাজধানী এক্সপ্রেসের গতির পাশে রাজু-রবার্টরা এ দিন তো ছিলেন ঠেলাগাড়ি। নিট ফল, সাঁইত্রিশ মিনিটের মধ্যেই কার্যত ম্যাচ শেষ। ধানমন্ডি ততক্ষণে ২-০ এগিয়ে। উড়ে আসা বলে এমেকার হেডে প্রথম গোলের সময় অর্ণব দর্শক হয়ে রইলেন। আর এমেকা-নর্দি যুগল-দৌরাত্ম্যে শেষ জনের দ্বিতীয় গোলের সময় লাল-হলুদ ডিফেন্স যেন কাঁপছিল! অর্ণব ম্যাচের শেষ দিকে লাল কার্ডও দেখলেন ফাউল করে।
কেন পাঁচ ডিফেন্স খেলালেন না? বিপক্ষের শক্তি সম্পর্কে কি হোম ওয়ার্কে ফাঁক ছিল আপনার? ম্যাচ শেষে এ সব ‘বাউন্সার’ সামলাতে নিজে আসেননি কোচ আর্মান্দো। পাঠিয়েছিলেন তাঁর সহকারী রঞ্জন চৌধুরীকে। ইস্টবেঙ্গল হারলে মিডিয়ার সামনে সহকারী আর জিতলে আমি ময়দানে তাঁর প্রথম মরসুমেই নতুন প্রথা চালু করে ফেলেছেন গোয়ান কোচ। বেচারা রঞ্জন! তোতাপাখির মতো তাঁর মুখ থেকে শুধু বেরোল “আজ ফুটবলের সব বিভাগেই ব্যর্থ আমরা। এই হার অনেক কিছু শেখাল আমাদের।”
ধানমন্ডির নাইজিরিয়ান কোচের স্ট্র্যাটেজি ছিল, প্রেসিং ফুটবল। যার নেতৃত্ব দেবেন দুর্দান্ত ফর্মে থাকা তিন বিদেশি স্ট্রাইকার। এতেই মাঝমাঠের দখল চলে এল মামুন-দিদারুলদের মুঠোয়। প্রথমার্ধে জোয়াকিম-ডিকা-সুয়োকা-সুবোধকুমারকে দেখে মনে হচ্ছিল মরুভূমির যাত্রীজল আর ছায়ার খোঁজে বিপর্যস্ত। আর্মান্দো ভুল শোধরাতে গিয়ে তাঁর পুরো মাঝমাঠটাই বদলে ফেললেন। কিন্তু ততক্ষণে যা সর্বনাশ হওয়ার হয়ে গিয়েছে। স্বভাবতই নানা প্রশ্ন উঠছে ম্যাচের পর তুলুঙ্গা কেন গ্যালারিতে? কেন হরমনজিৎ খাবরা শুরু থেকে নয়? কেন জোয়াকিম শুরু থেকেই? কেন সৌমিকের মতো অভিজ্ঞকে নামানোই হল না?
বাংলাদেশের এই ক্লাব টিমটা কিন্তু যথেষ্ট শক্তিশালী। ওপার বাংলার ফেড কাপ চ্যাম্পিয়ন। লিগে যুগ্ম শীর্ষে। নাইজিরিয়ান কোচ ছাড়াও সাপোর্ট স্টাফে আর্জেন্তিনার ফিটনেস ট্রেনার। বাংলাদেশের সেরা ফিজিও। খেলায় দেখে মনে হল, ধানমন্ডির প্রধান শক্তি তাদের ফিটনেস। সঙ্গে তেকাঠি চেনা বিদেশি স্ট্রাইকার। যাঁরা এ দেশের পাহাড়ি ছেলেদের মতো সারাক্ষণ দৌড়ে যেতে পারে। শিল্ডে এ বার যত দিন যাচ্ছে, নর্ডি-এমেকাদের খেলায় ঝাঁঝও বাড়ছে। এ দিন যা সুনামির মতো আছড়ে পড়ে ছারখার করে দিল আর্মান্দোর টিমকে।
মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের পর এ বার কি মহমেডানকেও হারিয়ে ধানমন্ডি ঐতিহ্যের শিল্ড প্রথমবার বাংলাদেশে নিয়ে যেতে পারবে? শনিবারের আগে উত্তর পাওয়া সম্ভব নয়। তবে একটা উত্তর এ দিনই পেয়ে গিয়েছে ইস্টবেঙ্গল। পেয়ে গিয়েছেন লাল-হলুদ জনতা।
আর্মান্দো গোয়ায় সুন্দর, বাংলায় নয়!
ইস্টবেঙ্গল: গুরপ্রীত, অভিষেক, অর্ণব, রাজু, রবার্ট, ডিকা, সুয়োকা (লোবো), সুবোধকুমার (খাবরা), জোয়াকিম (লেন), চিডি, মোগা।

তিন কোচের কিসসা
ট্রেভর জেমস মর্গ্যান
(২০১০-’১১)

৬৩ ম্যাচ, ৩৯ জয়, ১১ ড্র, ১৩ হার,
পক্ষে ১২৬ গোল, বিপক্ষে ৬৩ গোল
ট্রফি-কলকাতা লিগ, ফেডারেশন কাপ,
সেলিব্রেশন কাপ, আই লিগ-রানার্স
মার্কোস ফালোপা
(২০১৩-’১৪)

১১ ম্যাচ, ৫ জয়, ২ ড্র, ৪
হার, পক্ষে ২০ গোল,
বিপক্ষে ১৬ গোল
ট্রফি-নেই
আর্মান্দো কোলাসো
(২০১৩-’১৪)

২২ ম্যাচ, ১৩ জয়, ৫ ড্র,
৪ হার, পক্ষে ৩৩ গোল,
বিপক্ষে ১৫ গোল
ট্রফি-কলকাতা লিগ

তথ্য হরিপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়

পুরনো খবর:

ছবি: উৎপল সরকার।




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.