বারবার সেঞ্চুরি ফস্কাচ্ছেন বুদ্ধ, আক্ষেপ দলেই
লের মধ্যে তুলনায় অনেক উদার এবং বাস্তববাদী। সোজা কথা সহজ করে বলার পক্ষপাতী। জনতার কাছে আকর্ষণের বিচারে এখনও দলে পয়লা নম্বর! তবু বারবার এগিয়ে তাঁকে পিছিয়ে আসতে হয় কেন, ফের চর্চা হচ্ছে বাম মহলে।
চর্চার কেন্দ্রে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং রবিবার ব্রিগেড সমাবেশে তাঁর পারফরম্যান্স। ঠাসা ভিড়, লোকসভা ভোটের আগে বামেদের মনোবল বাড়ানোর মতো যাবতীয় উপাদান হাজির থাকা সত্ত্বেও ব্রিগেডে ম্রিয়মান ছিলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। যা শেষ পর্যন্ত নিরাশ করেছিল বহু সমস্যা পেরিয়ে ময়দানে আসা বাম কর্মী-সমর্থকদের। বুদ্ধবাবুর নেতাই-মন্তব্য নিয়ে ব্রিগেড সমাবেশের আগের দিনই সিপিএমের অন্দরে যে বিতর্ক হয়েছে, সেই ঘটনার দিকে আঙুল তুলেছে দলের একাংশ। কিন্তু একই সঙ্গে প্রশ্ন উঠছে বুদ্ধবাবুর নিজের রেকর্ডের দিকেও। রাজনৈতিক শিবিরের একাংশের মতে, বুদ্ধবাবু নিঃসন্দেহে ভাল ব্যাটসম্যান। কিন্তু ভাল শুরু করেও মাঝপথে উইকেট হারিয়ে বসেন! সেঞ্চুরি শেষ পর্যন্ত অধরাই থাকে! নেতাই এবং ব্রিগেড-পর্বে সেই একই ধারার পুনরাবৃত্তি হয়েছে বলে মনে করছেন কেউ কেউ।
দলের মধ্যেই একাংশ তুলনা টানছেন প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সঙ্গে। দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটিতে খারিজ হয়ে যাওয়ার পরে সেই ঘটনাকে ‘ঐতিহাসিক ভুল’ বলে প্রকাশ্যে অভিহিত করেছিলেন জ্যোতিবাবু। জীবদ্দশায় সেই অবস্থান থেকে কখনও সরে আসেননি। কিন্তু বসু-উত্তর বঙ্গ সিপিএমে জনপ্রিয়তম নেতা হয়েও সেই দৃঢ়তা দেখাতে পারেননি বুদ্ধবাবু। বেশ কিছু ক্ষেত্রে সাহসী হয়ে কিছু মন্তব্য করেছেন। আবার চাপের মুখে পড়ে পিছিয়ে এসেছেন! এর মধ্যে কয়েকটি ছিল ‘মুখ ফস্কে’ বলে ফেলা। কোনওটা তাঁর দলের জন্য রাজনৈতিক ভাবে অস্বস্তিকর। আবার কোনওটা কৌশলগত ভাবে ভুল। সিপিএম সূত্রের ব্যাখ্যায়, নেতাই-মন্তব্য এর মধ্যে তৃতীয় পর্যায়ভুক্ত।
শুধু মন্তব্যের ভুলই নয়। দলের মধ্যে তাঁর পছন্দের পাত্রদের পাশে দাঁড়াতে গিয়েও বিতর্কে জড়াতে হয়েছে বুদ্ধবাবুকে। এ বার রাজ্যসভার ভোটে ছাত্র-নেতা ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রার্থী করা নিয়ে যেমন হয়েছে। যে দৃষ্টান্তকে সামনে রেখে বুদ্ধবাবুর ‘পছন্দে’র মনোনয়ন নিয়ে দলের একাংশই সরব হয়েছেন। এই ক্ষেত্রে অবশ্য পূর্বসূরি জ্যোতিবাবুর সঙ্গে বুদ্ধবাবুর মিল পাচ্ছে দলের একাংশ। সিপিএমের এক রাজ্য নেতার মতে, “নানা বিতর্ক সত্ত্বেও তাঁর স্নেহভাজন বলে সুভাষদাকে (চক্রবর্তী) আগলে রাখতেন জ্যোতিবাবু। বুদ্ধদাও তেমনই যাঁকে ভরসা করেন, তাঁর পিছনে সর্বশক্তি দিয়ে দাঁড়ান।”
এর উল্টো উদাহরণও দিচ্ছেন দলের একাংশ। সিপিএমের মধ্যে আপত্তি থাকলেও লক্ষ্মণ শেঠ, অমিতাভ নন্দীর মতো নেতাকে রাজ্য কমিটি থেকে ছেঁটে ফেলা বা লগনদেও সিংহের মতো বিধায়কের ফের টিকিট পাওয়া আটকে দেওয়া সফল ভাবে করতে পেরেছেন বুদ্ধবাবু। রাজ্য সিপিএমে বিমান বসু, সূর্যকান্ত মিশ্র, গৌতম দেব এবং দিল্লিতে সীতারাম ইয়েচুরিকে পাশে পাওয়ায় ঋতব্রতর ক্ষেত্রেও শেষ পর্যন্ত উতরে যেতে পেরেছেন। নেতাইয়ের ক্ষেত্রে যেটা আবার সম্ভব হয়নি। নেতাইয়ে নিরীহ মানুষের মৃত্যু সমর্থনযোগ্য, এমনটা বুদ্ধবাবুর মতো সিপিএম নেতৃত্বের বড় অংশও বিশ্বাস করেন না। কিন্তু নেতাই নিয়ে বিচার-পর্ব চলাকালীন বুদ্ধবাবুর স্বীকারোক্তি আইনের চোখে দলের অবস্থান দুর্বল করে দিতে পারে বলে মনে করেছেন সিপিএম নেতৃত্বের বড় অংশই। সেই প্রশ্ন ঘিরেই গত কয়েক দিনে তোলপাড় হয়েছে সিপিএমের অন্দরে এবং বুদ্ধবাবুর সম্মতি নিয়েই শেষ পর্যন্ত রাজ্য সম্পাদক বিমানবাবুকে রাজ্য কমিটিতে বলতে হয়েছে, ওই মন্তব্য না-করলেই ভাল হতো।
সিপিএম সূত্রের খবর, মেদিনীপুরে গিয়ে ২ ফেব্রুয়ারি বুদ্ধবাবু “নেতাইয়ে আমাদের ছেলেরা ভুল করেছিল” বলে আসার পরে প্রথম আপত্তি উঠেছিল পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা নেতৃত্বের তরফেই। পর দিনই রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যরা প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, নেতাইয়ের বিচার-পর্ব এখনও চলছে। ফলে, তাঁর এমন মন্তব্যের আইনি প্রতিক্রিয়া হতে পারে। সিপিএমের বিভিন্ন জেলা নেতৃত্বের দিক থেকেও আপত্তি জানিয়ে বার্তা আসতে থাকে আলিমুদ্দিনে। তাঁদের সকলেরই বক্তব্য ছিল, বুদ্ধবাবুর কথায় শাসক তৃণমূল যেমন হাতিয়ার পেয়ে গিয়েছে, তেমনই দলের কর্মী-সমর্থকেরা বিপাকে পড়েছেন। দল যদি নেতাইয়ের ঘটনাকে ‘ভীষণ ভুল’ বলেই মনে করে, তা হলে তাতে জড়িত স্থানীয় নেতা-কর্মীদের আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ কেন দেওয়া হয়নি সেই প্রশ্ন তোলার সুযোগও তৃণমূল পেয়ে যাচ্ছে। বামফ্রন্টের বৈঠকে শরিক নেতারাও একই যুক্তিতে বিমানবাবুকে চেপে ধরেন। পরিস্থিতি ক্রমশই হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলী বুদ্ধবাবুর মন্তব্যের পাশে না দাঁড়ানোরই সিদ্ধান্ত নেয়।
দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের কথায়, “ঘটনার নিন্দা আমরা সবাই করছি। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই ওই ঘটনার বিচার প্রক্রিয়া যে শুরু হওয়ার কথা, সেটা ওঁর খেয়াল ছিল না। আমরা ধরিয়ে দেওয়ার পরে উনিও বুঝতে পেরেছেন। নন্দীগ্রামের ভুলের কথা বলতে গিয়ে নেতাইকেও এক সূত্রে টেনে ফেলেছিলেন।” বাম শিবিরের অন্দরেই প্রশ্ন উঠছে, নেতাই প্রসঙ্গে দলের অবস্থান সংশোধন করে দিতে আগ্রহী হলে বুদ্ধবাবু কেন দলে আগাম আলোচনা করে নিলেন না? তা হলে বুদ্ধবাবু ও দল, উভয় পক্ষই বিড়ম্বনা থেকে বাঁচত! আবার দলের ভাবমূর্তির পক্ষেও ভাল হতো।
নেতাই সাম্প্রতিক উদাহরণ মাত্র। বলে ফেলে পিছিয়ে আসার দৃষ্টান্ত বুদ্ধবাবুর আগেও আছে। মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন সীমান্ত এলাকার মাদ্রাসাগুলি সন্ত্রাসবাদের আঁতুড়ঘর বলে ফেলে প্রত্যাহার করতে হয়েছিল তাঁকে। বণিকসভায় গিয়ে এক বার বলেছিলেন, তিনি ‘দুভার্গ্যজনক’ ভাবে এমন একটি দল করেন, যারা বন্ধ ডাকে! দুর্ভাগ্যজনক শব্দটির ব্যবহারে বিপত্তি বেধেছিল। ঘটনার পরে পরেই ভুল শুধরে নিতে হয়েছিল বুদ্ধবাবুকে। আরও পরে ২০১২ সালে সিপিএমের রাজ্য সম্মেলনে দলের কাছেও ভুল স্বীকার করতে হয়েছিল।
বুদ্ধ-ঘনিষ্ঠ শিবির থেকে বলা হচ্ছে, নেতাইয়ের ক্ষেত্রে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা নেতৃত্বকে বার্তা দিতে চেয়ে তাৎক্ষণিক ভাবে কয়েকটি কথা বলেছিলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। যার সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার সব দিক আঁচ করে দেখেননি। এবং এখানেই প্রশ্ন থাকছে, কুশলী নেতা হিসাবে কেন তিনি যথেষ্ট দূরদর্শিতার পরিচয় দেবেন না? বলবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে এবং তিনি পিছিয়ে আসবেন এ ঘটনা বারবার ঘটলে তাঁর বা দলের, কারওই কোনও উপকার হচ্ছে না!
সিপিএমেরই একটি অংশের অবশ্য যুক্তি, দলের মধ্যে প্রয়াত জ্যোতিবাবু এবং বুদ্ধবাবুকে সমান দাঁড়িপাল্লায় বসানো যায় না। জ্যোতিবাবু যে উচ্চতায় নিজেকে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন, সেখান থেকে ‘ঐতিহাসিক ভুল’ সংক্রান্ত মন্তব্য বা পরমাণু চুক্তি ঘিরে ইউপিএ-১ থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের ভাবনা থেকে প্রকাশ কারাটদের প্রাথমিক ভাবে নিরস্ত করা সম্ভব ছিল। তুলনায় বুদ্ধবাবু দলের মধ্যে অনেক বেশি আক্রমণের শিকার! জ্যোতিবাবু কঠিন পরিস্থিতিতে নট আউট থেকে প্যাভিলিয়নে ফিরতে পারলেও বুদ্ধবাবুকে তাই ক্রিজ ছাড়তে হয় উইকেট হারিয়ে!

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.