মাত্র আঠারো মিনিটেই শেষ বুদ্ধের বক্তৃতা
নেতাদের মান রাখল জনতা। কিন্তু জনতার মন রাখতে পারলেন কি নেতারা?
রবিবারের ভরা ব্রিগেড ময়দান এই প্রশ্নই রেখে গেল বামফ্রন্টের জন্য! প্রশ্ন উস্কে দিলেন ম্রিয়মাণ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। ব্রিগেড সমাবেশের আগের রাতে নিজের দলই যাঁর হাতে চার্জশিট ধরিয়েছে!
অথচ মঞ্চ প্রস্তুত ছিল। ভিড়ের নিরিখে তৃণমূলের কয়েক দিন আগের বিশাল সমাবেশকে এ দিন টক্কর দিয়েছে বামেদের ব্রিগেড। কঠিন সময়ে রাজ্যের প্রধান বিরোধী পক্ষের সমাবেশে আসার জন্য দলের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে মরিয়া মনোভাব কাজ করছিল গত ক’দিন ধরেই। নানা প্রতিকূলতা সামলে সেই জেদেরই প্রতিফলন এ দিন দেখেছে ব্রিগেড। কিন্তু দিনের শেষে সেই উদ্যমী জনতার মধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে, লোকসভা ভোটের আগে এমন মঞ্চ ব্যবহার করে আরও জোরালো বার্তা কি দিতে পারতেন না বাম নেতৃত্ব?
ঠাসা ব্রিগেডের প্রধান বক্তা বুদ্ধবাবুর বক্তৃতা ছিল সাম্প্রতিক কালের মধ্যে হ্রস্বতম! মাত্র ১৮ মিনিটের বক্তৃতায় প্রত্যাশিত ঝাঁঝ উধাও। নরেন্দ্র মোদীকে কটাক্ষ, রাজ্য সরকারের দেদার টাকা খরচ এবং কাজে পিছিয়ে পড়ার সমালোচনা, সন্ত্রাসের অভিযোগের প্রেক্ষিতে শাসক দলকে হুঁশিয়ারি সবই ছিল বুদ্ধবাবুর কথায়। তবু মন ভরেনি সমর্থকদের।
সমর্থকদের হাতের লাল পতাকায় ছেয়ে গিয়েছে রবিবারের ব্রিগেড। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।
সিপিএমের অন্দরে এই নৈরাশ্যের জন্য দায়ী করা হচ্ছে দলকেই। ব্রিগেড সমাবেশের ঠিক আগের সন্ধ্যায় কিছুটা নজিরবিহীন ভাবেই রাজ্য কমিটির বৈঠক ডাকা হয়েছিল। আর সেই বৈঠকে বিস্তর বিতর্ক চলেছে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর নেতাই-মন্তব্য বা রাজ্যসভায় দলীয় প্রার্থীর মনোনয়ন নিয়ে। যা আদতেই ব্রিগেডের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়! নেতাইয়ের ঘটনা ভুল হয়েছিল বলে মন্তব্য করে বুদ্ধবাবু ঠিক করেননি, দলের মধ্যে বিতর্কের চোটে সেই কথা রাজ্য কমিটিতে ঘোষণা করতে হয়েছে রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুকে। ঘরের মধ্যেই এমন আক্রমণের পরের দিন বাইরে এসে বুদ্ধবাবুও হতোদ্যম থেকেছেন, মনে করছেন দলীয় নেতৃত্বের একাংশই। সিপিএমের রাজ্য কমিটির এক সদস্যের কথায়, “শনিবারের বৈঠকে লোকসভা ভোটের জন্য নির্দিষ্ট কিছু প্রার্থীর নাম ঠিক হয়ে গেলে আলাদা কথা ছিল। কিন্তু নেতাই নিয়ে হইচই বা রাজ্যসভা প্রার্থী নিয়ে চর্বিতচর্বণের জন্য বৈঠক তো ব্রিগেডের এক-দু’দিন পরেও হতে পারত! এত বড় সমাবেশের আগে এই বিতর্কে গোটা পরিবেশটাই তিক্ত হয়ে গেল!”
বস্তুত, চমৎকার মঞ্চ পেয়েও সুযোগের সদ্বব্যহার করতে না-পারার জন্য নেতাদের কাঠগড়ায় তুলছেন বাম শিবিরের লোকেরাই। তাঁদের বক্তব্য, বুদ্ধবাবু বরাবরই সোজা কথা সোজা ভাবে বলেন। সেই নীতিকে আটকাতে গিয়ে দলের কিছু নেতা কার্যত বুদ্ধবাবুর নাক কেটে নিজেদের যাত্রাভঙ্গ করেছেন! এটা যদি হতাশার একটা দিক হয়, অন্যটা অবশ্যই ঠা ঠা রোদের মধ্যে দূরাগত জনতার ধৈর্যকে পরীক্ষায় ফেলে নানা অসার কথার অবতারণা! যেমন, বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু তিস্তা জলবণ্টন চুক্তির প্রসঙ্গ টেনে বাংলাদেশে হাসিনা সরকারের সুবিধা-অসুবিধা প্রসঙ্গে এমন সব কথা বলেছেন, যা আখেরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই রাজনৈতিক ফায়দা দিতে পারে বলে ধারণা অনেকের। আবার সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট দেশে অ-কংগ্রেস, অ-বিজেপি বিকল্প শক্তিকে একজোট করার চেনা আহ্বানই জানিয়েছেন, এবং তা-ও একেবারেই গতানুগতিক কায়দায়।
তুলনামূলক ভাবে শুধু বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রই রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে চার্জশিট পেশ করে কর্মী-সমর্থকদের চাঙ্গা করার চেষ্টা চালিয়েছেন। কিন্তু বাম শিবিরের প্রধান সেনাপতির কাছে ব্রিগেডের জনতা যা চেয়েছিল, বুদ্ধবাবু তা দিয়ে যেতে পারেননি!
সিপিএমের ঘরানার বাইরে বেরিয়ে দলের পলিটব্যুরো সদস্য বুদ্ধবাবু বরাবরই আত্মসমালোচনায় বিশ্বাসী। ধারাবাহিক ভাবে সে কাজ করার চেষ্টাও করেছেন তিনি। দলের নেতা-কর্মীদের বোঝাতে চেয়েছেন, চিনের কমিউনিস্ট পার্টিও কঠোর আত্মসমালোচনা করে। যে ঘটনা বা যে মতকে সমর্থন করা যায় না, তার সাফ বিরোধিতা করারই পক্ষপাতী প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। নেতাইয়ের ক্ষেত্রেও তিনি তা-ই করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু দল রাশ টেনে ধরায় এ যাত্রায় পিছু হঠতে বাধ্য হয়েছেন। তাঁর সেই নৈরাশ্যের ফল ভুগতে হয়েছে এ দিনের ব্রিগেড সমাবেশকে! চেনা ছন্দের বুদ্ধবাবুর ভাষণে যা থাকে, তার ছিটেফোঁটাও ছিল না এ দিন। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্যের আক্ষেপ, “উনি (বুদ্ধবাবু) বিশ্বাস করেন, কমিউনিস্টদের পুরনো ধ্যানধারণা ছেড়ে বেরোতে হবে। মানুষ যা ভাবছেন, যা শুনতে চাইছেন, সেই দিকে দলকে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু দলই বারবার পিছন থেকে টেনে ধরলে কতটুকু এগোনো সম্ভব ওঁর পক্ষে!”
নিজে মূহ্যমান থাকলেও বুদ্ধবাবুই যে বামেদের ভরসার মুখ, এ দিনের ব্রিগেড তা বারেবারে বুঝিয়ে দিয়েছে। যখন তিনি এসেছেন, যখন বেরিয়েছেন, উদ্বেল হয়েছে ময়দান। বক্তা হিসেবে তাঁর নাম ঘোষণা হতেই রীতিমতো গর্জন করেছে জনতা। সেই জনতা, যারা বহু কাঠখড় পুড়িয়ে তবেই এ দিন সমাবেশে আসতে পেরেছিল! বেশ কিছু মিছিল এসেছে ঠিকই, কিন্তু তার বাইরেও বহু লোক নিজেদের মতো করে এসেছিলেন। আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে যাঁদের অধিকাংশই নামধাম বলতে চাননি। তাঁদের বেশির ভাগেরই বক্তব্য, “অর্ধেক দিন বাড়িতে ফিরতে পারি না। অন্য কোথাও রাত কাটাতে হয়। নিজেদের মতো ট্রেনে-বাসে চেপে এসেছি। ফিরবও কয়েক দিন পরে।” বাঁকুড়া থেকে আসা এঁদেরই এক জনের প্রতিক্রিয়া, “আরও ভাল বক্তৃতা শুনব ভেবেছিলাম। কিন্তু নেতারাই কি ভয় পেয়ে গেলেন?”
সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের ব্যাখ্যা অন্য রকম। তাঁর কথায়, “এখান থেকে নেতারা বেশি আক্রমণাত্মক হলে এলাকায় ফিরে কর্মী-সমর্থকেরাও কোনও ঘটনায় জড়িয়ে পড়তে পারতেন। এমনিই আমাদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মিথ্যা মামলা হচ্ছে! তখন ব্রিগেড থেকে উস্কানির অভিযোগ উঠত!”
কষ্ট করে মাঠে আসা জনতাকে অবশ্য কৃতজ্ঞতা জানাতে ভোলেননি বুদ্ধবাবু। বলেছেন, “দূর দূর থেকে, কয়েক দিন ধরে আপনারা এসেছেন। মাঠে রাত কাটিয়েছেন। থাকার আলাদা জায়গা নেই, খাবার নেই। আপনাদের অভিনন্দন জানাই!” দলের একাংশের মতে, কিছু দিন আগে বুদ্ধবাবুকে সামনে রেখে বর্ধমান সিপিএম যে ভাবে জমায়েত করে দেখিয়েছিল, বড় আকারে ব্রিগেডে সেটাই করেছে বামফ্রন্ট। বর্ধমানের নানা এলাকা থেকে এ দিনও ব্রিগেড-মুখী বাম সমর্থকদের বাধা দেওয়ার অভিযোগ এসেছে। আর তৃণমূল নেতৃত্ব বাম ব্রিগেডকে কোনও গুরুত্বই দিতে চাননি। শাসক দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের কটাক্ষ, “কোনও বার্তাই ওঁরা দিতে পারেননি। একটা বোগাস ব্রিগেড হয়েছে!”
তবে এ সবের মধ্যেও ভিড় দেখে উজ্জীবিত বাম নেতৃত্ব লোকসভা ভোটের আগে প্রতিরোধের ডাক দিতে চেয়েছেন। সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য সূর্যবাবু যেমন বলেছেন, “তৃণমূলকে বলছি, ব্রিগেডে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের তালিকা তৈরির চেষ্টা করবেন না। অত কাগজ পাবেন না! বরং আপনাদের (বাম সমর্থক) বলব, যারা বাধা দিচ্ছে, তাদের তালিকা তৈরি করে রাখবেন! সেটা অনেক ছোট হবে!” বুদ্ধবাবুও বলেছেন, “পঞ্চায়েত আর পুরভোটের কায়দায় ভোট করার চেষ্টা করবে ওরা। কিন্তু তৈরি থাকবেন। সন্ত্রাসের মুঠো চেপে ধরতে হবে!”
অসুস্থতার জন্য ব্রিগেডে ছিলেন না সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য নিরুপম সেন। আর যাঁর কাছ থেকে বাম জনতা আক্রমণাত্মক বক্তৃতা আশা করে, শারীরিক ভাবে কাহিল হয়ে ধুলোর ভয়ে তিনিও আসেননি। গৌতম দেব! তাঁর উত্তর ২৪ পরগনা জেলা অবশ্য বিপুল লোক দিয়েছিল। বর্ধমান, বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার মতো জেলা থেকেও বহু লোক এসেছিলেন।
প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ভয় নিশ্চয়ই ছিল। তবু ভয় জয় করে মাঠে আসা জনতাই বাম নেতাদের ভরসা দিয়ে গেল এ দিন। আর সেটা ছাপিয়েও থেকে গেল বার্তা না-পাওয়ার আক্ষেপ! সিপিএমের এক জেলা সম্পাদকের কথায়, “নেতারা জনতাকে উজ্জীবিত করতে পারলেন কি না, জানি না! তবে জনতা নেতাদের উজ্জীবিত করে গেল!”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.