সেমিফাইনালে বাংলাদেশের ক্লাবের ফ্রিকিক-কাঁটা উপরে ফেলতে
জোরদার অনুশীলন চিডি-মোগাদের। ছবি: উৎপল সরকার। |
ফুটবলের ভরা মরসুমে কলকাতার চার আই লিগ দলের মধ্যে তিন ক্লাবের লক্ষ্য আছে, উচ্ছ্বাস আছে। আছে শিল্ড ফাইনাল ওঠার তাগিদ। স্বপ্ন। কিন্তু গঙ্গাপারের একটা তাঁবুর সামনে শুধুই হতাশা। অন্ধকার আর অন্ধকার।
বাংলাদেশের ধানমন্ডির বিরুদ্ধে শিল্ড সেমিফাইনাল খেলতে নামার আগের দিনের প্রাক্টিস শেষে কার্যত হুঙ্কার দিচ্ছিলেন আর্মান্দো কোলাসো। “আরে ওদের সনি নর্ডির জন্য যদি আমাদের ভাবতে হয়, তা হলে তো আমাদের চিডি-মোগা নিয়েও ওদের ভাবতে হবে।” ইস্টবেঙ্গলের গোয়ান কোচের গলায় রোখ। করিম বেঞ্চারিফার সেই সুযোগই নেই। দক্ষিণ কলকাতার নামী আবাসনে তাঁর দলের অধিনায়ক ওডাফার মতোই শেষের দিন গুনছেন বাগান কোচ। দু’জনেই এখন কর্তাদের চক্ষুশূল। পরের মরসুমে ছাঁটাই হবেন মোটামুটি ঠিকই হয়ে গিয়েছে।
পঁচাত্তরে পাঁচ গোলে মোহনবাগানকে হারানোর পর এ রকমই ছারখার বাগান দেখেছিলেন কি? সল্টলেকের বাড়ি থেকে ফোনে প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “মনে আছে মোহনবাগান সদস্য-সমর্থকরা প্রচণ্ড মুষড়ে পড়েছিলেন তখন। কিন্তু তখনকার ক্লাব সচিব ধীরেন দে দুর্দান্ত নেতৃত্ব দিয়ে কোচ-ফুটবলারদের মানসিকতা বদলে দিতে পেরেছিলেন। সমাজের সব বাগানপ্রেমী বিশিষ্ট ও প্রবীণ মানুষকে তিনি ডেকেছিলেন মাঠে। সকাল-বিকেল ওঁরা আসতেন টিমকে উদ্বুদ্ধ করতে। কিন্তু এখন তো শুনি কেউ আসেনই না। বর্তমান সচিব শুনেছি অসুস্থ। বড়কর্তারা কেউ বিদেশে থাকেন, নয়তো ব্যবসা-রাজনীতি এ সবে ব্যস্ত। ক্লাবটাকে তো মস্তকহীন মনে হচ্ছে।”
শুধু কর্তারাই কি দায়ী? পেলে-ম্যাচের গৌরব অধ্যায় থেকে বাগান তাঁবুতে ত্রিমুকুট এনে দেওয়া কোচ পিকে জবাব, “নিশ্চয়ই। কোচ তো কর্তারাই নির্বাচন করেছেন। বিদেশি ফুটবলার-সহ পুরো টিমটাও। তাই দায়টাও কর্তাদের উপরই বর্তাবে। ধীরেন দে-র সময়ও বর্তেছিল। টুটুদের উপরও বর্তাবে। চার বছর ট্রফি নেই! এটা পাঁচ গোলের চেয়েও লজ্জা।”
প্রথম ভারতীয় দল হিসাবে শিল্ড চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল মোহনবাগান। স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতীয়দের উদ্বুদ্ধ করেছিল শিবদাস-বিজয়দাসদের জিতে আনা যে ঐতিহাসিক ট্রফি, বাগান তাঁবুতে সেটা ঢোকেনি গত এগারো বছর। আর ফাইনাল ওঠাসে-ও তো শেষ বার ২০১০-এ। ইস্টবেঙ্গল বা অন্য কোনও দল শিল্ড জিতেছেআর বাগান সমর্থকরা সেই দৃশ্যের দর্শক থেকেছেন চার বছর।
বাগানের চরমতম হতাশার অধ্যায়ে শিল্ডে ফের থাবা বসানোর জন্য মরিয়া ইস্টবেঙ্গল। গতবার তাদের হারিয়েই চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ইউনাইটেড। এ বার চিডি-অর্ণবদের পাখির চোখ ঐতিহ্যের ট্রফিতে। কোনও ফাঁকই সেখানে রাখতে চাইছেন না কোচ আর্মান্দো। সোমবার অনুশীলনে সেটপিস, উইং প্লে, পেনাল্টি শ্যুট আউট সব কিছুতেই শান দিয়েছেন। ওপারা চোটের জন্য অনুশীলনে আসছেন না? কুছ পরোয়া নেই! তিন বছর ধরে রাখা কোর টিম-এর ‘ট্র্যাক্টর’ চালিয়েই বাংলাদেশের ধানমন্ডিকে মাঠের বাইরে পাঠাতে চাইছেন সফলতম ভারতীয় ক্লাব কোচ। “ওদের ডিফেন্স খারাপ বলছেন? দেখবেন কাল হয়তো ভাল খেলে দেবে। তবে আমরাও তৈরি” ফেভারিট হয়েও সতর্ক মন্তব্য করলেন আর্মান্দো। কিন্তু মনের কথা তো মাঝে মধ্যে বেরিয়েই যায়। সেটা হলও। “মোহনবাগানকে হারানোর পর বাংলাদেশের টিমটা যা নাচানাচি করল, মনে হল চ্যাম্পিয়ন হয়ে গিয়েছে। আরে সে দিন তো ওরা জেতেই না। দেখা যাক কাল...।”
বিদেশি দলের বিরুদ্ধে ইস্টবেঙ্গলের সাফল্য চোখধাঁধানো। আজ শিল্ড ফাইনালে উঠলে সেই মুকুটে জুড়বে আরও এক সাফল্যের পালক। সম্ভবত সেই স্বপ্নেই বিভোর চিডি ক্লাবতাঁবুতে দাঁড়িয়ে বলে ফেলেন, “আমরা এএফসি কাপ সেমিফাইনাল খেলেছি। অভিজ্ঞতায় আমরা ওদের চেয়ে অনেক এগিয়ে। আমার আর মোগায় এখন যথেষ্ট বোঝাপড়া।” গলায় যথেষ্ট ঝাঁঝ।
এবং চিডিরা যখন স্বপ্নের সওদাগর হয়ে লাল-হলুদ সমর্থকদের আরও একটা ট্রফির দিকে ভেলা ভাসাতে উদ্বুদ্ধ করছেন, তখন কী করছেন বাগানের ওডাফা? ছুটছেন ফিজিও, ডাক্তার কাছে। ফিট হয়ে উঠতে। কর্তারা ঠিক করেছেন, যে কোনও দিন তাঁকে ডেকে চোটের ব্যাপারে জেরা করবেন।
সেটা করেও বা কী হবে? বাগানে অন্ধকার কাটানোর জন্য ওডাফাদের হাতে যে এখন আর কোনও আলো-ই নেই। আই লিগেও এত পিছিয়ে যে ট্রফির দাবিদার বলাও যাচ্ছে না। পিকে-ই হয়তো ঠিক বলেছেন “নৌকোয় অনেক ফুটো তৈরি হয়েছে গত চার বছরে। তাপ্পি মেরে লাভ নেই। পুরোটাই পাল্টাতে হবে!” |