মোহনবাগানে টানা চার বছর কোনও ফুটবল ট্রফি আসেনি বলে আমার আজীবনের ক্লাবের জন্য গভীর দুঃখবোধ হচ্ছে ঠিকই। তবে নানা মহলে যে রকম হাহুতাশ চলছে, তাদের দলে আমি নেই। মনে করে দেখুন, উনিশশো এগারোয় মোহনবাগানের সেই ঐতিহাসিক আইএফএ শিল্ড জয়ের পর ক্লাবের দ্বিতীয় সাফল্য ১৯৩৯-এ কলকাতা লিগ চ্যাম্পিয়ন হওয়া। মাঝের ২৮ বছর একটাও ট্রফি জেতেনি মোহনবাগান। যার মধ্যে ইস্টবেঙ্গল ট্রফি জিতেছে। মহমেডান জিতেছে। ব্রিটিশ মিলিটারি দলগুলো সে সময় ময়দানে থাকা সত্ত্বেও।
আসলে মোহনবাগানের বর্তমান মহাসঙ্কটের তাৎপর্যটা অন্য জায়গায়।
ক্লাবের দুই শীর্ষ কর্তা টুটু বসু আর অঞ্জন মিত্র-র প্রতি আমার পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেও বলছি, এ বার ওদের সময় এসেছে মোহনবাগান-প্রশাসনে নতুন রক্ত আনার। তরুণ প্রজন্মের হাতে ক্লাব পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়ার।
কেন?
আমার মতে খেলোয়াড়ের যেমন অবসরের একটা বয়স থাকে, সময় থাকে। প্লেয়ার যেমন আজীবন খেলে যেতে পারে না, তেমনই কর্মকর্তাদের রিটায়ারমেন্ট দরকার, একটা সময়ের পর, একটা বয়সের পর। যত দূর মনে পড়ছে, টুটু-অঞ্জন কুড়ি বছর হয়ে গেল মোহনবাগান চালাচ্ছে। নিজে প্রাক্তন ফুটবলার বলে জানি, খেলতে-খেলতে একটা সময়ের পরে খেলার প্রতি সেই আগের উৎসাহ থাকে না। শারীরিক সক্ষমতা বাধা হয়ে দাঁড়ায় ভাল খেলার ক্ষেত্রে। একই কথা ক্লাব অফিসিয়ালদের ক্ষেত্রেও খাটে। তাদেরও ক্লাবের দৈনন্দিন কাজ করতে-করতে একটা সময়ে একঘেয়েমি আসতে বাধ্য। আগের সেই উৎসাহ থাকে না। বয়স বেড়ে চলায় একটা সময়ের পরে শরীরও খাটাখাটুনির ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। |
টুটু-অঞ্জন কোনও সন্দেহ নেই মোহনবাগানের জন্য অনেক ভাল কাজ করেছে। অনেক ট্রফি জিতেছে। কিন্তু গত কয়েক বছর অঞ্জন অসুস্থ। প্রায় শয্যাশায়ী। ক্লাবের কার্যকরী কমিটির সভা পর্যন্ত ওর বাড়িতে ইদানীং করতে হচ্ছে। টুটুও মাঝেমধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়ে। তার মধ্যেই হয়তো এক-দু’দিন ক্লাবে এসে ফুটবলারদের ভোকাল টনিক-ফনিক দেয়, কিন্তু সেটাই যথেষ্ট নয়। মোহনবাগানের মতো বিরাট বাজেটের, মেগা টিমের সঠিক দেখভালের জন্য দরকার শীর্ষ কর্তাদেরও প্রতিদিন ক্লাবে আসা। প্রত্যেক ফুটবলারের কন্ডিশন সম্পর্কে আপডেট থাকা। প্লেয়ারদের সঙ্গে কোচের সম্পর্ক কেমন, তার খোঁজ রাখা। প্রয়োজনে ক্লাবের প্রাক্তন ফুটবলারদের নিয়ে টেকনিক্যাল কমিটি তৈরি করে তাদের বলা, তোমরা কোচকে সাহায্য করো।
যেগুলো আমার মতে টুটু-অঞ্জনের পক্ষে দু’দশক ক্লাব চালানোর পরে আর এখন ঠিকঠাক ভাবে করাটা সম্ভব হচ্ছে না। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ, নিজেদের অসুবিধের কারণে ওরা এই কাজগুলোর দায়িত্ব গত কয়েক বছর যাকে দিয়েছে, সে আমার মতে কোনও প্রশাসক নয়। ফলে মোহনবাগানে প্রশাসন আর ফুটবল টিমের মধ্যে সঠিক বোঝাপড়া নেই। মিশেল নেই।
যার ফলস্বরূপ টিমের সেরা অস্ত্র হওয়া সত্ত্বেও ওডাফা নতুন মরসুমের জন্য প্রি-সিজন ক্যাম্পে যথাসময়ে না এসে দিব্যি টুর্নামেন্ট শুরুর মাত্র কয়েক দিন আগে দলের সঙ্গে যোগ দেয়। দিয়ে পার পেয়েও যায়। কোনও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পর্যন্ত হয় না। যা দেখে অন্য প্লেয়াররাও ‘অন্যায় সাহস’ পেয়ে গেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু সব মিলিয়ে ভুগতে হয় মোহনবাগান দলটাকে। তুমি যত বড় ফুটবলারই হও না কেন, প্রি-সিজন কন্ডিশনিংয়ে ফাঁকি মারলে পরে ম্যাচ-সিচুয়েশনে নিজেই ভুগবে। সবার কাছে ধরা পড়ে যাবে। এক দিন ফিট থাকবে তো পরের দিন চোট লাগিয়ে বসবে। ওডাফার গত দু’মরসুমের চোটগুলো কিন্তু বেশির ভাগই মরসুম চলাকালীন প্র্যাকটিসে পাওয়া। মানে সঠিক প্রি-সিজন কন্ডিশনিং না করার ফল। ন্যূনতম ফিটনেস না থাকার জের। আর পুরো ফিট না থাকলে প্লেয়ার তার স্কিল দেখাবে কী করে?
শুধু স্ট্র্যাটেজি দিয়ে ফুটবল মাঠের যুদ্ধ জেতা যায় না। ৪-৪-২, ৪-৩-৩, ৪-৪-১-১এগুলো একেকটা অস্ত্র মাত্র। কিন্তু ফুটবল খেলাটার সব নয়। ফুটবলারের টাচ থাকলে তবেই তো স্ট্র্যাটেজি সফল হবে! এখনও মনে পড়ে, ফুটবলারজীবনে আমি বাড়িতেও সময় পেলেই টেনিস বল পায়ে নিয়ে নাচাতাম, ওই ছোট বলও কন্ট্রোলের চেষ্টা করতাম।
মোহনবাগান ক্লাবে পরিকাঠামোয় হয়তো আধুনিকতার অভাব আছে। কিন্তু একেবারেই কিছু নেই তা-ও নয়। আমাদের সময়ে সেটুকুও ছিল না। তাতেও ট্রফি জিততে অসুবিধে হয়নি ক্লাবের। আসল হল, ফুটবলার-কর্তা-পরিবেশ, তিনের সঠিক মিশেল। যে কোনও সোশ্যাল ক্লাবেও শীর্ষ কর্তাদের কেউ না কেউ রোজ ক্লাবে আসে। দৈনন্দিন কাজকর্মের খোঁজখবর রাখে। যে ব্যাপারটা স্পোর্টস ক্লাবে আরও বেশি দরকার।
মোহনবাগানে সে রকমই কর্মকর্তা দরকার। না হয় টুটু-অঞ্জনই নিজেরা সে রকম নতুন রক্ত, নতুন মুখ খুঁজে তাদের হাতে দায়িত্ব তুলে দিক। |