স্কুলের গণ্ডি ডিঙিয়েই সোহরাব আলি ধরে ফেলেছিলেন গুটখার নেশা। দিনে অন্তত ছ’থেকে সাত প্যাকেট! মাস কয়েক আগে ধরা পড়ল, ওঁর মুখে ক্যানসার!
দক্ষিণ কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন বছর পঁয়ত্রিশের যুবকটি। আবার গুড়াকু দিয়ে দাঁত মাজার অভ্যেস ছিল মালতীবালা ধরের। চিকিৎসকদের দাবি, ত্রিশ বছরের অভ্যেসটিই তাঁর কাল হয়েছে। মুখের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে গত সপ্তাহে কলকাতার এক মেডিক্যাল কলেজে মারা গিয়েছেন ওই প্রৌঢ়া।
সিগারেট ছাড়তে গিয়ে সুব্রত দাস বিকল্প করেছিলেন পানমশলাকে। সেটাই নেশা হয়ে দাঁড়ায়। আপাতত যুবকটি মুখের ক্যানসারে ভুগছেন। স্টেজ-থ্রি।
বিভিন্ন ক্যানসার হাসপাতালের সমীক্ষা অনুযায়ী, এ দেশে ক্যানসার-রোগীদের চল্লিশ ভাগের ক্ষেত্রে দায়ী হচ্ছে তামাক। পূর্বাঞ্চলের রোগীদের ৩৫%-৪০% মুখের ক্যানসারে আক্রান্ত। গুটখা-পানমশলা-গুড়াকুর মতো তামাকজাত নেশাদ্রব্যের বিক্রিতে অবিলম্বে রাশ না-টানলে বিপদমুক্তির উপায় নেই বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা। কিন্তু ঘটনা হল, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে কিছু রাজ্য গুটখা-পানমশলার উৎপাদন ও বিক্রি নিষিদ্ধ করলেও নিষেধাজ্ঞা রয়ে গিয়েছে স্রেফ কাগজে-কলমে। পশ্চিমবঙ্গেও তা-ই। অথচ গুটখা-পানমশলা থেকে মুখের ক্যানসারে আক্রান্তের সংখ্যা এ রাজ্যে যথেষ্ট। তথ্য বলছে, পশ্চিমবঙ্গে তামাক ব্যবহারকারীর সংখ্যা নয় নয় করে দু’কোটি। অর্থাৎ, প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার ৩৬%!
এ হেন পরিস্থিতির মোকাবিলায় এ বার খোদ মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হস্তক্ষেপ চাইলেন ক্যানসার-চিকিৎসকেরা। |
মোড়কে মরণ |
গুটখা কী?
সুপারি-চুন-প্যারাফিনের সঙ্গে তামাকের মিশ্রণ
ক্ষতিকর কেন?
প্রায় চার হাজার রাসায়নিকের মিশ্রণ। যাতে নাইট্রাসামিনস, আর্সেনিক, বেনজোপাইরিনের মতো ৪০টি কারসিনোজেনিক (ক্যানসারের ক্ষত সৃষ্টিকারী) পদার্থ উপস্থিত।
পানমশলা কী?
গুটখার সঙ্গে মেশানো রঙিন মিষ্টি মশলা। বিভিন্ন বীজ রং করে সেই মশলা তৈরি হয়।
ক্ষতিকর কেন?
নাইট্রাসামিনস, আর্সেনিক, বেনজোপাইরিনের মতো ৪০টি কারসিনোজেনিক পদার্থ তো আছেই, উপরন্তু ওই রং-ও কারসিনোজেনিক।
কী ক্ষতি হয়?
মুখগহ্বর, খাদ্যনালির ক্যানসার
গুটখা, পানমশলা কী ভাবে ক্যানসার ডাকে?
কারসিনোজেনিক বস্তুগুলি মুখগহ্বরে ক্ষতের সৃষ্টি করে। ক্রমাগত খেয়ে গেলে ক্ষত ক্রমশ বাড়তে থাকে। শেষে ক্যানসারের চেহারা নেয়।
|
|
রাজ্যে পূর্ণাঙ্গ তামাক-নীতি তৈরির লক্ষ্যে অবিলম্বে উদ্যোগী হওয়ার জন্য মুম্বই-কলকাতার ক্যানসার বিশেষজ্ঞদের এক প্রতিনিধিদল মুখ্যমন্ত্রীকে আর্জি জানিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে লেখা তাঁদের চিঠিটি শনিবার রাজ্যের স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের হাতে তুলে দেওয়া হয়। মুখ-ক্যানসারের আগ্রাসন ঠেকানোর ব্যাপারে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে সবিস্তার আলোচনা হয়েছে ওঁদের। প্রতিনিধিদলের প্রধান মুম্বইয় টাটা মেমোরিয়ালের মুখ-ক্যানসার বিভাগের সার্জিক্যাল অঙ্কোলজিস্ট পঙ্কজ চতুর্বেদীর কথায়, “গুটখা-পানমশলা বিক্রি বন্ধ করা কেন দরকার, আমরা মন্ত্রীকে বুঝিয়ে বলেছি। স্কুল-কলেজের সামনেও এগুলো ঢেলে বিকোচ্ছে। এটা ভীষণই উদ্বেগের।” সরকার কী করতে পারে?
চতুর্বেদী বলেন, “আমাদের পরামর্শ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার একটি তামাক-নীতি তৈরি করুক। পানমশলা-গুটখা বেচলে বা খেলে কঠোর শাস্তির সুপারিশ থাকবে যাতে। আমরা চাই, প্রকাশ্যে ধূমপান বন্ধের প্রসঙ্গটাও থাকুক।” জন-সচেতনতা বাড়াতে বিধায়কদের নিয়ে কর্মশালা আয়োজনেরও প্রস্তাব দিয়েছেন প্রতিনিধিরা। সব মিলিয়ে রাজ্যের মনোভাব তাঁদের কাছে সদর্থকই ঠেকেছে। কী বলছে সরকার?
চন্দ্রিমাদেবীর বক্তব্য, স্বাস্থ্য দফতরও খুব উদ্বিগ্ন। ওঁদের পরামর্শ গুরুত্ব দিয়ে বিচার করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য-কর্তারা জানিয়েছেন, কর্মশালার ব্যাপারে বিধানসভার স্পিকারের সঙ্গে কথা বলা হবে।
তবে আইন শুধু প্রণয়নই যে যথেষ্ট নয়, চিকিৎসক-বিশেষজ্ঞদের একাংশ তা মনে করিয়ে দিয়েছেন। ওঁদের বক্তব্য: আইন ঠিকঠাক কার্যকর না-হলে কাজের কাজ কিছু হবে না। এখন যেমন হচ্ছে না। বস্তুত বিভিন্ন রাজ্যে পানমশলা-গুটখা বিক্রি কিংবা প্রকাশ্য ধূমপানে নিষেধাজ্ঞা বলবৎ হলেও সারা দেশে তামাক-দ্রব্যের বিক্রির হার যে কমেনি, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ একাধিক বার তা কবুল করেছেন। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের কর্তারাও জানিয়েছেন, মুখ-ক্যানসারের দাপটের নিরিখে ভারত এখন বিশ্বে এক নম্বরে, আর ৯০% ক্ষেত্রে তার পিছনে রয়েছে গুটখা, জর্দা, বা খৈনির ভূমিকা। ‘কন্ট্রোল অফ টোব্যাকো প্রডাক্টস অ্যাক্ট’ মোতাবেক, গুটখা খেলে দু’শো টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। বেচলে ২৫ হাজার পর্যন্ত। নিয়ম না-মানলে ছ’মাসের জেলেরও বিধান রয়েছে। আইনটি প্রয়োগ করে এ রাজ্যে গত মে মাসে এক বছরের জন্য গুটখা নিষিদ্ধ হয়েছে ঠিকই। তবে কার্যত তা কথার কথা থেকে গিয়েছে। কলকাতার অলি-গলিতে দেদার বিকোচ্ছে গুটখা। একই ভাবে প্রকাশ্যে ধূমপান রুখতে ‘সিগারেটস অ্যান্ড আদার টোব্যাকো প্রডাক্টস অ্যাক্ট ২০০৩’-এর অন্তর্ভুক্ত ‘প্রহিবিশন অফ স্মোকিং ইন পাবলিক প্লেসেস রুল’ জারি হয় ২০০৮-এ। তাতে প্রকাশ্যে ধূমপানের জরিমানা দু’শো টাকা পর্যন্ত। ধূমপায়ী তো বটেই, যাঁর উপরে নজরদারির দায়িত্ব, তাঁকেও একই অঙ্কের জরিমানা গুণতে হবে। কিন্তু আইনটি প্রয়োগ কারা করবে, তা নিয়ে বিভিন্ন দফতরে চাপান-উতোর অব্যাহত।
পরিণামে রাস্তায়, অফিসে, যানবাহনে যথেচ্ছ উড়ছে বিড়ি-সিগারেটের ধোঁয়া। পঙ্কজ চতুর্বেদী জানান, আইন যাতে যথাযথ ভাবে প্রয়োগ হয়, সে জন্য তাঁরা রাজ্য পুলিশের ডিরেক্টর জেনারেলের সঙ্গেও কথা বলেছেন। প্রতিনিধিদলের অন্যতম সদস্য ক্যানসার সার্জন গৌতম মুখোপাধ্যায় বলেন, “যে বিষয়গুলোয় আমরা জোর দিয়েছি, তার অন্যতম হল সিগারেটের উপরে করবৃদ্ধি। আমরা চাই, করের হার হোক ন্যূনতম ৫০%। বেশ কিছু রাজ্য কর বাড়িয়েওছে। যেমন রাজস্থানে ৬৫%।”
এ ভাবে দাম বাড়িয়ে দিলে সিগারেট খাওয়া কিছুটা কমানো যাবে বলে গৌতমবাবুরা আশা করছেন। রাজ্যের স্বাস্থ্য-কর্তাদের আশ্বাস, বিষয়টি নিয়ে তাঁরা সংশ্লিষ্ট দফতরের সঙ্গে কথা বলবেন। |