|
|
|
|
রং-তুলির আঁতুড়ঘরে বাণীবন্দনা
কিংশুক গুপ্ত • শিলদা |
অনাহার-অপুষ্টিতে পাঁচ আদিবাসীর মৃত্যুর পর শিরোনামে এসেছিল বেলপাহাড়ির আমলাশোল গ্রাম। অথচ পাহাড়-জঙ্গল ঘেরা এই বেলপাহাড়ি ব্লকেই ছড়িয়ে ছিড়িয়ে রয়েছে নানা প্রতিভা। ‘পেটের টানে’ এমন কত প্রতিভার অপমৃত্যু ঘটে যায়। যার খবর কেউ রাখে না। ব্যক্তিগত উদ্যোগে গত তিন দশক ধরে শিল্প-সরস্বতীর আরাধনা করে চলেছেন বেলপাহাড়ির প্রবীণ শিল্পী ভগীরথ ঘর। বেলপাহাড়ি ব্লকের শিলদায় ভগীরথবাবুর বাড়িতেই ‘রং-তুলি’র আঁতুড়ঘর। সেখানে প্রতি বছর সরস্বতী পুজোকে ঘিরে তিন দিনের উৎসব!
এ বার শিলদায় ‘রং-তুলি’র কেন্দ্রে শিক্ষার্থীরা সাবুদানা ও মুসুরি ডাল দিয়ে অভিনব সরস্বতী প্রতিমা গড়েছেন। মঙ্গলবার সরস্বতী পুজোর দিন থেকে শুরু হচ্ছে তিন দিনের বার্ষিক উৎসব। সংস্থার শিক্ষার্থীদের আঁকা ও হাতে তৈরি পাঁচশোটি শিল্পকর্ম স্থান পেয়েছে প্রদর্শনীতে। মঙ্গলবার প্রদর্শনীর উদ্বোধন করবে ভগীরথবাবুর ছাত্র স্থানীয় দুঃস্থ কিশোর শিল্পী প্রকাশ সিংহ। প্রদর্শনীতে সংস্থার শিক্ষার্থীদের তৈরি বাংলার মাটির পট থেকে কোলাজে যামিনী রায়ের ছবি সবই দেখার মতো। |
শিলদায় ‘রং-তুলি’র কেন্দ্রে শিক্ষার্থীরা।—নিজস্ব চিত্র। |
ভগীরথবাবুর পারিবারিক পেশা চাষবাস। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই অঙ্কন প্রতিভায় পারদর্শী ভগীরথবাবু পারিবারিক প্রথা ভাঙেন। আশির দশকে কলকাতার ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজ থেকে ফাইন আর্টস্-এ স্নাতক হন কৃষক পরিবারের ভগীরথবাবু। তারপর বেলপাহাড়ির রুক্ষ মাটিতে শিল্পশিক্ষাকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন। তাঁর কথায়, “গ্রামগঞ্জে ঘোরার সুবাদে লক্ষ্য করেছি, বহু আদিবাসী-মূলবাসী ছেলেমেয়েদের মধ্যে প্রতিভা লুকিয়ে রয়েছে। কিন্তু তাদের সেই প্রতিভা বিকাশের কোনও সুযোগ নেই। আর্থিক সামর্থ্যও নেই। ব্যক্তিগত উদ্যোগে আমার ‘শিল্পের সংসার’। সেখানে ব্রাত্যজনেরা সব সময়েই স্বাগত। ওদের থেকে টাকা নিতে পারি না। তবে আমার উদ্যোগ সিন্ধুতে বিন্দুবৎ।” প্রতিভার অপমৃত্যু রোখার জন্য অসম লড়াই চালিয়ে যাওয়া ভগীরথবাবু স্বপ্ন দেখেন, হয়তো কোনও দিন এই ভূমিপুত্র-ভূমিকন্যাদের মধ্যেই কেউ হবে ভবিষ্যতের যামিনী রায় কিংবা শানু লাহিড়ি! শুধু স্বপ্নই নয়, ভগীরথবাবুর হাত ধরে এলাকার অনেকেই যে স্বনির্ভর হয়েছে তা মানছে প্রশাসনও। স্বপ্নের বাস্তবায়নের জন্য সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে চিঠি পাঠিয়ে ‘পেটের টানে প্রতিভার অপমৃত্যু রোখার’ আবেদন জানিয়েছেন ভগীরথবাবু। জঙ্গলমহলের প্রত্যন্ত এলাকার প্রতিভা সম্পন্ন কিশোর-কিশোরীদের শিল্পশিক্ষা ও চর্চার জন্য সরকারি উদ্যোগ নেওয়ার জন্য মুখ্যমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তিনি। ভগীরথবাবুর স্ত্রী অনিমা ঘরের কথায়, “স্বামীর এই উদ্যোগের ফলে আমাদের সংসারে টান পড়ে ঠিকই। কিন্তু এটাই ওনার ধ্যানজ্ঞান। আমরা এতেই খুশি।”
বেলপাহাড়ির বিডিও সর্বোদয় সাহা বলছেন, “ভগীরথবাবু পেশার বাইরেও শতাধিক দুঃস্থ কিশোর-কিশোরীদের নিখরচায় শিল্পশিক্ষা ও উৎসাহ দানের কাজটা নীরবে করে যান। ভগীরথবাবুর সাহায্যে ও উৎসাহে এলাকার অনেক দরিদ্র ছেলেমেয়ে শিল্পকে কেন্দ্র করে স্বনির্ভর ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। ভগীরথবাবুর বিষয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাব।”
‘রং-তুলি’র শিক্ষার্থী স্কুল পড়ুয়া পার্বতী হাঁসদা, দীনবন্ধু হাঁসদা, নচিকেতা মাহাতো, প্রকাশ সিংহ, লক্ষ্মণ সিংহ, কোজাগরী লাহা, তমাল গরাই, রবি সিংহদের পারিবারিক আর্থিক অবস্থা ভাল নয়। পার্বতী-দীনবন্ধুদের কথায়, “সারা বছর যা শিখি, তা প্রদর্শিত হয় সরস্বতী পুজোর সময়। মাস্টারমশাই আমাদের বলেন, শিল্পসৃষ্টির ফলে চেতনা বাড়ে। সৃষ্টির মাধ্যমে একজন শিল্পী সমৃদ্ধ হন। সব কথার মানে আমরা বুঝতে পারি না। তবে এটুকু বুঝি, ভাল ভাবে আঁকা শিখলে ভবিষ্যতে আমরাও নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারব।”
ভগীরথবাবুর প্রাক্তন শিক্ষার্থী বেলপাহাড়ির রাহুল অধিকারী এখন আঁকাকেই পেশা হিসেবে নিয়েছেন। রাহুলবাবুর কথায়, “দীর্ঘ কয়েক বছর আমি নিখরচায় ওনার কাছে আঁকা শিখেছি। সে সময় উল্টে উনি আমাকে হাতখরচও দিতেন। আমি কৃতজ্ঞ।” আর এক প্রাক্তন ছাত্র বিধুভূষণ হেমব্রম বর্ধমান আর্ট কলেজ থেকে স্নাতক হওয়ার পরে বর্তমানে খড়্গপুর গ্রামীণ এলাকার একটি স্কুলের অঙ্কন শিক্ষক। বিধুভূষণবাবুর কথায়, “মাস্টারমশাইয়ের ঋণ শোধ করতে পারব না। সাত বছর ওনার কাছে আঁকা শিখেছি। ওনার প্রেরণা ও সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছি।” প্রাক্তনীদের কাছে কোনও প্রত্যাশা করেন না ভগীরথবাবু। কেবল বলেন, “রং, তুলি, ক্যানভাসের টাকা জোগাড় করতে হিমসিম খাই। নবীনদের জন্য মাঝে মধ্যে এখানে সেখানে হাত পাততে হয়।”
বেলপাহাড়িতে শিল্প-সারস্বত সাধনায় ভগীরথের পাশে দাঁড়াক প্রশাসন, এটাই আর্জি বর্তমান ও প্রাক্তনীদের। |
|
|
|
|
|