বিজেপির প্যাঁচে বিল পাশ নিয়ে ঘোর সংশয়ে কংগ্রেস
মাত্র ১২ দিনের অধিবেশন। তার মধ্যেই বাজেট, রেল বাজেট ছাড়াও তেলঙ্গানা রাজ্য গঠন, সেবি আইন সংশোধন ও দুর্নীতি দমনের মতো রাজনৈতিক ও আর্থিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একগুচ্ছ বিল পাশ করাতে কংগ্রেস মরিয়া। কিন্তু বিরোধীরা তা ভেস্তে দেওয়ার যে কৌশল নিয়েছে, তার আঁচ পেয়ে চিন্তায় পড়েছেন কংগ্রেস নেতৃত্ব।
রাহুল গাঁধী চান লোকসভা ভোটের আগে সংসদে দুর্নীতি দমনের ৬টি বিল পাশ করিয়ে নিতে। তা সম্ভব না হলে অবশ্য অর্ডিন্যান্স জারির রাস্তা থাকবে। কিন্তু তেলঙ্গানা বিল পাশ না হলে তা নিয়ে অর্ডিন্যান্স জারি সম্ভব নয়। তাই এই বিলটিকে অগ্রাধিকারের তালিকায় উপরেই রেখেছে সরকার। আবার অর্থলগ্নি সংস্থাগুলিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পাশ করানো জরুরি সেবি সংক্রান্ত বিল। পশ্চিমবঙ্গ-সহ সারা দেশে অর্থলগ্নি সংস্থাগুলির বেআইনি কাজকর্মে রুখতে ও লগ্নিকারীদের স্বার্থ রক্ষায় সেবি যাতে কড়া ব্যবস্থা নিতে পারে, তার জন্য দু’বার অর্ডিন্যান্স জারি করা হয়েছে। কিন্তু সেবি আইন পাকাপাকি ভাবে সংশোধন করা যায়নি। মনমোহন সিংহ সরকার থাকতে থাকতে সেই বিল পাশ না হলে ফের সেবি আইনের ফাঁকফোকর বেরিয়ে পড়বে। নতুন করে অর্থলগ্নি সংস্থাগুলির জালিয়াতির মুখে পড়বেন সঞ্চয়কারীরা। তাই ভোট-অন-অ্যাকাউন্টের পরে সেবি বিলটিতেই বেশি গুরুত্ব দিতে চাইছে অর্থ মন্ত্রক।
অধিবেশন শুরু হচ্ছে পরশু। তার আগে আজ সর্বদল বৈঠকে বিজেপি জানিয়েছে, তারা বিল পাশে সহযোগিতাই করবে। তবে একই সঙ্গে বিরোধী নেত্রী সুষমা স্বরাজ অর্থবহ দু’টি ঘোষণা করেছেন:
• বিনা আলোচনায় কোনও বিল পাশ করানো চলবে না।
• বিজেপি কোনও সাংসদকে সাসপেন্ড করার বিরোধী।
কংগ্রেসের মতে এটা আসলে বিল পাশ রোখারই কৌশল। এতে কোনও বিলের বিরোধিতার দায় না নিয়েও তা পাশ করানো ঠেকাতে পারবে তারা। অন্য দলের সাংসদ হট্টগোল করে আলোচনা ভেস্তে দিলে পাশ করানো যাবে না কোনও বিল। আবার তাঁদের সাসপেন্ড করে বিলের পথ মসৃণ করতে গেলেও রুখে দাঁড়াবে বিজেপি। সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী কমলনাথ আজ সর্বদল বৈঠকের পরে সাংবাদিক বৈঠকে তাই বলেন, “পঞ্চদশ লোকসভায় এটা একটা নতুন কৌশল হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিজেপি সবেতেই প্রথমে সমর্থন জানানোর কথা বলছে। তার পর সংসদে কেউ গোল পাকালে তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সংসদ অচল করছে। এ ভাবে একের পর এক বিল পাশ আটকে দিচ্ছে তারা।”
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে দেখলে এই পঞ্চদশ লোকসভাতেই সব থেকে কম বিল পাশ হয়েছে মাত্র ১৬৫টি। এখনও বকেয়া বিলের সংখ্যা ১২৬। কমলনাথ আজ এই প্রসঙ্গ তুলেও বিজেপি-কে বেঁধেন। তাঁর বক্তব্য, এই ধারা গণতন্ত্রের পক্ষে ক্ষতিকর। আগামী লোকসভায় বা তার পরেও এমনটা চললে সংসদীয় ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়বে। সন্দেহ নেই সংসদ শুরু মুখে এটা একটা প্রচ্ছন্ন হুমকিও। কংগ্রেস সমঝে দিতে চাইছে, ভবিষ্যতে বিজেপি ক্ষমতায় এলে, এ ভাবে ভুগতে হতে পারে তাদেরও। তবে এই হুঁশিয়ারিতে যে বিজেপি বা অন্য বিরোধীরা এতটুকু জমি ছাড়বে না, সেটা কংগ্রেসের কাছে স্পষ্ট।
কংগ্রেস সূত্রের খবর, সবার আগে তেলঙ্গানা বিল পাশ করাতে তৎপর হবে সরকার। গোর্খাল্যান্ড প্রশ্ন মাথায় রেখে তৃণমূল নেতৃত্ব ঘোষিত ভাবেই অন্ধ্রপ্রদেশ ভাগের বিরোধী। যে কারণে তৃণমূলের লোকসভার মুখ্য সচেতক সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “সরকার অন্য বিষয় ছেড়ে আগে বাজেট পাশ করাক। তার পর না হয় দুর্নীতি দমনের বিলগুলি পাশ করাতে সচেষ্ট হোক।” বৈঠক থেকে বেরিয়ে সুদীপ এ-ও বলেন, “তৃণমূল সব রকম দুর্নীতির বিরুদ্ধে। তাই সরকারের বিলে সায় দিতে অসুবিধা নেই। কিন্তু কংগ্রেস কি এত দিন ঘুমোচ্ছিল?” সুষমা-সুদীপ ছাড়াও বিরোধী শিবিরের নেতারা আজ এ-ও বলেন, সংসদ রাহুলের কর্মসূচি পূরণের জায়গা নয়। ভোটের মুখে সংসদে স্রেফ অন্তর্বর্তী বাজেটই পাশ করানো উচিত। বিরোধীদের এই সুর দেখেই প্রমাদ গুনছেন কংগ্রেস নেতারা।
এ দিনের সর্বদল বৈঠকে চিদম্বরম সেবি আইন সংশোধনের বিলটি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলির সহযোগিতা চান। এই বিল নিয়ে রিপোর্ট তৈরির কাজই এখনও শেষ করে উঠতে পারেনি অর্থ মন্ত্রকের স্থায়ী কমিটি। বৈঠক শেষে চিদম্বরম বলেন, “দু’বার অর্ডিন্যান্স জারি করতে হয়েছে। আশা করি, কাল বা পরশু ওই রিপোর্ট জমা দেবে স্থায়ী কমিটি। তা হলে সংসদে এই বিলটি পাশ করা সম্ভব। অর্থলগ্নি সংস্থায় হাজার হাজার মানুষ টাকা রেখেছেন। কিন্তু সংস্থাগুলির উপর কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। আমরা ওই গরিব মানুষগুলির প্রতি অবিচার করছি। সেই কারণেই বিলটি পাশ হওয়া প্রয়োজন।”
সারদা-কাণ্ড নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য রাজনীতির চাপানউতোর আজ উঠে এসেছিল সর্বদল বৈঠকেও। সিপিএমের সীতারাম ইয়েচুরি জানান, তাঁরা ওই বিলকে সমর্থন করছেন। পশ্চিমবঙ্গে চিট ফান্ডের রমরমা রুখতে এই আইন দরকার। তৃণমূলের তরফে সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ও জানান, তাঁরাও এই বিলকে সমর্থন করছেন। কিন্তু একই সঙ্গে সুদীপ অভিযোগ করেন, গত ৩৪ বছরে বাম আমলেই এই অর্থলগ্নি সংস্থাগুলি ঘাঁটি গেড়ে বসেছে। তৃণমূল জমানাতেই প্রথম এর তদন্ত শুরু হয়েছে। গ্রেফতারিও হয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমানাতেই।
এই বিল পাশ না হলে কী সমস্যা হবে? অর্থ মন্ত্রক সূত্রের বক্তব্য, অর্ডিন্যান্সের মেয়াদ শেষ যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে সব লগ্নি সংস্থার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সেই মামলাগুলি নিয়ে সেবি আর এগোতে পারবে না। ফলে লগ্নিকারীদের ঠকিয়েও আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যাবে অর্থলগ্নি সংস্থাগুলি।
দেশের বেহাল অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে বিমা ক্ষেত্রে বিদেশি লগ্নির মাত্রা ২৬% থেকে ৪৯% করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এ জন্য বিমা বিলটিও এই অধিবেশনে পেশ করার পরিকল্পনা ছিল চিদম্বরমের। কিন্তু বিজেপি জানিয়ে দেয়, তারা এই বিল পাশ করাতে দেবে না। একই ভাবে অর্থ মন্ত্রকের কর্তারা মনে করছেন, প্রত্যক্ষ কর বিধি (ডিটিসি) ও পণ্য-পরিষেবা কর (জিএসটি) বিলও এই অধিবেশনে পেশ বা পাশ করানো সম্ভব হবে না।
আপাতত চলতি সমস্যা কী ভাবে মিটবে, তা নিয়েই চিন্তিত কংগ্রেস। অন্ধ্রপ্রদেশ বিধানসভা আজ রাজ্য পুনর্গঠন বিলটি কেন্দ্রের কাছে পাঠিয়েছে। কালই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রিগোষ্ঠী বৈঠকে বসবে এ নিয়ে। কিন্তু সীমান্ধ্রের ২৫ জন সাংসদ ইতিমধ্যেই সংসদে ওই বিল পাশ রোখার হুমকি দিয়েছেন। অন্ধ্রের মুখ্যমন্ত্রী কিরণকুমার রেড্ডিও তেলঙ্গানা বিলের বিরোধিতা করে কাল দিল্লিতে এসে রাজঘাট থেকে রাষ্ট্রপতি ভবন পর্যন্ত মিছিল করে যাবেন বলে ঘোষণা করেছেন। কংগ্রেস নেতাদের আশঙ্কা, অন্ধ্রের এই নেতারা সংসদে হট্টগোল করলে বিজেপি-ও তাতে ইন্ধন দেবে। আর হট্টগোলে বিনা আলোচনায় বিল পাশ করাতে না দেওয়ার কথা তো সুষমা জানিয়েই রেখেছেন।
এই পরিস্থিতিতে তেলঙ্গানা বিল নিয়ে কংগ্রেস নেতৃত্বের চিন্তিত হওয়াটা স্বাভাবিক। চিন্তার আর এক কারণ, অন্ধ্র বিধানসভায় খারিজ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও ভোটের মুখে সংসদে ওই রাজ্য ভাগের বিল আনা যায় কি না, সেই প্রশ্ন তুলে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেছেন এম এল শর্মা নামে এক আইনজীবী। শীর্ষ আদালত আবেদনটি গ্রহণ করেছে। ৮ তারিখ তার শুনানি।
বিরোধীদের একটা অংশ বলছেন, কংগ্রেসের চিন্তাটা আসলে ভান। আসলে তারা দু’টি খেলাই খেলছে। আদালতের হস্তক্ষেপে বিল আটকে গেলেও কংগ্রেস আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার কথা বলে সময় কিনতে পারবে। আবার রাজনৈতিক বিরোধিতায় তেলঙ্গানা বিল পাশ না হলে তারা বিজেপি-র ঘাড়ে দায় চাপিয়ে প্রচার করতে পারবে। দু’টি ক্ষেত্রেই কিরণকুমার রেড্ডি সীমান্ধ্রের আবেগ তুলে ধরে বাকি অন্ধ্রে কংগ্রেসের ভরাডুবি রুখতে যথাসম্ভব চেষ্টা চালাবেন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.