রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার সূত্র মেনেই প্রায় আড়াই দশক পরে সাবেক জনতা দলের দুই প্রাক্তন সঙ্গী মুলায়ম সিংহ যাদব ও এইচ ডি দেবগৌড়ার হাত ধরতে উদ্যোগী হয়েছেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী তথা জেডিইউ নেতা নীতীশ কুমার। পুরনো দলের এই দুই সমাজতান্ত্রিক অংশকে সঙ্গে টানার পাশাপাশি নবীন পট্টনায়কের বিজেডি, জয়ললিতার এডিএমকে এবং বামেদের মতো সমমনোভাবাপন্ন দলগুলিকে সঙ্গে নিয়ে আগামী লোকসভায় বিজেপি ও কংগ্রেস-বিরোধী একটি ‘প্রেসার ব্লক’ তৈরি করতে চান নীতীশ। দলগুলির সঙ্গে এই সমঝোতার উদ্যোগ প্রায় চূড়ান্ত হওয়ার মুখে বলে জানিয়েছেন তিনি নিজেই। আজ পটনায় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে নীতীশ জানান, আগামী ১০-১৫ দিনের মধ্যেই পুরো বিষয়টি চূড়ান্ত আকার নিতে চলেছে।
তৃণমূল নেত্রী তথা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ কয়েক মাস ধরেই বামেদের বাদ দিয়ে বিভিন্ন অ-কংগ্রেসি, অ-বিজেপি দলগুলিকে সঙ্গে নিয়ে একটি ‘ফেডারেল ব্লক’ তৈরির কথা বলছেন। গত কাল ব্রিগেডের জনসভাতেও তিনি জানিয়েছিলেন, বিভিন্ন রাজ্যের বন্ধু দলগুলিকে সঙ্গে নিয়ে একটি জোরদার ফ্রন্ট গড়ার চেষ্টা চালাবে তৃণমূল। দলীয় সূত্রেই ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছিল যে, মমতা যাঁদের পাশে নিতে চান, তাঁদের অন্যতম নীতীশ। যদিও আজ নিজের বক্তব্যে বা একটি দৈনিকে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে নীতীশ যে ভাবে বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন, তাতে তিনি যে বামেদের দিকেই বেশি ঝুঁকে, তা অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।
নীতীশ যে শেষ পর্যন্ত তাঁদের দিকে ঝুঁকবেন না, তা জানাই ছিল বলে আজ দাবি করেছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। দলের শীর্ষ নেতা মুকুল রায়ের ইঙ্গিত, ভোট-পরবর্তী পরিস্থিতিতে আসনপ্রাপ্তির নিরিখেই সব হিসেব চূড়ান্ত হবে। তাঁর কথায়, “আমাদের দিকেও কিছু লোক তো আসবে! ভোটের পরে কার কী আসন দাঁড়ায়, দেখা যাক।”
অন্য দিকে প্রত্যাশিত ভাবেই খুশি বাম শিবির। সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট গত কালও তৃতীয় কোনও ফ্রন্ট গড়ার কথা অস্বীকার করেছেন। তবে জেডিইউ-এর মতো দলের সঙ্গে সমঝোতার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে বলেই জানাচ্ছেন তাঁরা। সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, “তৃণমূল কখনও এনডিএ, কখনও ইউপিএ-র জোটে থেকেছে। এ রাজ্যে মাওবাদী থেকে এসইউসি, নানা দলের সঙ্গে সমঝোতা করেছে। সঙ্গী হিসেবে তাদের বিশ্বাস করা কঠিন!”
সাবেক জনতা দলের সমাজতান্ত্রিক অংশকে টানার এই উদ্যোগে নীতীশ কিন্তু সচেতন ভাবেই কংগ্রেসের দিকে ঝুঁকে থাকা আর এক প্রাক্তন সঙ্গী লালুপ্রসাদ যাদবের আরজেডি-কে সঙ্গে নিতে আগ্রহী নন। বিহার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত অনেকেই মনে করছেন, বিহারে বিজেপির সঙ্গ ছাড়ার পরে রাজ্য রাজনীতিতে কার্যত একা হয়ে পড়া নীতীশ এখন জাতীয় রাজনীতিতে ভেসে থাকতেই একাধিক আঞ্চলিত দলকে টানতে মরিয়া।
নীতীশের জোট গড়ার উদ্যোগ সামনে আসার পরেই বিষয়টি নিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে চর্চা শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রাথমিক ভাবে দুই প্রধান দল, বিজেপি ও কংগ্রেস রাজনীতির এই নতুন সম্ভাব্য সমীকরণকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে নারাজ। বিজেপি নেতা অরুণ জেটলির বক্তব্য, “এ সব ফ্রন্টের কোনও ভবিষ্যৎ নেই। কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকারের এক মাত্র বিকল্প হতে পারে বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট। বাকি আঞ্চলিক দলগুলির পক্ষে এক ছাতার তলায় আসা সম্ভব নয়।”
প্রাক্-ভোটপর্বে এই ধরনের কোনও ফ্রন্টের গুরুত্ব নেই বলে মনে করছেন কংগ্রেস নেতা দিগ্বিজয় সিংহ। তাঁর কথায়, “লোকসভা ভোটের আগে এ ধরনের ফ্রন্ট অর্থহীন।” তাঁর ব্যাখ্যা, “জাতীয় ফ্রন্টের কথা বলে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন নীতীশ। জাতীয় স্তরে মানুষ শুধু কংগ্রেস বা বিজেপিকেই বিকল্প হিসেবে দেখেন।” তবে ভোট পরবর্তী পরিস্থিতিতে এ ধরনের ফ্রন্টের গুরুত্ব অস্বীকার করতে পারছেন না কংগ্রেস নেতারা। দলীয় সূত্রের ইঙ্গিত, ভোটের পর পরিস্থিতি বুঝে বিজেপি-কে ঠেকাতে এ ধরনের ফ্রন্টকে সমর্থন দিতেও পারে কংগ্রেস।
কংগ্রেস এখন বিরোধিতা করলেও পরবর্তী কালে যে হিসেব বদলে যেতে পারে, সে সম্ভাবনার ইঙ্গিত মিলেছে নীতীশের কথাতেও। তাঁর কথায়, “প্রাথমিক ভাবে এটা একটা বোঝাপড়া। অকংগ্রেস এবং অবিজেপি একটি সমঝোতা গড়ে তোলা। পরে প্রয়োজন অনুযায়ী আমরা এটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি।”
বাম সূত্রে খবর, পুরনো জনতা দলের পরিবারের নেতাদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় বসবেন বাম নেতৃত্ব। সিপিএম কেন্দ্রীয় কমিটির এক প্রবীণ সদস্যের কথায়, “কোনও তৃতীয় ফ্রন্ট গঠনে যে আমরা থাকব না তা আমাদের দলের সিদ্ধান্ত। কিন্তু আঞ্চলিক দলগুলির সঙ্গে সমঝোতা গড়ে তুলে অসাম্প্রদায়িক এক শক্তি গঠনই এর মূল লক্ষ্য।” এই জোটে অসম গণ পরিষদ, এবং অন্ধ্রের জগন্মোহন রেড্ডির দলকেও রাখার কথা চলছে বলে সিপিএমের এক শীর্ষ নেতা জানান। |