|
|
|
|
শিল্পের আকালে নেই দুর্নীতিও, আপ-তালিকায় গরহাজির রাজ্য
নিজস্ব সংবাদদাতা • নয়াদিল্লি
৩১ জানুয়ারি |
ঠাঁই হয়নি পশ্চিমবঙ্গের।
লোকসভা ভোটের প্রচারে নেমে শুক্রবার তাঁদের মতে দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের একটি তালিকা প্রকাশ করেছেন আম আদমি পার্টির নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল। উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম সেই তালিকা ছুঁয়ে গিয়েছে প্রায় গোটা দেশকেই। অধিকাংশ বড় রাজ্যের এক বা একাধিক নেতার নাম করে যখন লোকসভা ভোটে তাঁদের বিরুদ্ধে প্রার্থী দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী, তখন সেই কালো তালিকায় উল্লেখযোগ্য ভাবে অনুপস্থিত পশ্চিমবঙ্গ।
এটা ঠিক যে, কেজরিওয়াল জানিয়ে দিয়েছেন এই তালিকা চূড়ান্ত নয়। দিনে কালে আরও নাম তাঁরা প্রকাশ করবেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের কোনও নেতার বিরুদ্ধে ভোটে লড়ার পরিকল্পনা যে প্রাথমিক ভাবে তাঁদের নেই, সে কথা ইতিমধ্যেই কবুল করছেন আপ-এর শীর্ষ নেতারা।
অথচ দুর্নীতি নিয়ে এ রাজ্যের ডান-বাম দুই শিবিরের নেতাদের পারস্পরিক কাদা ছোড়াছুড়ি তো নেহাত কম নয়। সাড়ে তিন দশকের বাম রাজত্ব দুর্নীতির আঁতুড়ঘর অভিযোগ তৃণমূলের। বামেদের পাল্টা অভিযোগ, আড়াই বছরেই দুর্নীতির যাবতীয় নজির ছাপিয়ে গিয়েছে নতুন শাসক দল। তা হলে কেজরিওয়ালের দুর্নীতি-তালিকায় এ রাজ্যের কোনও নেতার কপালে শিকে ছিঁড়ল না কেন? |
|
হকারদের দরবারে অরবিন্দ কেজরিওয়াল। শুক্রবার নয়াদিল্লির যন্তর মন্তরে। ছবি: পিটিআই। |
যে তালিকায় জ্বলজ্বল করেছেন সুরেশ কলমডী থেকে আন্দিমুথু রাজা, মায়াবতী থেকে মুলায়ম সিংহ যাদব, এমনকী জনতার দাবিতে যাতে ঠাঁই হয়েছে রাহুল গাঁধী, নরেন্দ্র মোদীরও সেখানে কেন ডাহা ফেল করলেন রাজ্যের তাবড় নেতা-মন্ত্রীরা!
শিল্প-শিক্ষা-স্বাস্থ্য প্রায় সব ক্ষেত্রেই পিছিয়ে থাকা পশ্চিমবঙ্গ দুর্নীতিতেও ব্যাক বেঞ্চার!
“এটা তো ঠিক যে, উত্তর বা দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে নেতা-মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে যে ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে, সে তুলনায় এ রাজ্য স্বর্গ” মন্তব্য রাজ্যের এক প্রবীণ রাজনীতিকের। উত্তরপ্রদেশের দুই প্রধান প্রতিপক্ষ মায়াবতী এবং মুলায়মের বিরুদ্ধে আয়ের সঙ্গে সঙ্গতি বহির্ভূত সম্পত্তির মামলা চলেছে দীর্ঘদিন। একই রকম মামলা চলেছে তামিলনাড়ুর দুই প্রতিপক্ষ জয়ললিতা এবং করুণানিধির বিরুদ্ধে। স্পেকট্রাম দুর্নীতির মামলায় জেল ঘোরা হয়ে গিয়েছে করুণানিধির মেয়ে কানিমোঝির। সম্পত্তি সংক্রান্ত দুর্নীতি মামলায় জেলে কাটিয়েছেন অন্ধ্রপ্রদেশের প্রয়াত কংগ্রেস মুখ্যমন্ত্রী ওয়াই এস আর রেড্ডির ছেলে জগন্মোহন। আর পশুখাদ্য কেলেঙ্কারি মামলায় একটি আদালত তো লালুপ্রসাদকে দোষীই সাব্যস্ত করেছে।
এ রাজ্যের বড় মাপের কোনও নেতার নামে এমন দুর্নীতির অভিযোগ নেই বললেই চলে। কংগ্রেস আমলে প্রফুল্লচন্দ্র সেন-অতুল্য ঘোষেদের বিরুদ্ধে স্টিফেন হাউস কিনে নেওয়ার অভিযোগ তুলেছিল বামেরা। পরে ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল তাদের। রাজনৈতিক দাপট যতই থাক, গাঁধীবাদী দুই নেতারই ব্যক্তিগত জীবন ছিল অনাড়ম্বর।
রাজনীতির প্রশ্নে কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের যতই নিন্দেমন্দ হোক, তাঁর ব্যক্তিগত সততা নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি। নিজের মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠামাত্র ওয়াঞ্চু কমিশন গঠন করে সমালোচকদের মুখ বন্ধ করেছিলেন সিদ্ধার্থবাবু।
বাম আমলের দুই মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু এবং বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির বিশেষ কোনও অভিযোগ নেই। জ্যোতিবাবুর বিরুদ্ধে এক সময় বেঙ্গল ল্যাম্প কেলেঙ্কারি তথা পুত্র চন্দনের স্বার্থ দেখার অভিযোগ উঠেছিল। কিন্তু শেষ বিচারে তা তেমন ধোপে টেকেনি। আর বুদ্ধবাবুর ব্যক্তিগত সততা নিয়ে তো তাঁর অতি বড় শত্রুর মনেও বিশেষ সন্দেহ নেই।
একই কথা বলা চলে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে। পরনে মামুলি সাদা শাড়ি, পায়ে হাওয়াই চটি, বাড়িটাও টালির চালের। মমতার জীবনযাত্রা আগাগোড়াই সাদামাঠা। তৃণমূল নেতা ডেরেক ও’ব্রায়েনের দাবি, “তালিকার কথা জানি না। তবে সততা ও স্বচ্ছতার নিরিখে তৃণমূল নেত্রী যে প্রথম স্থানে থাকবেন সে কথা হলফ করে বলতে পারি।” আর বাম নেতারা? “বাকি দলের নেতাদের কথা বলতে পারব না”, মন্তব্য ডেরেকের।
সিপিএম অবশ্য তৃণমূলকে চিমটি কাটার সুযোগ ছাড়তে নারাজ। দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নীলোৎপল বসুর মন্তব্য, “কেজরিওয়াল বোধহয় সারদা কেলেঙ্কারির বিষয়টা জেনে ওঠার সুযোগ পাননি।” এই কেলেঙ্কারিতে দলীয় সাংসদ (এখন বহিষ্কৃত) কুণাল ঘোষের গ্রেফতার হওয়াটা তৃণমূলের পক্ষে সামান্য হলেও অস্বস্তির। তা ছাড়া, শাসক দলের স্থানীয় নেতাদের জোরজবরদস্তি নিয়ে যে অভিযোগ বাম আমলে ছিল, তৃণমূল আমলেও তা থেকে গিয়েছে। ছোট-মাঝারি শিল্পপতিদের অনেকের অভিযোগ, আগে এক জায়গায় টাকা দিয়ে রেহাই পাওয়া যেত। এখন দিতে হয় একাধিক স্থানীয় নেতাকে। |
অরবিন্দের ফর্দনামা |
রাহুল গাঁধী |
নরেন্দ্র মোদী |
মায়াবতী |
সুরেশ কলমডী |
সুশীলকুমার শিন্দে |
প্রফুল্ল পটেল |
বি এস ইয়েদুরাপ্পা |
অনন্ত কুমার |
বীরাপ্পা মইলি |
পি চিদম্বরম |
আলাগিরি |
কানিমোঝি |
সলমন খুরশিদ |
এ রাজা |
কপিল সিব্বল |
মুলায়ম সিংহ |
পবন বনসল |
ফারুক আবদুল্লা |
নবীন জিন্দল |
তরুণ গগৈ |
|
কিন্তু সে সব সত্ত্বেও এ রাজ্যে দুর্নীতি কখনওই এমন লাগামছাড়া আকার নেয়নি, যা শাসক দলের বিরুদ্ধে বড় মাপের অস্ত্র হতে পারে। “এটা তো ঠিক যে, মায়াবতী, মুলায়মরা যখন কেন্দ্রীয় সরকারকে সমর্থনের বিনিময়ে তাঁদের বিরুদ্ধে চলা দুর্নীতির মামলা লঘু করা নিয়ে দর কষাকষি করেন, তখন মমতা দর কষাকষি করতেন রাজ্যের প্রাপ্য আদায় করতে। তৃণমূলের বিরুদ্ধে সিবিআই-জুজুর অস্ত্র কোনও দিনই প্রয়োগ করতে পারেনি কেন্দ্রের কোনও সরকারই।” মনে করাচ্ছেন এক তৃণমূল নেতা।
এখন প্রশ্ন হল, পশ্চিমবঙ্গে দুর্নীতি কম কেন? জলহাওয়ার গুণে, না অন্য কোনও কারণে। অনেকের বিশ্লেষণ রাজ্যে শিল্প বন্ধ্যা, তাই দুর্নীতির গাঙেও জোয়ার নেই। তাঁদের মতে, শিল্প প্রকল্পের বরাত বা ছাড়পত্র দেওয়াই হল দুর্নীতির সবচেয়ে বড় আঁতুড়ঘর। পশ্চিমবঙ্গে বহু দিন ধরেই বড় মাপের কোনও শিল্প নেই। ফলে নেই বড় মাপের দুর্নীতিও। কয়েক বছর আগে রাজ্যের এক সাংবাদিকের সঙ্গে ঘরোয়া আলোচনায় মহারাষ্ট্রের এক সর্বভারতীয় বিজেপি নেতা সহাস্যে বলেছিলেন, “আপনাদের রাজ্যে কেউ টাকা নেয় না, কাজও হয় না। আমাদের এখানে টাকা নেয়, কাজও হয়।”
রাজ্যে যদি বিপুল পরিমাণ খনিজ সম্পদ থাকে, তা হলেও তৈরি হয় দুর্নীতির সম্ভাবনা। যেমনটা হয় কর্নাটক বা ঝাড়খণ্ডে। বেআইনি ভাবে লৌহ আকরিক উত্তোলনকে মদত দেওয়ার
অভিযোগ উঠেছিল খোদ কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী বি এস ইয়েদুরাপ্পার বিরুদ্ধে। বিজেপি তাঁকে ইস্তফা দিতে বাধ্য করে। তার পরিণতি রাজ্য বিজেপিতে ভাঙন। এবং পরের ভোটে দক্ষিণের একমাত্র রাজ্য বিজেপি-র হাতছাড়া হওয়া। পশ্চিমবঙ্গে তো কয়লা ছাড়া খনিজ সম্পদ তেমন কিছু নেই।
বড় দুর্নীতি হতে পারে জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রেও। উত্তরপ্রদেশে তাজ করিডোর ঘিরে যে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল মায়াবতীর বিরুদ্ধে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে বড় শিল্প নেই বলে বড় মাপের জমি অধিগ্রহণও নেই। আর সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের পরে জমি অধিগ্রহণই তো শিকেয়।
সুতরাং দুর্নীতিগ্রস্ত তকমা দেগে নেতা-মন্ত্রী-মুখ্যমন্ত্রীদের যে তালিকা অরবিন্দ প্রকাশ করেছেন, তাতে ঠাঁই হয়নি পশ্চিমবঙ্গের কোনও নেতার। কেন্দ্রের প্রবীণ রাজনীতিকের সরস মন্তব্য, “পশ্চিমবঙ্গের কোনও নেতার বিরুদ্ধেই কখনও কোটি কোটি টাকা কেলেঙ্কারির অভিযোগ ওঠেনি। দুর্নীতিতেও আপনারা বহু পিছনে!” |
|
|
|
|
|