মেয়েটি রয়েছে ফিমেল জেনারেল ওয়ার্ডের সাধারণ বেডে। পাশের বেডে তার মা। ঘরভর্তি রোগিনীদের মধ্যে ওদের আড়াল করার চেষ্টা হয়েছে সবুজ কাপড়ের পর্দা-লাগানো স্ট্যান্ড দিয়ে। তবু পুলিশ-পাহারার বহরই জানান দিচ্ছে মেয়েটির অবস্থান। বেডের পাশেও মোতায়েন মহিলা পুলিশ। প্রায় মাথা অবধি কম্বলে মুড়ে নিজেকে লুকিয়ে শুয়ে আছেন লাভপুরের তরুণী।
বেলা যখন পড়ে এসেছে, তখন আসেন আদিবাসী সমাজের পাঁচজন মহিলা। গায়ে হাত দিয়ে শুধোন, “চেত্ লিকা মিনাঃ মিয়া (তুমি কেমন আছ)? মুখ থেকে কম্বল সরান তরুণীটি। প্রথমেই ব্যাকুল স্বরে জানতে চান, তাঁর পুরুষ সঙ্গী কেমন আছে। এখনও কি তাঁকে পিঠমোড়া করে বেঁধে রেখেছে গ্রামের লোকেরা?
বীরভূম আদিবাসী গাঁওতা-র প্রতিনিধি ওই মেয়েরা তরুণীকে আশ্বস্ত করেন। ওদের পেয়ে তরুণী খানিকটা উজ্জীবিত। ওদের একজনকে বললেন, “দু’টো জামা দিতে পারো?” বুধবার এক কাপড়ে থানায় চলে গিয়েছিলেন, সেখান থেকেই এসেছেন সিউড়ি জেলা হাসপাতালের বেডে। অবস্থা বুঝে হাসপাতালের নার্সরা পুরনো একটি সালোয়ার কামিজ এনে দিয়েছেন। সেটাই এখন পরে রয়েছেন। |
নিজের গ্রামে আর ফিরতে পারবেন কিনা, সে বিষয়েও ওই মহিলাদের কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করেন নির্যাতিতা তরুণী। তাঁর আশঙ্কা অবশ্য অমূলক নয়। এ দিনই সুবলপুরে একটি সরকারি প্রতিনিধিদল গিয়েছিল। ওই দলের সদস্য অশোকেন্দু সেনগুপ্ত বলেন, “গ্রামবাসীদের একাংশ তাঁদের জানিয়ে দেন, ওই তরুণী বা তাঁর পরিবারকে গ্রামে ঢুকতে দেবেন না।” পাশের গ্রামে স্ত্রীকে নিয়ে আলাদা সংসার করা তরুণীর ছোট ভাই এ দিন বলেন, “গ্রামের লোকেরা ফতোয়া জারি করেছে দিদি আর মাকে বাড়ি ঢুকতে দেবে না। কী যে হবে, ভাবতে পারছি না।” এ দিন রাতে হাসপাতালে মেয়েটির সঙ্গে দেখা করেন নারী ও শিশু কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী শশী পাঁজা। তাঁর সঙ্গে ছিলেন জেলাশাসক জগদীশপ্রসাদ মিনা এবং বিধায়ক মনিরুল ইসলাম। শশী পাঁজা মেয়েটির নিরাপত্তার প্রসঙ্গে বলেন, “ওই তরুণী প্রাপ্তবয়স্ক। ও যা চাইবে, সেই অনুযায়ী রাজ্য সরকার ব্যবস্থা নেবে।” মেয়েটি এখন অনেকটাই সুস্থ, জানান তিনি। আজ, শনিবার, তিনি আবার ওই তরুণীর সঙ্গে দেখা করবেন বলে জানিয়েছেন। |
এ দিন ধামসা বাজিয়ে দুপুর ১টা নাগাদ আদিবাসী গাঁওতার মহিলা সংগঠনের প্রায় ৩০০ সদস্য ডিএসপি(ডি অ্যান্ড টি) সুমিত চট্টোপাধ্যায়কে স্মারকলিপি দেন। লাভপুর-সহ জেলার বিভিন্ন প্রান্তের আদিবাসী মহিলারা ছিলেন ওই মিছিলে। মহম্মদবাজার এলাকার ভাঁড়কাটা পঞ্চায়েত সদস্যা মানি হেমব্রম বলেন, “আমাদের সমাজের একটি মেয়ের সঙ্গে যে নিষ্ঠুর ঘটনাটি ঘটল, তা মেনে নেওয়া যায় না। দোষীদের শাস্তি দিতে হবে।” মিছিল শেষে হাসপাতাল সুপারের অনুমতি নিয়ে পাঁচ জন নির্যাতিতার সঙ্গে দেখা করেন। পরে তাঁরা জানান, সেই রাতে গণধর্ষণ হয়েছিল বলেই জানিয়েছেন ওই তরুণী। কিন্তু কতজন তাঁকে নিপীড়ন করেছেন, অচৈতন্য হয়ে পড়ায় সেটা জানাতে পারেননি।
লাভপুর গণনির্যাতন কাণ্ডের বিহিত চাইছেন বীরভূম আদিবাসী গাঁওতার নেতারাও। গাঁওতার সম্পাদক রবিন সোরেন বলেন, “এমন যাতে আর না হয়, তার জন্য মাঝি হাড়ামদের নিয়ে একটি বৈঠকের সিদ্ধন্ত নেওয়া হয়েছে। সেখানে স্পষ্ট ভাবে জানানো হবে, যে মাঝি হাড়াম এই নিদান দিয়েছেন, তাঁকে আমাদের সমাজ থেকে বয়কট করা হবে।” |
সামাজিক ভাবে এই ঘটনার মোকাবিলা করতে চাইলেও, সুবলপুরের ঘটনার পিছনে রাজনৈতিক ইন্ধনের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছে না গাঁওতা। গাঁওতার লাভপুর শাখার সভাপতি তারো হেমব্রম বলেন, “সালিশি সভায় আগাগোড়া হাজির ছিলেন লঙ্গর সোরেন। তিনি সিপিএম করেন, পঞ্চায়েত সমিতির প্রাক্তন সদস্য। সালিশি চলাকালীন তিনি কোনও উচ্চবাচ্য করেননি।” তারো হেমব্রমের দাবি, লঙ্গরের সাহায্যেই গণধর্ষণের মতো একটি গুরুতর অভিযোগ ওই তরুণী পুলিশে অভিযোগ দায়ের করিয়েছেন। এটাকে “ঘোলাজলে মাছ ধরার চেষ্টা” বলেন মনে করছে গাঁওতা। লঙ্গর সোরেন অবশ্য বলেন, “আমার কোনও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই। আদিবাসী সমাজের একজন প্রতিনিধি হিসেবে ডাকা হয়েছিল বলেই গিয়েছিলাম, রাজনৈতিক প্রতিনিধি হিসেবে যাইনি।”
গাঁওতার দাবিকে খারিজ করে বিরোধী রাজনৈতিক মহলের বক্তব্য, তৃণমূল বিধায়ক মনিরুল ইসলামের ‘সবুজ সঙ্কেত’ না পেলেই বরং থানা অভিযোগ নিতে চায় না। ওই তরুণী সিপিএমের সহায়তা নিয়ে অভিযোগ দায়ের করেছেন, এ কথা বিশ্বাসযোগ্য নয়। বিরোধীদের একাংশের মতে, সালিশি সভায় যাঁরা জরিমানা করেছেন, তাঁদের একাংশ তৃণমূল। যে যুবককে জরিমানা করা হয়েছে, তিনিও তৃণমূল সমর্থক হিসেবেই পরিচিত। তাই তৃণমূলের তরফেও বিষয়টি নিয়ে উচ্চবাচ্য করা হচ্ছে না।
এ দিন রাজ্য কংগ্রেসের মহিলা সভানেত্রী কবিতা রহমান-সহ ১০-১২ জনের দল হাসপাতালে যান। সুপার অসিত বিশ্বাস তাঁদের জানান, মেয়েটির অবস্থা স্থিতিশীল। তবে মানসিক ভাবে এখনও দুর্বল। মনোবিদদের পরামর্শ মতোই পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। আরও একটু সুস্থ হয়ে উঠলে তাঁকে হোমে পাঠানোর চিন্তা ভাবনা চলছে বলেও তিনি জানান। আগামী রবিবার সূর্যকান্ত মিশ্রের নেতৃত্বে বাম প্রতিনিধি দল সুবলপুর যাবে।
|
সহ-প্রতিবেদন: অর্ঘ্য ঘোষ। |