|
|
|
|
দায় চেপেছে, তাই বাসের দখলও নেবে রাজ্য
অত্রি মিত্র • কলকাতা |
ঋণ শোধের দায় যখন ঘুরে এসে নিজের ঘাড়ে চেপেছে, তখন ঋণের টাকায় কেনা সম্পত্তির দখলও নিজের হাতেই রাখতে চাইছে সরকার।
সম্পত্তি মানে জওহরলাল নেহরু ন্যাশনাল আরবান রিনিউয়াল মিশন (জেএনএনইউআরএম) প্রকল্পের আধুনিক বাসের বহর। যা কিনতে রাজ্য সরকার দেনা করেছিল ব্যাঙ্ক থেকে। চালানোর জন্য বাসগুলি বেসরকারি মালিকদের দেওয়া হয়। কথা ছিল, মাসে মাসে ঋণের কিস্তি মেটাবেন মালিকেরা। কিন্তু অর্থাভাবে অধিকাংশ মালিক বাস রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারছেন না। তাই বহু বাস লজঝরে হয়ে পড়ছে। উপরন্তু কিস্তির টাকাও মিলছে না। ফলে সুদ-সহ দেনা শোধের পুরো দায় এসে পড়েছে রাজ্যেরই ঘাড়ে।
এমতাবস্থায় রাজ্য পরিবহণ দফতর জেএনএনইউআরএমের জরাজীর্ণ সমস্ত বাসের দখল নিয়ে নিচ্ছে। স্থির হয়েছে, বেসরকারি হাতে জেএনএনইউআরএমের যে ৪৯৬টি বাস রয়েছে, সেগুলো নিয়ে সরকারের বিভিন্ন পরিবহণ নিগমের অধীনে চালানো হবে। “মালিকেরা দেনা শুধছেন না। এই খাতে সুদ-সহ ঋণের অঙ্ক বেড়ে হয়েছে ৪৫ কোটি টাকা। রাজ্যকেই যখন তা মেটাতে হবে, তখন বাসের মালিকানা দফতরের হাতেই থাকা উচিত।” যুক্তি এক পরিবহণ-কর্তার।
এ হেন সিদ্ধান্ত ঘিরে কিছু প্রশ্নও উঠছে। কী রকম?
পরিবহণ দফতরের একাংশের মতে, রাজ্যের সব ক’টি পরিবহণ নিগম এমনিতেই ধুঁকছে। বাড়তি কর্মী ছেঁটে, ভর্তুকি বন্ধ করে সময়োপযোগী পরিচালন ব্যবস্থার সাহায্যে তাদের কিছুটা চাঙ্গা করার পরিকল্পনা হয়েছে, যা এ মাসের শেষে কার্যকর হওয়ার কথা। ঠিক এই মুহূর্তে লজঝরে প্রায় পাঁচশো বাসের বোঝা নিগমের ঘাড়ে চাপানোর যৌক্তিকতা সম্পর্কে সন্দিহান পরিবহণ-অফিসারদের বড় অংশ। তাঁদের আশঙ্কা, দীর্ঘ দিন গ্যারাজে ফেলে রাখা রুগ্ণ ওই সব বাস সারিয়ে-সুরিয়ে রাস্তায় নামাতে যত খরচ হবে, তাতে নিগমগুলো আরও দেউলিয়া হয়ে যাবে।
পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র অবশ্য এমন আশঙ্কায় আমল দিচ্ছেন না। |
|
তাঁর ব্যাখ্যা, “মালিকেরা তো বাসগুলো বসিয়েই রেখে দিয়েছেন। এ দিকে আমাদের বাস দরকার। তাই আমরাই চালাব।” কিন্তু মেরামতির টাকা কোথায়?
এতেও কর্ণপাত করতে নারাজ পরিবহণমন্ত্রী। “এটা কোনও সমস্যাই নয়।” প্রত্যয়ী মন্তব্য তাঁর। দফতরের এক কর্তা বলেন, “মালিকেরা বাস নিয়ে আর টাকা দিচ্ছেন না! এ তো দিনের পর দিন চলতে পারে না! একটা কোথাও দাঁড়ি টানতে হবে। প্রয়োজনে সরকার চালাবে। বাস চললেও তো কিছুটা আয় হবে!” ২০০৯-এর সেপ্টেম্বর থেকে ২০১০-এর এপ্রিল পর্যন্ত বেসরকারি মালিকদের হাতে ৪৯৬টি বাস তুলে দেওয়ার বছর দেড়েকও পেরোয়নি, মালিকদের তরফে কিস্তির টাকা আসার হার কমতে শুরু করেছিল। গত এক বছর ইস্তক পুরোপুরি বন্ধ।
দেনা শুধতে মালিকদের এই অনীহা কেন?
বাস-মালিকেরা আঙুল তুলেছেন সরকারের ভাড়া-নীতির দিকেই। ওঁদের বক্তব্য: বাসের ভাড়া বাড়ছে না, অথচ জ্বালানি-যন্ত্রাংশের দাম হু-হু করে বাড়ছে। তার উপরে আধুনিক বাসের যন্ত্রাংশের দাম বেশি। এমতাবস্থায় বাস চালিয়ে লোকসান করার চেয়ে বসিয়ে রাখাই শ্রেয় মনে করছেন অধিকাংশ মালিকা। সমস্যার সুরাহা করতে সরকার দফায় দফায় মালিকদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছে। মন্ত্রী হুমকি দিয়েছেন। কোনও লাভ হয়নি। কিস্তির টাকা আসেনি। পরিণামে বকেয়ার বহর বাড়তে বাড়তে এখন আকাশচুম্বী।
অতএব, বাস নিয়ে নিজেই চালানোর সিদ্ধান্ত সরকারের। যা শুনে বেসরকারি মালিকদের অনেকে যারপরনাই বিস্মিত। তাঁদের মতে, এতে রুগ্ণ নিগমের ঘাড়ে বাড়তি বোঝা চাপানো ছাড়া কাজের কাজ কিছু হবে না। “পরিবহণশিল্প এমনিতেই উঠে যাওয়ার জোগাড়। আরও তাড়াতাড়ি উঠে যাবে।” বলছেন বেঙ্গল বাস সিন্ডিকেটের দীপক সরকার। জয়েন্ট কাউন্সিল অফ বাস সিন্ডিকেটসের তপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, “সরকারকে বাস দিয়ে দিতে আপত্তি নেই। কিন্তু কোনও মালিক কিছু মাসের কিস্তি মিটিয়ে থাকলেও তা ফেরত না-দিয়ে বাস নেওয়া যাবে না।” তাঁর এ-ও প্রশ্ন, “ওই সব বাসের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকদের পুনর্বাসনই বা দেবে কে?”
প্রশ্ন রয়েছে নিগম-কর্তাদের মনেও। জেএনএনইউআরএমের যে সব বাস বিভিন্ন নিগমকে দেওয়া হয়েছিল, সেগুলোরও জীর্ণ দশা। ভাড়া না-বাড়ায় নিগমেরও উপার্জন বাড়েনি, ফলে রক্ষণাবেক্ষণ শিকেয়। মেরামতির অভাবে বিস্তর বাস বসে গিয়েছে। গত দেড় বছরে শুধু সিএসটিসি-তেই অন্তত সাড়ে তিনশো বাস কমেছে। এবং এক বার বসে গেলে আর চালানোর ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন একটি পরিবহণ নিগমের এক কর্তা।
“তাই বেসরকারি মালিকদের বাস এখানে এলেও দেখভালের অভাবে সেই লজ্ঝড়েই হয়ে যাবে।”—পর্যবেক্ষণ ওই নিগম-কর্তার।
|
বাহনের বোঝা |
• ২০০৯-এ কোর্টের
নির্দেশে বাতিল ১৫ বছরের পুরনো বাস |
• শহর জুড়ে পরিবহণ সঙ্কট |
• জেএনএনইউআরএমে ৫১২টি বাস কেনে ডব্লিউবিটিআইডিসি |
• বাসপিছু দাম প্রায়
২০ লক্ষ টাকা |
• ৪৯৬টি বিলি হয় বেসরকারি মালিকের মধ্যে |
• শর্ত ছিল, ১০ লক্ষ টাকা মালিককে শুধতে হবে |
• মাসিক কিস্তির অঙ্ক
২২ হাজার টাকা |
|
|
|
|
|
|