শীতের পর্যটন মরসুমে নবদ্বীপ, মায়াপুর, বেথুয়াডহরি থেকে কৃষ্ণনগর রাজবাড়ি দেখতে ভিড় উপচে পড়ে। এই মরমুমের জন্য অপেক্ষা করেন ব্যবসায়ীরাও। কিন্তু উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাবে এই এলাকায় পর্যটন শিল্পের প্রসারের যে সম্ভাবনা ছিল, তা পূরণ হচ্ছে না বলে ব্যবসায়ীদের দাবি।
নদিয়া জেলা চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাংগঠনিক সম্পাদক উত্তম সাহা বলেন, “বছরের অন্য সময়ের তুলনায় ব্যবসায় এই সময়টাতে অর্থের প্রবাহ কুড়ি থেকে পঁচিশ শতাংশ বেড়ে যায়। নদিয়ার এই পর্যটনকেন্দ্রগুলিতে নিম্নবিত্ত থেকে ধনী সকলেই ভিড় করেন। ফলে আয় বাড়ে সব ধরনের ব্যবসায়ীদের। তবে পর্যটনের উন্নতির স্বার্থে শহরে দ্রুত অটো চালু হওয়া দরকার। পাশাপাশি শহরের সৌন্দর্যানের ব্যাপারেও প্রশাসনের উচিত গুরুত্ব দিয়ে ভাবা। নজর দিতে হবে শহরের অন্যতম পার্ক ‘আনন্দকাননের’ দিকেও।” নবদ্বীপ নাগরিক কমিটির সম্পাদক দিলীপ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “অটো চালু হওয়া এই শহরে খুবই জরুরি। সেই সঙ্গে গঙ্গার ঘাটগুলিতে স্নানের ঘর, শৌচাগারেরও প্রয়োজন।”
|
সেই মাঝ ডিসেম্বর থেকেই নদিয়ার বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রে ভিড় বাড়া শুরু হয়েছিল। ২৫ ডিসেম্বর ও ১ জানুয়ারি সেটা জন সমুদ্রের চেহারা নেয়। নতুন বছরেও সেই ঢেউ ভাসিয়ে দিচ্ছে নবদ্বীপ বা মায়াপুরের মন্দিরের চাতাল, বেথুয়াডহরির বনাঞ্চল, কৃষ্ণনগরের রাজবাড়ি কিংবা ক্যাথিড্রাল চার্চের প্রশস্ত প্রাঙ্গণকে। শনি রবিবার বা সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মদিবসের মতো ছুটির দিন তো বটেই, গোটা জানুয়ারি জুড়েই প্রতিদিন হাজারে হাজারে পর্যটক আসছেন নদিয়ার পর্যটনকেন্দ্রগুলিতে।
বর্ষার মাস দু’য়েক বাদ দিলে এখন প্রায় সারা বছরই ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের এবং বিদেশি পর্যটকের ভিড় থাকে গঙ্গার পশ্চিম পাড়ের প্রাচীন শহর নবদ্বীপ এবং পূর্ব পাড়ের মায়াপুরে। তবে বছরের শেষ সপ্তাহে ভিড়টা কার্যত বেসামাল করে দেয় প্রশাসন থেকে মঠ-মন্দির কর্তৃপক্ষ সকলকেই। এ বারেও তার কোনও ব্যতিক্রম হয়নি।
বছরের শেষ সপ্তাহে ভিড়ের মুখ্য গন্তব্য ছিল মায়াপুরের ইস্কন মন্দির। বছর শেষে বা নতুন বছরে বাড়ির সকলকে নিয়ে এক দিন-এক রাত মায়াপুরে কাটিয়ে নবদ্বীপ ছুঁয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা থাকে বহু মানুষের। রাত যদি কোনও কারণে কাটানো সম্ভব না-ও হয়, নিদেনপক্ষে একটা গোটা দিন বরাদ্দ থাকে মায়াপুর-নবদ্বীপের জন্য। কারণ কম খরচে বেড়ানোর জন্য মায়াপুরের কোনও বিকল্প এ তল্লাটে নেই। ফলে স্বাভাবিক কারণে ভিড় ক্রমশ লাগামছাড়া হয়ে উঠছে ওই দুই শহরে। আর সেই ভিড় সামাল দিতে হিমসিম খেতে হচ্ছে হোটেল মালিক থেকে শুরু করে স্থানীয় ব্যবসায়ী, সকলকেই।
এই মরসুমের সব থেকে বেশি ভিড় ছিল বছরের শেষ রবিবার। ইস্কনের জনসংযোগ আধিকারিক রমেশ দাস বলছেন, “বড়দিন নয়, সব থেকে বেশি ভিড় হয়েছিল ২৯ ডিসেম্বর। ওই দিন প্রায় ৭৫ হাজারেরও বেশি মানুষ এসেছিলেন। তবে ২৩ জানুয়ারি থেকে ভিড়ের সেই পুরনো চেহারাটা আবার ফিরে এসেছে। আমাদের অনুমান, ২৬ জানুয়ারি, রবিবারেও রেকর্ড ভিড় হবে। এ দিকে কোনও ঘর আর ফাঁকা নেই।” ইস্কনে সব মিলিয়ে হাজার চারেক লোকের থাকার ব্যবস্থা আছে। রমেশবাবু বলেন, “একশো টাকার ডরমিটরি থেকে দেড় হাজার টাকার ঘর রয়েছে। কিন্তু দুর্গা পুজোর পর থেকেই ঘরের বুকিং শেষ হয়ে যায়। তাই বিপুল এই চাহিদার সময় যত মানুষকে ঘর দিতে পারি, তার থেকে অনেক বেশি মানুষকে আমরা ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হই। নতুন যে মন্দির তৈরি হচ্ছে তাকে ঘিরে আরও অনেক নতুন অতিথি আবাস হচ্ছে। তবে প্রতি বছর ভিড় যে ভাবে বাড়ছে, তাতে বিশ হাজার লোকের থাকার ব্যবস্থা করলেও বোধহয় সমস্যা মিটবে না।”
বেঙ্গল হোটেলিয়র্সের মায়াপুর শাখা সম্পাদক প্রদীপ দেবনাথ বলেন, “চাহিদা অনুপাতে সত্যিই ঘর দেওয়া যাচ্ছে না। মায়াপুরের বেশির ভাগ মন্দির কর্তৃপক্ষ নিয়মিত অতিথি আবাস বাড়িয়ে চলেছেন। এখানে প্রায় কুড়িটি হোটেল আছে। তা ছাড়া বেশ কিছু বহুতল আবাসনেও মানুষ থাকার জায়গা পাচ্ছেন। তবে এ সবই প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য।”
একই সমস্যা গাড়ির পার্কিং নিয়েও। নবদ্বীপ থানার আইসি তপনকুমার মিশ্র বলেন, “ছুটির সময়ে গাড়ির ভিড় সামাল দেওয়াটাই একটা বড় চ্যালেঞ্জ । পার্কিং এর জায়গা ভর্তি হয়ে গঙ্গার পাড়ে গাড়ি রাখতে বাধ্য হচ্ছেন বহিরাগতরা।” ইস্কনের ভিতরে প্রায় হাজারখানেক গাড়ি রাখার বন্দোবস্ত আছে। কিন্তু ভিড়ের কাছে ওই পরিকাঠামো কিছুই নয়। মানুষ-গাড়ির ভিড়ে হাঁসফাঁস করছে নবদ্বীপও।
তবে এই ভিড় দেখে খুশি স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। তাঁরা বলছেন, “বেড়িয়ে পড়ার সময় মানেই তো লক্ষ্মী আসার সময়। তাই ফি বছর এই ভিড়টার অপেক্ষায় থাকি আমরাও।” |