|
|
|
|
জোড়া খুদের নিখোঁজ-রহস্যে তোলপাড়
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
আচমকা হারিয়ে গিয়েছিল দু’জন। এক বালক, এক বালিকা। রাতভর আর গোটা সকাল-দুপুর ‘নিখোঁজ’ থাকার পরে তাদের সন্ধানও মিলল।
কিন্তু বুধবার গভীর রাতে বাগুইআটি থেকে বেপাত্তা হয়ে যাওয়া দুই খুদে শিম্পাঞ্জিকে নিয়ে বৃহস্পতিবার দিনভর যে নাটক চলল, তা প্রায় নজিরবিহীন। কেন্দ্রীয় বন মন্ত্রক, রাজ্য বন দফতর ও কেন্দ্রীয় শুল্ক দফতর একে অপরের ঘাড়ে দোষ চাপাল সারা দিন ধরে। শেষে অবশ্য কেন্দ্রীয়
শুল্ক দফতর জানায়, শিম্পাঞ্জি দু’টি তাদের হেফাজতেই রয়েছে। এ দিন রাতে ওদের পৌঁছে দেওয়া হয় আলিপুর চিড়িয়াখানার পশু হাসপাতালে, যেখানে বুধবার গভীর রাতে ঠাঁই হয়েছে পাচারকারীদের কবল থেকে উদ্ধার করা আর একটি বালক শিম্পাঞ্জিরও।
বুধবার রাতে শুল্ক অফিসারদের সঙ্গে নিয়ে বাগুইআটির এক পাখি-ব্যবসায়ীর বাড়ি থেকে বেশ কিছু পশুপাখি আটক করেন কেন্দ্রীয় বন্যপ্রাণী অপরাধ নিয়ন্ত্রণ শাখার পূর্বাঞ্চলীয় অফিসারেরা। উদ্ধার হয় তিনটি শিম্পাঞ্জি (দু’টি বালক, একটা বালিকা), পাঁচটি মার্মোসেট, পাঁচটি ম্যাকাও, ছ’টি কাকাতুয়া ও চারটি ধূসর টিয়া (গ্রে প্যারট)। শিম্পাঞ্জি তিনটির বয়স এক থেকে দেড় বছর। বালক দু’টি রাখা ছিল একটা খাঁচায়। অসুস্থ বালিকাটি অন্য খাঁচায়। তিনটেরই ছবি তোলা হয়, ভিডিওগ্রাফিও হয়। |
|
উদ্ধার হওয়া দুই শিম্পাঞ্জি। কাস্টমস হাউসে। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক। |
কিন্তু বুধবার রাত একটা নাগাদ আলিপুর চিড়িয়াখানায় গিয়ে পৌঁছল শুধু একটা বালক শিম্পাঞ্জি! বন্যপ্রাণী অপরাধ নিয়ন্ত্রণ শাখা সেটা জানতে পারলেন এ দিন সকালে। চাপান-উতোরের সেই সূত্রপাত।
বন্যপ্রাণী অপরাধ নিয়ন্ত্রণের কর্তারা দাবি করেন, পশুপাখিগুলোকে অবৈধ ভাবে পাচার করা হচ্ছিল। তাই শুল্ক দফতর তদন্ত করছে। এবং শুল্কেরই দায়িত্ব ওদের চিড়িয়াখানা-কর্তৃপক্ষের হাতে সঁপে দেওয়া। আলিপুর চিড়িায়াখানা-কর্তৃপক্ষ বলেন, তাঁরাও তিন শিম্পাঞ্জি আটকের খবর শুনেছেন, অথচ শুল্কের ‘সিজার লিস্ট’-এ একটারই উল্লেখ রয়েছে। এর বাইরে তারা কিছু জানে না বলে দাবি করে চিড়িয়াখানা। চিড়িয়াখানা-সূত্রের খবর, বুধবার রাতে জরুরি তলব পাঠিয়ে আনা কর্মীদেরও তিনটি শিম্পাঞ্জির জন্য তৈরি থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল, তাঁরা যেন ঘুমপাড়ানি গুলি মজুত রাখেন।
মাঝরাতে সাকুল্যে একটি শিম্পাঞ্জিকে দেখে সেই কর্মীরাও অবাক হয়ে যান। বাকি দু’টো তা হলে গেল কোথায়? যারা উত্তরটা দিতে পারত, সেই শুল্ক দফতর এ দিন সকাল থেকে মুখে কুলুপ এঁটে বসে! বন্যপ্রাণী অপরাধ নিয়ন্ত্রণের অফিসারেরা সকালে বাকি দু’টোর খোঁজে ফের বাগুইআটির বাড়িটিতে যান। ফেরেন খালি হাতে। বিভ্রান্তি বাড়তে থাকে। উপরন্তু দুপুরে শুল্কের এক অফিসার মন্তব্য করেন, “আমরা একটাই শিম্পাঞ্জি পেয়েছি। সংবাদমাধ্যম কোথা থেকে তিনটের ছবি পেল, বলতে পারব না।” বন্যপ্রাণী অপরাধ নিয়ন্ত্রণের কিছু অফিসার সরাসরি শুল্ক কর্তাদের দোষারোপ করতে থাকেন। সব মিলিয়ে চরম সংশয় তৈরি হয়। রীতিমতো তোলপাড় পড়ে যায়।
শেষমেশ খোঁজ দিয়েছে শুল্ক দফতরই। যদিও তাতে নিখোঁজ-রহস্যের বিশেষ তল পাওয়া যায়নি। শুল্ক-কমিশনার শৈলেন্দ্র সিংহ এ দিন বিকেলে নিজের অফিসে বসে সাংবাদিক সম্মেলন করে জানান, দুই শিম্পাঞ্জি তাঁদের হেফাজতেই রয়েছে। দেখা যায়, অফিসের অন্য ঘরে খাঁচার ভিতরে দু’টিতে একে অপরকে জড়িয়ে বসে আছে! চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ! শুল্ক কর্তারা অবশ্য তখনও জানেন না, ওরা পুরুষ, না মহিলা। ওরা তা হলে ছিল কোথায়?
শৈলেন্দ্রর দাবি, ওরা সত্যিই হারিয়ে গিয়েছিল। তবে শুল্ক অফিসারেরাই আবার খুঁজে পেয়েছেন। “বুধবার রাতে বাগুইআটির বাড়িটার সামনে মানুষের ভিড় ও মিডিয়াকে সামলাতে গিয়ে আমাদের অফিসারেরা হয়রান হয়ে পড়েন। ভিতরে তখন একটা ঘরে দু’টো খাঁচায় তিনটি শিম্পাঞ্জি। সেখানে সারাক্ষণ পাহারা দেওয়ার মতো কাউকে পাওয়া যায়নি। অফিসারেরা পাখি গুনতে আর কাগজপত্র বানাতে ব্যস্ত ছিলেন। রাত দশটা নাগাদ ওঁরা গিয়ে দেখেন, একটা খাঁচা থেকে দু’টো শিম্পাঞ্জি উধাও!”— বলেন শুল্ক কমিশনার।
শুল্ক কর্তাদের বক্তব্য, বাইরের হই-হট্টগোলেই দুই খুদে ভয় পেয়ে খাঁচার দরজা খুলে বেরিয়ে গিয়েছিল। ওই সময়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত অতিরিক্ত শুল্ক কমিশনার সন্তোষ শরণ এ দিন বলেন, “ঘরে টিমটিমে আলো জ্বলছিল। বাইরেটা অন্ধকার। তাই রাতে ওদের আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।” অগত্যা তাঁরা একটা শিম্পাঞ্জি নিয়েই চিড়িয়াখানায় চলে যান। সিজের লিস্টে তাই একটারই উল্লেখ করা হয়। দু’টিকে পাওয়া গেল কী ভাবে?
শুল্কের দাবি: অবৈধ ভাবে পশু রাখার অভিযোগে ওই বাড়ি থেকে ধৃত সুপ্রদীপ গুহকে নিয়ে এ দিন সকালে তারা আবার বাগুইআটির বাড়িতে গিয়েছিল। তখনই ওদের হদিস মেলে। “দেখা যায়, ঘরের বাইরে ক্যাম্পাসের ভিতরে এক কোণে ওরা বসে রয়েছে।” জানান এক শুল্ক অফিসার। যদিও এ দিন শুল্ক অফিসে বসেই সুপ্রদীপবাবু বলেন, “কই, আমি তো সকালে বাগুইআটি যাইনি!” ধন্দ আরও রয়েছে। বুধবার রাত থেকে সুপ্রদীপবাবুর আত্মীয়েরা বাড়িতে ছিলেন। প্রশ্ন উঠছে, সারা সকালে তাঁদের চোখেও কেন দুই শিম্পাঞ্জি ধরা পড়ল না? বন্যপ্রাণী অপরাধ নিয়ন্ত্রণের অফিসারেরাই বা খুঁজে পেলেন না কেন? যদি ধরে নেওয়া হয়, তাঁরা যাওয়ার আগেই শুল্কের লোকজন শিম্পাঞ্জি দু’টিকে নিয়ে এসেছে, তা হলে দুপুরে কেন এক শুল্ক-অফিসার বললেন যে, তাঁরা একটাই শিম্পাঞ্জি পেয়েছেন?
উপরন্তু দু’টো শিম্পাঞ্জি যে হারিয়ে গিয়েছে, সে খবর শুল্কের তরফে তাঁদের জানানো হল না কেন, বন্যপ্রাণী অপরাধ নিয়ন্ত্রণের অফিসারেরা তা নিয়েও অভিযোগ তুলছেন। ওঁদের এ-ও দাবি, দু’টো বালক শিম্পাঞ্জি যখন এক খাঁচায় ছিল, তখন দরজা খুলে গেলে দু’টোরই পালিয়ে যাওয়ার কথা। “কিন্তু তা হয়নি।
তা হলে কি দু’টো খাঁচার দরজা এক সঙ্গে খুলে একটা বালক আর একটি বালিকা পালিয়েছিল? আর খাঁচা খোলা পেয়েও অন্য বালকটি বসে থাকল?” প্রশ্ন ওঁদের। শুল্কের কী ব্যাখ্যা?
শুল্ক কমিশনার শৈলেন্দ্র বলেন, “কোন খাঁচায় বালক বা কোন খাঁচায় বালিকা ছিল, সে সব আমাদের জানার কথা নয়। দু’টো পালিয়েছিল, দু’টোকে খুঁজে পাওয়া গিয়েছে।” কমিশনারের অনুমান, “দু’টো খাঁচাই হয়তো খুলে গিয়েছিল! খাঁচা দেখলেই বুঝতে পারবেন। তালা নেই। দরজা খোলা সহজ।” কেন্দ্রীয় বন্যপ্রাণী অপরাধ নিয়ন্ত্রণ শাখার এক অফিসার রাতে বলেন, “তিনটেই এখন চিড়িয়াখানার হাসপাতালে। আশা করি, ওরা সুস্থ হয়ে উঠে দর্শকদের আনন্দ দেবে।”
পুরো ঘটনায় রাজ্য সরকারের কী প্রতিক্রিয়া?
শিম্পাঞ্জি নিয়ে দিনভর নাটক দেখে রাজ্যের বনমন্ত্রী বিনয় বর্মন ক্ষুব্ধ। “এই জাতীয় তল্লাশির আগে বন দফতরকে জানানোটাই রীতি। কোন পশুর কেমন স্বভাব-চরিত্র, তা বিশেষজ্ঞেরাই জানেন, শুল্ক-অফিসারেরা নন।” বলেন তিনি। দিল্লির সেন্ট্রাল জু অথরিটির তরফে বি বনশলের বিস্মিত মন্তব্য, “শিম্পাঞ্জির মতো প্রাণী উদ্ধার হল, অথচ চিড়িয়াখানায় না-পাঠিয়ে রেখে দেওয়া হল শুল্কের হেফাজতে? সিজার লিস্ট করা বেশি জরুরি ছিল, নাকি ওদের প্রাণ বাঁচানো?”
|
পুরনো খবর: আফ্রিকা থেকে বাগুইআটি, দরজা খুলতেই তিন শিম্পাঞ্জি |
|
|
|
|
|