লোকে এখন ভাবছে আমার আসল চুলটাই উইগ

ব্যান্ডানার পিছনে যে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় লুকিয়ে ছিল, সে তো অনেককেই চমকে দিয়েছে...

তা ঠিক। যখন ব্যান্ডানাটা পরতে শুরু করেছিলাম, তখন অনেকেই ভেবেছিল যে ওটা হল স্টাইল স্টেটমেন্ট। এক বার তো মুখ্যমন্ত্রীর কাছেও গিয়েছি দেখা করতে। কিন্তু মাথায় ব্যান্ডানা বেঁধে! বলেই ফেললাম, “দিদি, আপনার সামনে এটা খুলতে পারব না।”

এত রাখঢাক কীসের?
আসলে ন্যাড়া হলে কোনও অসুবিধে ছিল না। ওটা তো এক্সপোজ করা যায়। কিন্তু চুলটা এত খাবলা খাবলা করে কাটা! অনেকে তো ‘জাতিস্মর’-য়ে কুশল হাজরার চরিত্রে আমার ওই অদ্ভুত টাকওয়ালা চেহারা দেখে আমার টিম মেম্বারদের বলেছে, তোদের বস-য়ের এ রকম চুল হয়ে গিয়েছে। কিন্তু উইগ পরে ঘোরে বলে বোঝাই যায় না! (হাসি)

কী ভাবে ঠিক করলেন এই লুক-টা?
যখন চরিত্রটার কথা বলা হয়েছিল, সৃজিত তখন বলেছিল কিছু একটা অন্য রকম ভাবতে। পরিচালক পার্থ সেনের মেয়ে সৃজিতের অ্যাসিস্ট্যান্ট। উনি একদিন আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। ওঁর তখনকার চেহারাটা দেখে আমি ওঁর একটা ছবি তুলে নিই। তার পর ফোটোশপে ওঁর মুখের আদলের সঙ্গে মিলিয়ে অন্য একটা চেহারার সঙ্গে মর্ফ করে একটা লুক ঠিক হয়!

এমনিতে তো মুড়ির ওপরেই থাকেন। মুড়িটাও কি ছেড়ে দিয়েছিলেন ওই রুগ্ণ লোকটার জন্য?
ওই চেহারাটা তৈরি করতে তিন সপ্তাহ ধরে শুধুমাত্র দু’রকম ফল খাওয়াটা অ্যালাউড ছিল। তরমুজ আর পেঁপে। তা ছাড়া লেটুস পাতা সেদ্ধ। জল পর্যন্ত মেপে মেপে খেতে হত। তবে প্রচুর পরিমাণে গ্রিন টি খেতাম। চিনি বাদে। এতেই সাড়ে পাঁচ কিলো কমিয়ে ছিলাম। একেবারে হাড় দেখা যাচ্ছিল।


চুলটা?

কামিয়ে ফেলেছিলাম। মাথার সামনের দিকে কিছু কিছু জায়গায় রোজ রেজর চালাতাম। তাই ওই খাবলা খাবলা ভাব। এখন চুলটা বড় হয়ে গিয়েছে। তবে খুব খুঁটিয়ে দেখলে বুঝতে পারবেন যে এখনও কিছু জায়গায় চুলগুলো ছোট। প্রণয় আর সুভাষ রোজ এই লুকটা মেনটেন করত। তবে আর একজনের বিশাল কৃতিত্ব প্রাপ্য। উনি বিক্রম গায়কোয়াড়। ‘মনের মানুষ’-য়ের সময় জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন। এটার জন্য অপেক্ষা করে আছেন।

ছবি মুক্তির আগে অ্যান্টনিকে নিয়ে না হয় অনেক কথা হয়েছে। কুশল হাজরা প্রসঙ্গ তো একেবারেই অন্তরালে ছিল। সেটাও কি স্ট্র্যাটেজি?
হ্যাঁ, ভরসা ছিল যে পর্দায় প্রথম বার কুশলকে দেখে দর্শক বলবে: ‘এটা বুম্বাদা?’

মোবাইল ক্যামেরার যুগে ফিরিঙ্গি কালীবাড়ির সামনে শ্যুটিং করার পরেও কোথাও একটা ছবি বেরোয়নি!
খুব কঠিন ছিল। সেদিন অন্তত ৫০/৬০ জন বাউন্সার ছিল। প্রচুর বাইরের লোক। অনেক মোবাইল ক্যামেরা। প্রত্যেকটা মোবাইল ক্যামেরায় তোলা ছবি ডিলিট করা হয়েছিল। কানে বেশ মজার সব কমেন্ট এসেছিল: “ইশ্, প্রসেনজিতের এত শরীর খারাপ! শরীরটা এ রকম ভেঙে গিয়েছে! রোগভোগ হয়েছে নিশ্চয়ই...তবে কী অবস্থা, এই নিয়েও আজকাল শ্যুটিং করতে হচ্ছে!”

তারকা প্রসেনজিতের কি সেই মুহূর্তে একবার মনে হয়েছিল যে অভিনেতা হিসেবে খুব কনভিন্সিং কাজ করছেন?
(হাসি) এটা তো ফ্যাক্ট যে ক্যামেরার সামনে যখন একজন নায়ক দাঁড়ায়, সে জানে যে লোকে তাকে সুন্দর দেখতে বলে অ্যাপ্রিসিয়েট করবে। আমাকে তো একটু-আধটু দেখতে ভালই...(হাসি) এখানে তো ইচ্ছে করে আমি নিজেকে একদম ‘আনকুথ’ করে ফেলেছিলাম।

এ তো গেল ভোলবদলের কথা। কুশলের চরিত্রে অভিনয়েও আপনি বেশ আন্ডারস্টেটেড...
এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে বলতে ভাল লাগছে যে কুশল হাজরা হয়তো বাংলা সিনেমার এক ইম্পর্ট্যান্ট চরিত্র হিসেবে থেকে যাবে। জানতাম কুশল চরিত্রটা একবার দর্শকের কাছে পৌঁছলে, ওটা নিয়ে কথা হবেই। তবে এই চরিত্রের কোনও রেফারেন্স আমার কাছে ছিল না। এ রকম মানুষকে আমি চিনি না। এ তো সত্যজিৎবাবুর ‘সোনার কেল্লা’ নয়। কেউ যদি জিজ্ঞেস করে যে এই চরিত্রে অভিনয়ের জন্য আলাদা করে কী ট্রেনিং নিয়েছি, আমি বলব না। হাঁটা, কথা বলা সব পাল্টেছি। ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেছি যে, দু’টো হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেলে কি খুব স্বাভাবিক ভাবেই একটা মানুষ নিজের বুকে বারবার হাত দিতে পারে? ডাক্তারেরা বললেন, সেটা হয়ে যায়। কেউ কেউ ভেবেছেন ওটা অতিরঞ্জিত। কিন্তু তা নয়। শ্যুটিং করতে গিয়ে হঠাৎ মনে হল চোখের মণির মুভমেন্ট করলে কেমন হয়? সৃজিত সেটা দেখে লাফিয়ে ওঠে। হ্যাটস্ অফ টু সৌমিক হালদার। কী ভাল কাজ। কুশল মানুষটা স্বাভাবিক হয়েও তাকে স্বাভাবিক লাগে না। কোথাও একটা হারিয়ে যাওয়া আছে, বাঁচার তাগিদ আছে।

তবে ছবিতে তিনটে ন্যারেটিভ আর তার মধ্যে দুটো প্রসেনজিৎ নিয়ে কি কোথাও ব্যাপারটা কনফিউজিং হয়ে যাওয়ার রিস্ক ছিল না?
আমার মনে হয়, সৃজিতের প্রশংসা প্রাপ্য যে, ও এতটা রিস্ক নিয়ে এই রকম একটা সিনেমা বানিয়েছে। যখন ‘ক্লার্ক’ করেছিলাম, ওটা কিন্তু সময়ের চেয়ে এগিয়ে ছিল। সহজ ভাবে তো গল্প বলাই যায়। কিন্তু তা হলে আমি ‘বিক্রম সিংহ’ করব। নিজেকে যে ভাবে মেনটেন করেছি, আমি তো ‘ধুম থ্রি’র মতো সিনেমা করতেই পারি। কিন্তু সিনেম্যাটিক ল্যাঙ্গুয়েজ নিয়ে পরীক্ষা করাটা দরকার। তিনটে ন্যারেটিভ, তার ওপর মিউজিক্যাল সেটা হ্যান্ডল করাটা খুব কঠিন। কারও সেটা পছন্দ হবে। কেউ বলবেন অন্য কিছু। তবে আমি এই প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাব।

কুশলের ডায়েট চার্ট
তিন সপ্তাহ ধরে শুধুমাত্র দু’রকম ফল খাওয়ার অনুমতি ছিল
• খাওয়ার মধ্যে ছিল তরমুজ আর পেঁপে। আর খাওয়া যেত লেটুস পাতা সেদ্ধ
জল খেতে হত মেপে মেপে
• সারা দিন ধরে গ্রিন-টি
এতেই সাড়ে পাঁচ কেজি ঝরাতে পেরেছি

ছবি নিয়ে নানা মত থাকতেই পারে। তবে বেশির ভাগ মানুষ কুশল চরিত্রে আপনার অভিনয়ের প্রশংসা করছেন। সেখানে এত রেসট্রেন থাকার কারণ কি আপনার সাম্প্রতিক কালে ভাল (লাউড নয়) থিয়েটার দেখার অভিজ্ঞতা?

থিয়েটার দেখাটা আমাকে অ্যান্টনির চরিত্র করতে সাহায্য করেছে। কুশল হাজরা হল এত দিনের শিক্ষার প্রতিফলন। তপন সিংহের ‘আতঙ্ক’ থেকে শিক্ষা। একটু কোথাও ভাল কিছু পেলে আমি সেটা শেখার চেষ্টা করি। অনেকটা গরুর জাবরের মতো থেকে যায় আমার মধ্যে। আমি সেটের একটা প্রপ দেখে বুঝতে পারি কী রকম অভিনয় চাওয়া হচ্ছে। আমার অনেক ছোটবেলার সিনেমা ‘উৎসব’। সেখানেও আমি আন্ডারপ্লে করেছিলাম। তার পর ‘দোসর’। কুশলের জন্য তো আমার গলার টোনটাও পাল্টেছি। আমি জানি আমার গলার বা কথা বলার একটা ক্রেজ রয়েছে। তবু তা করেছি। এক অ্যাসিস্ট্যান্ট লাইব্রেরিয়ান, যার একটা শারীরিক অসুবিধা রয়েছে, সেই চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে হলে শুধু তো লুক পাল্টালেই হবে না। ব্যক্তিত্বের জায়গাটাও পাল্টাতে হবে। সৃজিত যে ভাবে সংলাপ লেখে, সেখানে একটা হিরোইজম এসে যায়। একটা হাততালির জায়গা থাকে। ওগুলোকে আমি কনশাসলি বাদ দিয়েছিলাম এই চরিত্র করার সময়। শুধু তাই নয়, অ্যান্টনির চরিত্রে আমি শ্রীকান্ত (আচার্য)-কে দিয়ে ডাব করাতে বলি। স্বার্থপর হয়ে যদি শুধু জাতীয় পুরস্কার নিয়ে ভাবতাম তা হলে এই সাজেশনটা দিতাম না। কিন্তু আমি নিজের কথা না ভেবে ‘জাতিস্মর’ সিনেমাটার প্রতি দায়বদ্ধ হয়েই এই রকম একটা সিদ্ধান্ত নিই। তবে থিয়েটার প্রসঙ্গে বলি, ২০১৪-য় না হলেও, ২০১৫তে আমাকে একটা নাটকে অভিনয় করতেই হবে।

আপনার গলাটা এতটাই পরিচিত যে, কিছু দর্শকের কাছে সেখানে শ্রীকান্ত-র গলা ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন উঠছে...
কই, আমি তো একবারও শুনিনি। দর্শকরাও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিণত হয়েছেন। আমার মনে হয়, এটা খুব হেলদি ডিসিশন।

প্রসেনজিৎ থেকে হাজরা

মেকওভারের আগে

শেভের পরে মাথায় টাক

রগের চুলও কামানো

ডায়েটের ফল রুগ্ণ চেহারা

অবশেষে কুশল হাজরা

কুশল হাজরার চরিত্রে অভিনয় করার ঘরানাতে এর আগেই আপনার অভিষেক হয়েছিল। ‘ক্লার্ক’ আর ‘হাউজফুল’য়ে। কোনও হিরোইজম নেই। একদম ব্যর্থতার গল্প। ‘দোসর’য়ে তা ছিল না...

‘ক্লার্ক’য়ে আমার খুব ভাল কাজ। প্রায় সংলাপই নেই সেখানে। দুর্ভাগ্য সে সময় ছবিটা অত মানুষ দেখেনি। আজকের দিনে কিন্তু ক্লার্ক রি-রিলিজ করার কথা ভাবাই যায়। যখন ‘হাউসফুল’ করার প্রস্তাব আসে সেই সময় ‘অংশুমানের ছবি’র অফারটাও ছিল। ওটার স্ক্রিপ্টটাও ভাল তবে তার আগেই আমি ‘হাউসফুল’য়ে মত দিয়েছিলাম। এটা ঠিক যে তখন ‘ক্লার্ক’ আর ‘হাউসফুল’য়ে যা করেছিলাম, তা আমার তখনকার ইমেজের থেকে একদম আলাদা। একটায় কেরানি। অন্যটায় ব্যর্থ পরিচালক। এঁরা তো সবাই আন্ডারডগ। কুশলের মতো। ‘দোসর’য়ে আমি আন্ডারপ্লে করেছিলাম ঠিকই। তবে ওটা ফেলিওর চরিত্র ছিল না। তবে ওখানেও অনেক সুযোগ ছিল স্বাধীন পারফর্ম্যান্সের। মনে আছে, ঝগড়া করতে করতে কাশির দৃশ্যটা? ওখানে তো বাড়তি অভিনয়ের প্রচুর সুযোগ ছিল।

সেই তুলনায় ‘অটোগ্রাফ’, ‘বাইশে শ্রাবণ’, ‘মনের মানুষ’, ‘মিশর রহস্য’য়ে আপনার প্রত্যেকটা চরিত্রই বেশ লার্জার দ্যান লাইফ...
হ্যাঁ, তা ঠিক। কাকাবাবু তো একটা তারকাসুলভ চরিত্র। ওখানে রেসট্রেন্ট হলে হবে না। আসলে এখন আমি একটা ক্ষুধার্ত বাঘের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছি। কিন্তু সে বাঘটা তিরিশ বছর ধরে ইন্ডাস্ট্রিতে কাটিয়ে খানিকটা বুঝে গিয়েছে কোথায় কী রকম ভাবে কাজ করাটা প্রয়োজন। সময় চলে যাচ্ছে। বুঝতে পারি যে আমি তো এখনও পাড়েই দাঁড়িয়ে আছি। সামনে বিশাল সমুদ্র। আজও যদি আমাকে কেউ একটা কথা না বলে অভিনয় করাতে পারে আমার তা দারুণ লাগবে। আমি জানি যে আমাকে এখন অভিনেতা হয়ে সিনেমার সব ফ্রেমে থাকতে হবে না। তারকার হ্যাং-ওভার থেকে বেরিয়ে অভিনয় করাটা একটা ট্রিপ। কুশল এমনিতে তারকা নয়। কিন্তু সে-ই আজ নায়ক। ‘জাতিস্মর’-য়ে তো অ্যান্টনি স্টার। রোহিত (মানে যিশু সেনগুপ্ত) স্টার। কুশল তো স্টার নয়। কিন্তু আমরা সবাই মিলে কুশলকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে গিয়েছি যে, থিয়েটার থেকে বেরিয়ে লোকে ওকেই বাড়িতে নিয়ে ফিরছে। ভাবতে ভাল লাগছে যে পাঁচ বছর পরেও লোকে এই চরিত্রকে মনে রাখবে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.