|
|
|
|
|
তুই নিজেই নিজেকে নম্বর দে সৃজিত
প্রসেনজিতের অন্যতম সেরা অভিনয়। তবু সৃজিতোচিত নয়।
বন্ধুকে চিঠি লিখলেন হতাশ মৈনাক ভৌমিক।
|
|
প্রিয় সৃজিত,
তোর ছবি এলেই দেখার জন্য মুখিয়ে থাকি। সেই ‘অটোগ্রাফে’র দিন থেকেই আমি তোর ভক্ত। নতুন ছবি ‘জাতিস্মর’ দেখলাম সেদিন। যিশু সেনগুপ্ত আর স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়ের প্রেমের গল্প, যার ব্যাকড্রপে রয়েছে অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির আখ্যান। পর্তুগিজ ওই কবিয়ালের চরিত্রেই প্রসেনজিৎ। ‘মিশর রহস্যে’র মতোই এ ছবিতেও তুই গল্পটাকে আজকের সময়ে দাঁড় করিয়েছিস। তার সঙ্গে অ্যান্টনির সাবপ্লট যোগ করে দর্শককে দু’টো ভিন্ন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাতায়াত করিয়েছিস। এই ব্যাপারটা আমার দারুণ লেগেছে।
একদম গোড়া থেকেই ছবির অন্তর্নিহিত মূল থিমটাও তুই স্পষ্ট করে ধরিয়ে দিয়েছিস। সেটা কী? বাংলা, বাঙালি আর বাঙালি সংস্কৃতির জায়গা। প্রসেনজিৎ আর যিশুর দু’টো সমান্তরাল গল্পেই দেখা যাচ্ছে, বাংলা ভাষা এবং সংস্কৃতি কী অদম্য ভাবে এক জন বিদেশি এবং এক জন অবাঙালিকে আকর্ষণ করছে। অ্যান্টনি বিদেশি আর যিশু এ ছবিতে গুজরাতি যুবক। অ্যান্টনি যে রকম বাংলা ভাষা, বাংলা গানকে আপন করে নিয়েছিলেন, এখানে যিশুকেও সেটাই করতে হচ্ছে। যিশুর কট্টর বাঙালি প্রেমিকা স্বস্তিকা তাকে চ্যালেঞ্জ করে বলছে, তার মন পেতে হলে যিশুকে ভাল করে বাংলা শিখতে হবে এবং আস্ত একটা বাংলা গান লিখে দেখাতে হবে।
যে ভাবে তুই প্রায় মেনস্ট্রিম ছবির ধারায় একটা প্রেমের গল্প বলতে চেয়েছিস, সেটা কুর্নিশ না করে পারছি না। তোর এই চেষ্টাটা হেমলকের মূল গল্পটার মধ্যেও ছিল। আর এই মেনস্ট্রিম আঙ্গিকে একটা গল্প ঠিকঠাক ভাবে বলা যে কতটা কঠিন! আমার বিশ্বাস, সব ডিরেক্টরই এ বিষয়ে একমত হবেন। কারণ, এই চেষ্টাটা আমাদের সকলেই কমবেশি করেছি, কেউ সফল হয়েছি। কেউ হইনি। রাজ চক্রবর্তী যেমন ‘চিরদিনই তুমি যে আমার’-এ দুর্দান্ত বাণিজ্যিক সাফল্য পেয়েছিলেন! আবার ‘গণেশ টকিজ’-এ তাঁর ব্যর্থতা অঞ্জনদা নিজেই স্বীকার করেছেন!
তুই ‘জাতিস্মর’য়ে সফল কি সফল নয়, সেটা দর্শক ঠিক করবেন। আমি এক জন সহকর্মী এবং তোর প্রথম ছবির ভক্ত হিসেবে এটুকুই বলতে পারি, তোর চ্যালেঞ্জটা আমি বেশ বুঝতে পারছি। এক জন ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্মমেকারের পক্ষে মেনস্ট্রিম ধারায় নিজেকে খাপ খাওয়ানোর ঝুঁকিটা যে কতখানি, সেটা আমি হাড়ে হাড়ে জানি।
স্টাইলের দিক দিয়ে তুই বারবারই ছবিতে কিছু না কিছু ফান এলিমেন্ট আনিস। সেটা হেমলকেও ছিল। মিশরে কমিক্স ধাঁচটা কাজে লাগিয়েছিলি। যে কোনও ফিল্ম-দিওয়ানারই কিছু অদ্ভুতুড়ে বা কুইরকি ব্যাপারস্যাপার নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করার ঝোঁক থাকে। তোরও সেটা আছে। এই ছবিতে রিয়া আর রাহুলের গল্পে সেই উপাদানটা আছে। আবার অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি বলতে লোকে কী বোঝে, সেটা যখন বলেছিস, একদম ডকু-স্টাইল! প্রসেনজিতের চরিত্রটা যখন প্রথম আসছে, বডিক্যাম শটস রাখছিস! ভাষা নিয়ে এই খেলাটা বেশ ইন্টারেস্টিং হয়েছে!
|
|
কুশল হাজরার ভূমিকায় প্রসেনজিতের লুক এবং অভিনয়, দুইই বড় ভাল লাগল। সাদামাঠা, টাক পড়ে যাওয়া বিনয়ী লাইব্রেরিয়ান একই সঙ্গে অপার রহস্যময়! যিশুকে অ্যান্টনির গল্প সে-ই তো বলে! অ্যান্টনির অন্তরমহলের দরজাটা খুলে দেয় সে-ই। এমন সব তথ্য আওড়াতে থাকে, ইন্টারনেটে যার হদিশ মেলে না। অ্যান্টনির ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে এত কথা জানল কী করে কুশল? সেটাই ছবির আসল জায়গা।
নির্দ্বিধায় বলতে পারি, প্রসেনজিতের অন্যতম সেরা অভিনয় দেখলাম। তবে একটা কথা। ছবিটা ভিস্যুয়ালি এমনিতে এত শক্তিশালী...কিন্তু কুশল যখন তার অতীতের কথা বলে, সেইখানে তার কথার সঙ্গে মিলিয়ে কিছু ভিস্যুয়াল রাখা যেত না? ওই অংশটা দৃশ্যগত ভাবে কিছুটা বিরক্তিকর লাগছিল!
সৃজিত, তুই সব ছবিতেই কোনও না কোনও চমকদার থিম নিতে পছন্দ করিস। কিছু একটা আউট-অব-দ্য-বক্স ভাবনা তোর থাকেই। এ বারে তুই পুনর্জন্মের পিচে ব্যাট করেছিস। একটা দেজা ভ্যু মুহূর্ত আছে, যেখানে প্রসেনজিৎ ট্র্যাফিক থামিয়ে রাস্তার মধ্যিখানে নেমে পড়ছেন! একটা
জন্ম থেকে আর একটা জন্মে ঢোকা-বেরনোর এই নকশায় এমন আরও সব মুহূর্ত থাকলে ভাল হত। সেটা সর্বত্র হয়নি, বিশেষত ডাক্তারের দৃশ্যে গোটাটাই অতিসরলীকৃত হয়ে ধেবড়ে গিয়েছে।
গান তোর ছবিতে বরাবরই খুব গুরুত্বপূর্ণ। এখানে প্রধান প্রেমের গল্প আর অ্যান্টনির সাবপ্লটের মধ্যে গানই মূল সেতু। সঙ্গীতকার হিসেবে কবীর সুমনকে বেছে নেওয়ার জন্য সেলাম! ওঁর ‘জাতিস্মর’ গানটা তো আছেই, অন্যান্য কম্পোজিশনেও ওঁর নিজস্ব সিগনেচার রয়েছে। বাংলা গানের একটা অধ্যায়কে তোরা যে ভাবে আর্কাইভ করার চেষ্টা করেছিস, সেটা অবশ্যই আলাদা একটা সম্মান দাবি করে। কিন্তু একটা মেনস্ট্রিম লাভ স্টোরির মধ্যে এই অংশটা কতটা মসৃণ ভাবে মিশল, সেটা আমার একটা প্রশ্ন। অতীত আর বর্তমানকে একসঙ্গে আনার অত্যন্ত কঠিন এবং সাহসী একটা কাজ তুই করার চেষ্টা করেছিস। সেটা নিঃসন্দেহে প্রশংসা পাবে। এ কালের ব্যান্ড-দৃশ্যটাও দারুণ শ্যুট করেছিস। কিন্তু ছবির টাইট্লে যেহেতু ‘মিউজিকাল’ কথাটা ছিল, তার ওপর রূপম-অনুপমদের মতো স্টারকে অতিথিশিল্পী করে এনে তুই দর্শকের খিদেটা বাড়িয়ে দিয়েছিলি। আমার মতো যারা প্রথম থেকে তোর ছবির গানের ভক্ত, তাদের যেন ঠিক আশা পূরণ হল না। আমরা যে মিউজিকাল এক্সট্রাভ্যাগানজা-র প্রত্যাশা নিয়ে গিয়েছিলাম, সেটা পেলাম না। তার পর দ্বিতীয়ার্ধে ব্যান্ডেমোনিয়ামের লড়াইয়ে যখন অ্যান্টনির সময়ের প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে, ওই অংশটাও খুব লম্বা লাগছিল। আর বিরক্তিকর।
পারফরম্যান্সে নজর কেড়ে নিয়েছেন যজ্ঞেশ্বরীর চরিত্রে অনন্যা চট্টোপাধ্যায়। অ্যান্টনির সঙ্গে গানের লড়াইয়ের দৃশ্য। স্বস্তিকার মায়ের ভূমিকায় মমতা শঙ্কর। এবং অবশ্যই স্বস্তিকা নিজে। ইন্টারেস্টিং সংলাপ খুব সহজে বলার একটা আশ্চর্য ক্ষমতা আছে ওর। আর আলাদা করে তোকে ভালবাসা জানাব, আমার বন্ধু যিশুকে হিরো নেওয়ার জন্য। আমি আশা করব, এই ছবিটা যিশুর কামব্যাক ছবি হবে।
যে কোনও ছবিই মুক্তির পর প্রথমে বোঝা যায় না, দর্শক সার্বিক ভাবে ছবিটা কতটা নেবেন। তোর বন্ধু হিসেবে, সহকর্মী হিসেবে, ভক্ত হিসেবে তোকে সব সময়ই ‘বেস্ট অব লাক’ বলতে চাইব!
দর্শক কী রকম ভাবে গ্রহণ করবেন এটি আন্দাজ করা, শুধু এই ছবি নয়, যে কোনও ছবির ক্ষেত্রেই খুব কঠিন। আমরা ছবি বানাই একটা বিশ্বাস থেকে। তোর বন্ধু, অনুরাগী আর সহকর্মী হিসেবে আমার শুভেচ্ছা রইল। এটা নিশ্চয়ই বলতে হবে না দু’চারটে খোঁচা মেরেছি বলে রাগ করিস না। তুই ‘অটোগ্রাফ’ বা ‘বাইশে শ্রাবণ’ করে নিজের জন্য বা বাংলা সিনেমার জন্য যে বেঞ্চমার্ক সেট করেছিস সেই বেঞ্চমার্ক অনুযায়ী তোর ছবি নিয়ে কথা বলতে পারি। তোর কাছ থেকে শুধু ভালটা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। কারণ তোর বেঞ্চমার্ক অনুযায়ী ভালটা যথেষ্ট নয়। বার বার মনে হচ্ছে যেন বাণিজ্য আর স্কেলের মায়াজালে ‘বাইশে শ্রাবণ’ বা ‘অটোগ্রাফ’য়ের সৃজিতকে খুঁজে পাচ্ছি না।
নম্বর দিলাম না। তোকে নম্বর দেওয়াটা আমার মানায় না। নিজেই দে।
ইতি
মৈনাক
|
|
|
|
|
|