|
|
|
|
ট্যাবে আছি বইমেলাতেও |
ই-বুক যদি প্রেমিকার ছবি হয়, বই রক্তমাংসের প্রেমিকা। তাকে আদর করা যায়। লিখছেন অরিজিৎ চক্রবর্তী। |
বন্ধুদের সঙ্গে আইনক্সে ‘চাঁদের পাহাড়’ দেখতে দেখতেই চিন্তাটা মাথায় এসেছিল বছর তেইশের সৃজার।
বাড়িতে ফিরেই বিভুতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বইটা পড়ে দেখতে হবে। কিন্তু ধুলো ঝেড়ে আলমারি থেকে তো বের করতে হবে বইটা। এত হ্যাপা নেওয়া যাবে না।
কেন যে বাংলা বইটা কিন্ডলে নেই! তা হলে তো দিব্যি ডাউনলোড করে নেওয়া যেত!
বইয়ের দোকান থেকে হাজার হাজার কপি বিক্রি হওয়া ‘দ্য ইম্মর্টাল অব মেলুহা’, ‘রেভোলিউশন ২০২০’ তো জেন ওয়াই পড়ছে। কিংবা কুড়ি লাখ কপি বিক্রি হওয়া ‘শিবা ট্রিলজি’।
কিন্তু এই লাখ-লাখ কপি বই বিক্রি হওয়ার মধ্যে তো ই-বুকও আছে। ট্যাবলেট বা কিন্ডলে পড়ার জন্য ইলেকট্রনিক বই। তার সঙ্গে আছে হাজারো সাইট যেখান থেকে বেছে নিলে বই বাড়ি পৌঁছে যাবে নিখরচায়।
তা হলে গ্যাজেট নির্ভর জেন ওয়াই-য়ের কাছে বইমেলার কী দরকার? সিসিডি-বারিস্তা-আইনক্সের চেনা ছকের বাইরে ক’দিনের জাস্ট একটা আউটডোর ঠেক? |
বইবাজার |
সারা দেশ জুড়ে অসংখ্য লিটারেরি মিট আর সাহিত্য-বিতর্ক আয়োজন করেন মালবিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি কি কখনও এই বিষয় নিয়ে আলোচনা সভা করার কথা ভেবেছেন? “বই নিয়ে এটাই তো সব থেকে বড় আলোচনার বিষয়। তরুণ প্রজন্ম যে ই-বুকের দিকে ঝুঁকছে, সেটা তো সবার কাছে পরিষ্কার। এ বারের কলকাতা লিটারেরি মিট-এ তো এই বিষয় নিয়ে একটা আলোচনা সভা আয়োজন করছি। বিষয়টা থাকবে ই-বুকের যুগে বাংলা সাহিত্য কী ভাবে টিকে থাকবে। বাইরের পাবলিশিং হাউজগুলো তো অনেক দিন ইলেকট্রনিক ভার্সানে বই পাবলিশ করে। বাংলা ইন্ডাস্ট্রিরও তো সেটাই করা উচিত। না হলে জেন ওয়াইয়ের কাছে পৌঁছনো যাবে কী করে,” বললেন মালবিকা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সত্যিই তো, জেন ওয়াই আর তা হলে বইমেলায় যাবে কেন? তবে ই-বুক, অনলাইন বুকস্টোর আসায় বইমেলার দরকার ফুরিয়ে গেছে, মানেন না পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ডের সাধারণ সম্পাদক ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়। বললেন, “না হলে প্রতি বছর বইমেলায় বইয়ের বিক্রি বাড়বে কেন? ই-বুক কিন্তু অল্প কিছু হাতেই সীমাবদ্ধ। ছাপানো বইয়ের বিস্তার সেখানে বিশাল। কিছু দিন আগে আমার এক আত্মীয় আমেরিকা থেকে বেড়াতে এসেছিল। তার মেয়ের জন্য কিছু বাংলা বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ আনিয়ে রেখেছিলাম। সে কিন্তু সব সময় কিন্ডল নিয়ে ঘোরে। ও দেশে তো জায়গার অভাবের জন্য বই কেনাকাটা ই-বুকে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ছাপানো বই হাতে পেয়ে দেখলাম কিন্ডল সরিয়ে রেখে বইতে ডুবে গেছে।” এখনও অনেকের মতেই, বই যে শুধু বইমেলায় কিনতে হবে, তা তো নয়। বইমেলায় ঘুরে বইয়ের একটা ‘উইশ লিস্ট’ বানানো যায়। পরে অনলাইনে অর্ডার দিয়ে বাড়িতে আনিয়ে নেওয়াও চলে।
|
|
সবে ধন
|
তবু বাংলা প্রকাশনে ই-বুকের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। এখনও পর্যন্ত বাংলা ই-বুক বলতে ‘জয় হে’। তা-ও হয়ে গেছে ছ’বছর! আর কোনও নতুন বাংলা বইয়ের ইলেকট্রনিক ভার্সন প্রকাশিত হল না। কেন? পাঠকদের উৎসাহ তো কম ছিল না। অ্যামাজনের সাইটে ‘জয় হে’কে হিন্দি ভাষার বইয়ের মধ্যে থাকায়, ফেসবুক টুইটারে কম কথা শুনতে হয়নি অ্যামাজনকে। প্রথম বাংলা ই-বুকের প্রকাশক দীপ প্রকাশনই বা কেন আর উদ্যোগী হল না? “দেখুন, বাংলা বইয়ের পাঠকের অধিকাংশই থাকেন গ্রাম বা মফস্সলে। সেই পাঠকরা মনে হয় না কিন্ডলে স্বচ্ছন্দ। সব বাংলা বই ইলেকট্রনিক ভার্সানে বের করার এখনই অর্থনৈতিক যুক্তি দেখতে পাচ্ছি না,” জানালেন দীপ প্রকাশনের কর্ণধার দীপ্তাংশু মণ্ডল।
কিন্তু সমাজতত্ত্বেই তো বলা হয়, ‘জেন ওয়াই হল ট্যাবলেট কম্পিউটারে বড় হয়ে ওঠা প্রজন্ম’। তাদের কাছে ই-বুকের জনপ্রিয়তা তো আকাশছোঁয়া হবেই। ফ্লিপকার্টের কর্পোরেট কমিউনিকেশনের প্রধান পায়েল বন্দ্যোপাধ্যায় জানালেন এ পর্যন্ত প্রায় দেড় লাখ ই-বুক ডাউনলোড হয়েছে। বোঝাই যায় ভারতীয় বাজারেও কী ভাবে ঢুকে পড়েছে ই-বুক। শুধু তো ই-বুক নয়। সঙ্গে যোগ হয়েছে অনলাইন বুকস্টোরগুলোও। বই পৌঁছে দিয়ে যাবে বাড়ির দোরগোড়ায়। ট্যাক্সি-ট্রাম ঠেঙিয়ে বইয়ের দোকানে যাওয়ার হ্যাপা নেই। সঙ্গে আবার লোভনীয় ছাড়।
“হ্যাঁ, এই প্রজন্মের অনেকেই এখন বইয়ের ইলেকট্রনিক ভার্সনে চলে গিয়েছে। কিন্ডল বা কোবো-তে পড়ে। কিন্তু বই-ই তো পড়ছে। আসলে এই প্রজন্ম তো ট্যাবলেট পিসি-তে বেড়ে ওঠা প্রজন্ম, এদের টান ই-বুকে থাকবেই। আর সব জায়গা যেমন ‘পেপারলেস’ হওয়ার দিকে এগোচ্ছে, সেখানে ই-বুকে পড়ার মধ্যে আমি অন্তত খারাপ কিছু দেখি না,” বললেন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর মালবিকা সরকার। |
এখনই আশঙ্কা দেখি না
|
ই-বুকের দৌরাত্ম্যে কাগজ-কালির দাম্পত্য ভাঙতে চলেছে, তেমনটা মানেন না শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার। বললেন, “এখনই ছাপা অক্ষরের বইয়ের চাহিদা ফুরিয়ে যাবে, তেমন ভাবার কোনও মানেই হয় না। ছাপা
বই হাতে নেওয়ার যে অনুভূতি সেটা কখনওই ই-বুকে হতে পারে না।
উন্নত দেশগুলোই দেখুন না। সেখানে তো ছাপার বই উঠে যায়নি। ই-পেপারের পাশে পাশে এখনও কিন্তু চলছে
ছাপা সংবাদপত্র। ট্রেনে-বাসে সেটাই অনেক বেশি সুবিধাজনক। তাই আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে এখনই বইমেলার গুরুত্ব নেই তেমনটা বলতে পারব না। অনেক বছর পরে হয়তো এমন একটা দিন আসবে যখন ই-বুকই লোকে বেশি ব্যবহার করবে। তবে এখনই আমি সে রকম কোনও আশঙ্কা দেখছি না।”
একই মত, আনন্দ পাবলিশার্সের সুবীর মিত্র-রও। “কুড়ি বছর পরে কী হবে, তা বলতে পারব না। তবে এখনই বইমেলার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গিয়েছে তা বলতে পারব না। কলকাতা বইমেলা তো শুধু কলকাতার জন্য নয়, এই বইমেলাকে ঘিরে আড়াইশো-র বেশি বইমেলা হয় সারা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে। শহরতলিতে শাখা খোলায় দেখেছি বিক্রি বেড়েছে। লোকে বই হাতে ধরার স্বাদ পেয়ে গেলে সেটা ছাড়তে পারে না। এখানে ই-বুক পাত্তা পাবে না,” বলছিলেন তিনি। |
মুখোমুখি লেখক-পাঠক
|
কিছু দিন আগেই কবি সুবোধ সরকার আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন কবিদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। সে লেখায় শুধু কবিদের দুঃসময়ের কথা ছিল তা নয়। অনলাইন লেখালিখিতে দুঃসময়ের ইঙ্গিত ছিল সব প্রকাশনা নিয়েই। সে প্রসঙ্গে এই সময়ের আর এক জনপ্রিয় কবি শ্রীজাত কী বলেন? তাঁর ফ্যানপেজেও তো নিয়মিত পোস্ট হয় তাঁর কবিতা। অনলাইনে কবিতা পেয়ে গেলে লোকে কেন আর বই কিনবে? “ছাপা বই আর অনলাইনে বই পড়ার সঙ্গে তুলনা চলতে পারে বান্ধবী আর তাঁর ছবির। ছবির চেয়ে বান্ধবী ঢের ভাল,” হাসতে হাসতে বলছিলেন শ্রীজাত। বললেন, “আমিও তো অনেক বই অনলাইনে পড়ি। যে সব বই এ দেশে এখনও এসে পৌঁছয়নি, তার জন্য ই-বুকের দ্বারস্থ তো হতেই হবে। আমিও তো বেঙ্গালুরু কী নয়ডা থেকে ফোন পাই, যারা আমার লেখা শুধু অনলাইনেই পড়েছে। কিন্তু তাই বলে কি বই কিনব না? ভাললাগার বইটা ছাপা অক্ষরে পাওয়া গেলে সবার প্রথমে গিয়ে কিনব। কারণ ওটা সংগ্রহে রাখার জন্য। প্রতিদিন ছুঁয়ে দেখার জন্য। সেটার প্রয়োজনীয়তা কোনও দিন ফুরাবে না। কলকাতা বইমেলা তো শুধু বইয়ের জন্য নয়, ওটা একটা সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রও। আমি বইমেলার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যেতে দেখছি না।”
ছাপার বই। কাগজে কালো কালির রোম্যান্টিসিজম যে এখনও টানে এই প্রজন্মকে ব্যস্ত কলেজ স্ট্রিটই তো তার প্রমাণ। কফি হাউজ পেরিয়ে বাঁ-দিকে সিগনেট প্রেসের ছোট একটা আউটলেট। ভিড় ছাপিয়ে পড়েছে রাস্তায়। ‘চাঁদের পাহাড়’ ছবি হিসেবে মুক্তি পাওয়ার পর থেকে কয়েক সপ্তাহ এটাই তো ছিল প্রতিদিনের ছবি।
তার মানে, শুধু ভাল সিনেমা দেখেই থেমে থাকেনি জেন ওয়াই।
ব্যগ্র হয়েছে বিভুতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাতাত্তর বছর আগের বইয়ের নতুন ছাপার গন্ধ নিতে। |
|
|
|
|
|