|
|
|
|
থাকব শুধু আমরা দু’জন |
দু’জনের রোজগার। ভরপুর মস্তি। সন্তান নেই। দায়-দায়িত্বও নেই। বিন্দাস জীবন। লিখছেন স্রবন্তী বন্দোপাধ্যায়। |
মাতৃত্ব কিংবা পিতৃত্ব না হলে জীবনে পূর্ণতা আসে না এই ধ্যানধারণা এখন তামাদি।
‘তুমি আর আমি’র ছোট্ট সংসারেই ভরপুর সুখের স্বপ্ন দেখছেন আজকের প্রজন্মের দম্পতিদের একাংশ। তাঁদের অনেকেরই মনে হচ্ছে সন্তান মানেই বাঁধা পড়ে যাওয়া। দিনগত পাপক্ষয়। বাচ্চা মানুষ করার লম্বা প্রক্রিয়ায় হারিয়ে যেতে পারে ছেলেটি এবং মেয়েটির জীবনের সমস্ত আমোদ-আহ্লাদ। পায়ে পায়ে সন্তানের মায়ার শেকল পরে চলাটা কোথাও তাঁদের কাছে প্রতিবন্ধকতা।
সন্তান ছাড়াও এক জীবনে অনেক কিছু উপভোগ করার আছে, দেখার আছে এমনটাই মনে করছেন তাঁরা।
শুধু নিজেদের মধ্যে ডুবে থেকেই নাগাল পেতে চাইছেন তাঁরা বৃহত্তর দুনিয়ার।
আটত্রিশ বছরের সুলগ্নার কথা হল, “‘ক্রমশ বড় হতে গিয়ে আমি বুঝতে পারি আমার ভিতরে সেই মাতৃত্ববোধটা একেবারেই নেই, যা দিয়ে আমি অন্য আর একটা শিশুকে মানুষ করতে পারব। এটা ঠিক যে আমি পরিবার চেয়েছিলাম। কিন্তু সেটা কেবলমাত্র স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের নিরিখেই।
আজ আমি তাতেই সুখী।” সুলগ্না পেশায় শিক্ষিকা। তাঁর ব্যাঙ্ক ম্যানেজার স্বামীও দিব্যি মানিয়ে নিয়েছেন এবং সুখে আছেন স্তিরীর নেওয়া সিদ্ধান্তে। দু’জনেই চুটিয়ে উপভোগ করছেন জীবন। বদলে যাওয়া কলকাতার নতুন ধারায় এই বিবাহিত, সন্তানহীন দাম্পত্যের উপস্থিতি এখন খুব বেশি করে নজরে আসছে। দ্বিগুণ আয় হবে সংসারে। কিন্তু সন্তান থাকবে না। অর্থাৎ ‘ডবল ইনকাম নো কিড’ বা ‘ডিঙ্ক’ বলেই চিহ্নিত করা হচ্ছে এই ধরনের দম্পতিদের। পশ্চিমের এই পরিচিত ধারা কলকাতায় কেমন করে প্রকট হল জানতে চাইলে মনোবিদ সুদীপ্তা লাহিড়ি বললেন “বেশির ভাগ মেয়েই এখন চাকরি করছেন বা বাইরে নিজেদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকছেন। ফলে এখন সন্তান আনার প্ল্যানটা এমনিতেই কাজের জন্যে পিছোতে থাকে। হয়তো বা শেষমেশ হয়েও ওঠে না।”
আসলে মাতৃত্ব নিয়ে আগেকার আবেগপ্রবণ ধারনার বদল হয়েছে, বলছেন মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর কথা হল, “আগে মাতৃত্বের মধ্যেই মহিলারা পূর্ণতা খুঁজতেন। এখন কেবল সম্পর্কের নিরিখেই মহিলাদের সৃষ্টিশীল সত্তাকে ধরা হয় না। এখন মহিলারা কাজের মাধ্যমে নিজের সামাজিক অবস্থানকে সুগঠিত করছেন। সৃষ্টির আনন্দ সন্তান উৎপাদনের মধ্যেই আজ আর আটকে নেই। মা না হতে চাওয়া আজ আর কোনও নৈতিক দোষ নয়,” বলেন অনুত্তমা। |
|
এ সব শুনে কিন্তু ভ্রু কুঞ্চিত হচ্ছে বয়োজ্যেষ্ঠদের। তাঁরা শঙ্কিত। “কিন্তু বয়স হলে কে দেখবে? কাদের মধ্যে দিয়ে স্বামী-স্ত্রী বয়সের একাকীত্ব ঘোচাবেন?” প্রশ্ন তুললেন ভবানীপুরের মিত্র বাড়ির কর্তা শ্যামল মিত্র। “আমার পরবর্তী প্রজন্মকে দেখে যাওয়ার মধ্যে যে আনন্দ, তাকে কি এত সহজে মুছে দেওয়া যায়?”
“হয়তো যায়। সেই কারণেই ‘ডিঙ্ক’-এর সংখ্যা এত বেড়ে চলেছে,” বিজ্ঞাপনের কপিরাইটার অভ্রনীলের কড়া জবাব।তাঁর বিশ্লেষণ, “বিবাহিত হলেও গড়পড়তা দাম্পত্য আমাদের কোনও কালেই ছিল না। বাজার, মাসকাবারি এ সব জন্মে করিনি তো ডায়াপার কেনার দায়িত্ব কী করে নেব? আমার স্ত্রী সারা রাত কাজ করে সকালে ঘুমোয়। ও নিশ্চয়ই কাজ বন্ধ করে বাচ্চা মানুষ করবে না। যা সময় এসেছে, একার রোজগারে কিছুই হবে না। তা হলে?” অভ্রনীল এটাও জানিয়ে দেন যে এখনকার লাইফস্টাইল এমন দাঁড়িয়েছে যে বাবা- মা’রই রোজ খোঁজখবরও নিতে পারেন না। তো কী করে ভাববেন যে তাঁর সন্তান বয়সকালে তাঁকে দেখাশোনা করবেন? আর বাচ্চা জন্ম দেওয়ার জন্যে এই বয়সকালের ভরসার যুক্তিটা নিতান্তই খাটো। জেন ওয়াইয়ের অধিকাংশ ছেলেমেয়েই কলকাতার বাইরে বা বিদেশে প্রতিষ্ঠিত হবে। এটাও খুব স্পষ্ট। এ সব কথা ভেবে নিজের দায়িত্বে নিজেকে টিকিয়ে রাখার তাগিদেই সন্তান চাইছেন না নেট যুগের বহু স্মার্ট দম্পতি।
“কলেজলাইফে বাবার পকেট মানি থেকে যা যা করা সম্ভব হয়নি, বিয়ের পরে সেগুলো আমার এই জীবনে অন্তত আমি করতে চাই,” বলছেন এনজিও-র কর্মী ইমন। “বারিস্তার কফি, ক্লাবের লেট নাইট আড্ডা, ব্র্যান্ডেড পোশাক, মান্থলি ফেশিয়াল, একটানা বই পড়া এগুলোকে বাচ্চার জন্যে আমি ছাড়তে চাই না। আর জোর
করে যদি ছাড়তে চাই আমি দেখেছি, তার প্রভাব বাচ্চার ওপরেই পড়বে,” ইমন এমন ভাবেই বেছে নিয়েছেন তার জীবনটা।
বেশি বয়সে ছেলেমেয়ের সহযোগিতার প্রয়োজন কি ফুরিয়ে গেল? যতই ধনী হোন না কেন জীবনের শেষ আশ্রয় কি তা হলে বৃদ্ধাশ্রম? নির্জন ফ্ল্যাটের বারান্দায় দুই বৃদ্ধ-বৃদ্ধার স্মৃতিচারণ। এবং তার পর সেই দু’জনের কোনও এক জনের হঠাৎ বিদায়? জীবনকে পূর্ণ উপভোগ করার পর উত্তরসূরির দিকে চেয়ে জীবনের অর্থ খুঁজে পাওয়ার ধারণাও কি বদলে গেল?
বদলে তো যাচ্ছেই। কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতার শেষ লাইন ‘থাকে শুধু অন্ধকার/ মুখোমুখি বসিবার নাটোরের বনলতা সেন’ এই নিরিখেই শেষ জীবনেও বাঁচবেন এক নারী আর এক পুরুষ। ‘...যেতে পারি কিন্তু কেন যাব? সন্তানের মুখ ধরে একটি চুমো খাব’ এই কবিতার বাৎসল্য টান হয়তো আর তেমন কোনও বিশেষ ব্যঞ্জনা বহন করবে না।
মাতৃত্ব এখন আর ‘মাস্ট’ নয়, বরং ‘অপশনাল’।
পিতৃত্বও তাই।
|
সন্তানহীন দাম্পত্য |
সুখ |
অ-সুখ |
• আর্থিক সচ্ছলতা বাড়ে।
সন্তানের জন্যে কোনও খরচা নেই |
• সন্তানের উপস্থিতি স্বামী-স্ত্রীর
সম্পর্কে নতুন মাত্রা আনে |
• স্বামী-স্ত্রী উভয়ই কেরিয়ারের জন্যে
পর্যাপ্ত পরিমাণে সময় দিতে পারেন |
• কেবল নিজের চাহিদা-সুবিধা দম্পতিদের
পৃথকভাবে স্বার্থপর করে তুলতে পারে |
• বাইরে ব্যস্ত স্বামী-স্ত্রীর বাড়ির
জগতে কাছাকাছি থাকতে পারেন।
পরষ্পরকে যথেষ্ট সময় দিতে পারেন |
• সন্তান উৎপাদন মানুষের স্বাভাবিক ক্ষমতা।
সেটাকে জোর করে বন্ধ করে দিলে দেহের
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কিছুটা হলেও কমে যায় |
তথ্য: ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট সোনিয়া হাসান |
|
|
|
|
|
|