দু’বছরে শোক খানিক সামলে উঠেছেন তিনি। সস্তার ফ্রেমে সোমত্ত জোয়ান ছেলেটার ল্যামিনেট করা পুরনো ছবিটা দেখলে মন একটু টলে যায় ঠিকই, তবে তা দেখে শোকের চেয়েও আশঙ্কা দানা বাঁধে বেশি।
দরমার বেড়ার পাশে মাটির দাওয়ায় বসে প্রায় বৃদ্ধ রিকশাচালক পিতা বলেন, “মন খারাপ কি আর হয় না, তবে
|
রবীন্দ্রনাথবাবু। |
ভয় হয় অন্য কারণে, ছেলের ডেথ সার্টিফিকেটটা আজও পেলাম না তো। সেখানে আবার কী বয়স লেখে দেখি!” তাঁর আশঙ্কা, বয়সের বিড়ম্বনা নিয়েই শেষতক ছেলের হত্যায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলাটা হেরে না যান।
শঙ্কাটা অমূলক নয়। ২০১২ সালের ১৯ জুন রাতে বাড়ির প্রায় দোড়গোড়ায় জনা কয়েক বন্ধুর সঙ্গে হাতাহাতির জেরে বেঘোরে খুন হয়ে গিয়েছিলেন সোমনাথ বিশ্বাস। কিন্তু হাসপাতাল কিংবা মর্গ থেকে যে কাগজপত্র হাতে পেয়েছিলেন বৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথ তার কোনওটিতেই ছেলের বয়সটা ঠিকঠাক দেওয়া ছিল না। কোথাও ৩২, কোথাও বা ৩৫। রবীন্দ্রনাথ বলেন, “কিন্তু ছেলে তো খুন হল ৩৮ বছর বয়সে। বয়সের এই গেরোতেই মামলাটা না হেরে যাই!” তারপর বিড় বিড় করেন, “নিজের চোখের সামনে ছেলেকে খুন হতে দেখেছি। দোষীরা শাস্তি না পেলে আমার শান্তি নেই বাবা, মামলাটা কোনও মতেই হারলে চলবে না।”দেড় বছর আগে খুন হয়ে ছিলেন শান্তিপুরের সুত্রাগড় সাহাপাড়ার সোমনাথ। বাড়ির কাছেই সে রাতে পিকনিক করেছিলেন বন্ধু-বান্ধব মিলে। কিঞ্চিৎ মদ্যপানও বা করেছিলে হয়তো। পিকনিক শেষে টালমাটাল অবস্থা বচসা বেধেছিল সঙ্গী সাথীদের সঙ্গে। সেই সময়ে হাতাহাতি, গুরুতর জখম সোমনাথকে প্রথমে ভর্তি করা হয়েছিল শান্তিপুর স্টেট জেনারেল হাসপাতালে পরে ‘রেফার’ করা হয় শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে। সেখানেই পর দিন মারা যান তিনি।
শক্তিনগর পুলিশ মর্গে ময়না-তদন্তের পর জেলা হাসপাতালের সার্টিফিকেট নিয়ে শান্তিপুর শ্মশানে দেহ সৎকারও হয়ে গিয়েছিল। দিন কয়েক পরে ময়না-তদন্তের রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পরই টনক নড়ে বাড়ির লোকের। বয়স তো ঠিক লেখা নেই!
রবীন্দ্রনাথবাবু জানান, হাসপাতালের খাতায় ছেলের বয়স উল্লেখ রয়েছে ৩২। আর ময়নাতদন্তের কাগজে ৩৫। বয়সের এই তারতম্যের জন্যই স্থানীয় শান্তিনগর পুরসভাও সোমনাথের ডেথ সার্টিফিকেট দিতে চাইছে না বলে দাবি তাঁর বাবার। রবীন্দ্রনাথবাবু বলেন, “আমার ছেলের প্রকৃত বয়স ৩৮ বছর। পুরসভার কর্মীরা আমাকে জানান, যেহেতু আমার ছেলের বয়স এক এক জায়গায় এক এক রকম আছে তাই আমাকে সেটা সংশোধন করে নিয়ে আসতে হবে। না হলে তাঁরা ‘ডেথ সার্টিফিকেট’ দেওয়া যাবে না।” আর এর পর থেকেই শুরু হয় রবীন্দ্রনাথবাবুর হয়রানি। স্বাস্থ্য দফতর থেকে শুরু করে পুলিশ-সব জায়গাতেই ছুটেছেন তিনি। কিন্তু এগিয়ে এসে ব্যাপারটা সংশোধন করে দেওয়ার দায় নিতে চাননি কেউই।
|
সোমনাথ বিশ্বাস। |
ছেলের ডেথ সার্টিফিকেটের খোঁজে বৃদ্ধ রিকশাচলকের পরিভ্রমণ শুরু হয়েছিল শান্তিপুর হাসপাতাল থেকে। তিনি বলেন, “কৃষ্ণনগর পুরসভার কর্মীদের কথা মতো আমি যাই শান্তিপুর হাসপাতালে। সেখানকার সুপার ছেলের ভোটের সচিত্র পরিচয় অনুযায়ী হাসপাতালের সার্টিফিকেটে বয়স লিখে দেন ৩৮ বছর। সেটা নিয়ে আমি দেখা করি শক্তিনগর জেলা হাসপাতালের সুপারের সঙ্গে। সব শুনে তিনি আমাকে লিখিতভাবে আবেদন করতে বলেন এবং আমাকে হাসপাতালের রেকর্ড সেকশনে পাঠান। কিন্তু সেখানকার এক কর্মী বলেন, তাঁদের পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। আমি যেন হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টারের কাছে যাই।” ওয়ার্ড মাস্টার জানিয়েছিলেন, তাঁর পক্ষে কিছু করা অসম্ভব। ময়নাতদন্তের ঘরে কথা বলতে হবে। ময়নাতদন্তের কর্মীরা পরিষ্কার জানিয়ে দেন, তাঁরা কিছুই করতে পারবেন না। রবীন্দ্রনাথবাবু বলেন, “আমাকে এ বার পাঠানো হয় কোতোয়ালি থানায়। সেখানে বলেন, সমস্ত কাগজপত্র নিয়ে গিয়েছেন শান্তিপুর থানার তদন্তকারী অফিসার। তাঁর পক্ষে কিছু করার নেই।” শান্তিপুরের সিআই ওই তদন্তকারী অফিসারের (আইও) কাছে পাঠান। কিন্তু সেই আইও স্পষ্ট বলে দিয়েছিলেন, বয়স ‘শুধরে’ দেওয়ার ক্ষমতা তাঁর নেই।
এরপর নিরুপায় হয়ে জেলার পুলিশ সুপারকে সমস্ত প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সহ ডাক যোগে চিঠি দিয়ে সমস্যার সমাধানের জন্য আবেদন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। উত্তর না পেয়ে শেষতক দরবার করেন জেলা সুপারের কাছে। মাস কয়েক পরে এসপি অফিসে গিয়ে তিনি জানতে পারেন, তাঁর দরখাস্তই হারিয়ে ফেলেছেন কর্মীরা। এবার জেলা পুলিশ সুপারের সঙ্গে দেখা করেন তিনি। সব শুনে এস পি’র রায় ছিল, ‘এই সমস্যার মেটাতে পারবেন একমাত্র জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক।’ রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাছেও ছুটেছিলেন। তিনি দায় ঠেলে দেন জেলাশাসকের কাছে। সেই আবেদন জানিয়ে জেলাশাসকের কাছে আবেদন করেছেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর কথায়, “এ বার তিনি কোথায় ঠেলেন দেখি!”
জেলার পুলিশ সুপার সব্যসাচীরমণ মিশ্র বিলেন, “ডেথ সার্টফিকেটের সঙ্গে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। এটা একান্ত ভাবেই স্বাস্থ্য দফতর আর সাধারণ প্রশাসনের বিষয়।” জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক অধীপ ঘোষ অবশ্য রবীন্দ্রনাথ বাবুকে জেলা শাসকের কাছে পাঠানোর বিষয়টি স্বীকার করেননি। তিনি বলেন, “এমন কোনও ঘটনা আমি জানি না।”
আর সব শুনে জেলাশাসক পি বি সালিম বলেন, “ওই ভদ্রলোক যে ভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন তা দুঃখজনক। তিনি যদি প্রয়োজনীয় সমস্ত কাগজপত্র নিয়ে আমার কাছে আসেন তাহলে আমি তার ব্যবস্থা করে দেব।” রবীন্দ্রনাথবাবু শুধু বলছেন, “হবে তো, হলেই ভাল।” |