বলির বৃক্ষ ১ উন্নয়নের হাতে ‘ছিনতাই’
সবুজ, চিন্তা বিশেষজ্ঞদের
গরের প্রান্ত ঘেঁষা চোখ জুড়ানো সবুজ যেন আচমকা দাবানলে ছাই!
সন্তোষপুর কানেক্টর থেকে শহিদ ক্ষুদিরাম মেট্রো স্টেশন। ইস্টার্ন মেট্রোপলিটন বাইপাসের দু’কিলোমিটার অংশের দু’ধার এই সে দিনও ছেয়ে থাকত কৃষ্ণচূড়া-বাবলা-শাল-সেগুনের ভিড়ে। মাঝের বুলেভার্ডও ভরা ছিল গাছ-গাছালিতে। সব বেবাক গায়েব। উন্নয়নের স্বার্থে হাজারখানেক গাছ কাটা পড়ায় গোটা তল্লাট বিলকুল ন্যাড়া হয়ে গিয়েছে।
এবং সেই ক্ষতি ভবিষ্যতে পুষিয়ে যাবে, এমন আশ্বাসও বিশেষ মিলছে না। আইন মোতাবেক, একটা গাছ কাটলে পরিবর্তে পাঁচটা নতুন গাছ রোপণ করার কথা! কিন্তু ওখানে কোথায় ক’টা নতুন গাছ পোঁতা হয়েছে, রাস্তা সম্প্রসারণ ও মেট্রো রেলের কাজে যুক্ত নির্মাতা সংস্থারা সে হদিস দিতে পারছে না। আসলে দুই প্রকল্পের কাজে গত তিন বছরে ঠিক কত গাছ কাটা পড়ল, তার কোনও হিসেব কেএমডিএ বা মেট্রো রেলের কাছে নেই।
অতএব, সবুজ-সম্পদের লোকসান পূরণেরও প্রশ্ন নেই। গাছ যদি না-ও থাকে, সমস্যাটা কোথায়?
বাইপাসের কিছু অংশে এখনও যে সব গাছ রয়েছে, সেগুলোর হাল দেখলেই উত্তর মেলে। তাদের পাতার উপরে কালো আস্তরণ। তাতে ধোঁয়া, কার্বন, কালি, কুয়াশা সব মিলেমিশে একাকার। বাতাসের বিভিন্ন দূষিত কণা টেনে পরিবেশকে নির্মল করাই যে ওদের কাজ! কিন্তু যেখানে তারা নেই, সেখানে দূষিত কণা যাচ্ছে কোথায়?
প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ-বিজ্ঞানী শরদিন্দু চক্রবর্তী বলেন, “কোথায় আবার? বাতাসেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর সুযোগ পেলেই নাক-মুখ দিয়ে ঢুকে পড়ছে মানুষের শরীরে। বাসা বাঁধছে শ্বাসযন্ত্রে, ফুসফুসে। শ্বাসনালিতে ওই কালো ধোঁয়া জমছে। যা বিষেরই নামান্তর।”
কলকাতার বাতাসে ক্যানসারের বিষ ভাসছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র সাম্প্রতিক হুঁশিয়ারিটিও এ প্রসঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন শরদিন্দুবাবু। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্রিটেনের লিড্স বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ সমীক্ষাতেও অশনি সঙ্কেত। সমীক্ষা-রিপোর্টের বক্তব্য: কলকাতার পরিসর দিন দিন যে ভাবে বাড়ছে, যে ভাবে বাইরের জনস্রোত বিপুল বহরে আছড়ে পড়ছে, গাড়ি বাড়ছে, আর উল্টো দিকে যে হারে গাছ কাটা পড়ছে, তাতে ২০২৫-এ মহানগরের বাতাসে কার্বনের মাত্রা এখনকার তুলনায় ২৫% বেড়ে যাবে।
এ হেন প্রেক্ষাপটে কলকাতায় সবুজ সৃষ্টি, তার পরিচর্যা ও সংরক্ষণ অত্যন্ত জরুরি বলে রায় দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞেরা। পরিবেশবিদ প্রণবেশ সান্যাল জানাচ্ছেন, বটের মতো গাছ দূষণ কমাতে যথেষ্ট সাহায্য করে। অথচ এ শহরে সে সব লাগানোর পর্যাপ্ত জায়গাই নেই। ন্যাশনাল আর্বান ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের তথ্য উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, “কলকাতার মতো শহরে যেখানে কম করে ২০% এলাকা জুড়ে পার্ক বা উদ্যান থাকা উচিত, সেখানে আছে সাকুল্যে ৫%!” পুরসভাও অসহায়। “মূল কলকাতায় নতুন করে পার্ক তৈরির জায়গাই তো অবশিষ্ট নেই!” মন্তব্য কলকাতা পুরসভার মেয়র পারিষদ (উদ্যান) দেবাশিস কুমারের। যদিও ১০১ থেকে ১৪১ নম্বর ওয়ার্ড পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে নতুন নতুন পার্ক বানানো হচ্ছে বলে জানিয়ে তাঁর দাবি, গত তিন বছরে পুরসভার সংযোজিত এলাকায় অন্তত তিরিশটি নতুন পার্ক তৈরি হয়েছে।
এতে সবুজ-চাহিদার কতটুকু মিটবে?
প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় বিকল্প শক্তি মন্ত্রকের উপদেষ্টা শান্তিপদ গণচৌধুরীর বক্তব্য: নিজস্ব জনসংখ্যা, বাইরে থেকে রোজ আসা মানুষের সংখ্যা ও রাস্তায় দৈনিক গাড়ির সংখ্যার তুলনায় কলকাতায় গাছের সংখ্যা নগণ্য। ২০১১-র জনগণনা অনুযায়ী, কলকাতার জনসংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। পুর-নথি বলছে, রোজ অন্তত ৬০ লক্ষ লোক বাইরে থেকে আসেন। আর কলকাতা পুলিশের হিসেবে, রোজ গড়ে ১৪ লক্ষ গাড়ি শহরে চলাচল করে। “এত মানুষ ও গাড়ি থেকে নির্গত কার্বন ডাই অক্সাইড শুষে নিতে হলে কলকাতার প্রতি কিলোমিটার রাস্তায় গড়ে চারশো গাছ থাকা দরকার।” বলেন শান্তিপদবাবু।
চারশো হয়তো সম্ভব নয়। কিন্তু বাস্তবের গাছ-সংখ্যা তো এর প্রায় দশ গুণ কম! কোনও সুরাহা নেই?
সুরাহার সূত্র থাকলেও তা কাজে লাগানোর তেমন সদিচ্ছা নেই বলে অভিযোগ। পরিবেশবিদেরা জানিয়েছেন, নির্বিচার বৃক্ষছেদন রুখতে ২০০৬-এ পশ্চিমবঙ্গ সরকার একটা আইন বানিয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, কোনও ব্যক্তি একটা গাছ কাটলে তাঁকে দু’টো গাছ লাগিয়ে ক্ষতি পোষাতে হবে। কিন্তু কোনও নির্মাতা নির্মাণকাজের স্বার্থে একটা গাছ কাটলে পরিবর্তে বসাতে হবে পাঁচটা। সেই ‘ডেভেলপার’ হতে পারে কোনও প্রোমোটার কিংবা কোনও নির্মাণসংস্থা। এমনকী সরকারি দফতর হলেও নিয়মটি মানতে হবে বলে আইনে পরিষ্কার করে দেওয়া হয়েছে।
সেই আইনই কার্যকর হচ্ছে না। রাজ্য বন দফতর এ বছর বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ডেভেলপারকে গাছ কাটার অনুমতি দিয়েছে। কাটা গাছের পাঁচ গুণ নতুন গাছ লাগানোর কথা। কিন্তু তা আদৌ কার্যকর হবে কি না, সে সম্পর্কে পরিবেশবিদ মহলই ঘোরতর সন্দিহান। পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্তের আক্ষেপ, “সরকার নিজের প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রেই নিয়ম মানছে না! নাগরিকদের আইন মানাবে কী করে?”

বলির বৃক্ষ ১
কলকাতায় রাস্তার মোট দৈর্ঘ্য ১৮৫০ কিলোমিটার
কিলোমিটারপিছু গাছের সংখ্যা
৪৩
সেই হিসেবে শহরে মোট গাছ প্রায় ৮০ হাজার
প্রজাতি ২১৯
কৃষ্ণচূড়া ১৯% (সর্বাধিক)
বট ১৭%
বটের মতো গাছ দূষণ রোধে বেশি সহায়ক।
সূত্র: কেএমডিএ।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.