প্রবন্ধ ২...
উজ্জীবনের বার্তাবাহক
দেশ-জাতি, সর্বোপরি মানুষের উজ্জীবনে বিবেকানন্দের নিরন্তর নিরলস ভূমিকা প্রতিদিনই তাঁকে ব্যাপ্ত করেছে নতুন ভাবে, নতুন মাত্রায়। আসলে অ-সুখের, অ-সত্যের, অ-ধর্মের অ-বিচারের গভীরে পৌঁছে তিনি আবিষ্কার করেন জীবন অন্বেষায় উত্তরণের উজ্জ্বল পথ— আজকের সমাজে যা অপরিহার্য।
“ওঠো, জাগো, নিজের লক্ষ্যে না পৌঁছনো পর্যন্ত থেমো না।” মুমূর্ষু, সংশয়াচ্ছন্ন, নিস্তেজ, পিছিয়ে-পড়া মানুষের উদ্দেশে এটিই ছিল দীপকতানে বিবেকানন্দের আহ্বান। সদর্থক সব কাজে সকল মানুষকে উজ্জীবিত করাই তাঁর প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য। ফলিত বেদান্তের সূত্রে জীবনে জীবন যোগ করার প্রত্যয়, দীর্ঘ ভারত পরিক্রমায় লব্ধ অভিজ্ঞতা, দু’দুবার প্রতীচ্য প্রব্রজ্যায় সুসভ্যতার সৃজন ও বিনাশের জিজ্ঞাসার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ভিতরে-বাহিরে সংগ্রামে উদ্দীপিত হয়েছেন এবং করেছেনও।
প্রসঙ্গত, সুভাষচন্দ্র বসুর কথা অবশ্যই উল্লেখ করা প্রয়োজন। বিবেকানন্দের সঙ্গে তাঁর মুখোমুখি সাক্ষাৎ হয়নি, তা সত্ত্বেও তিনি তাঁর মানসপুত্র। আর বিবেকানন্দ তাঁর চিরকালীন আচার্য। বিবেকানন্দের উদ্দীপনা-সঞ্চারী আহ্বানে সুভাষচন্দ্র জীবন গঠনে ত্যাগ-মানবসেবার মহাযজ্ঞে অংশগ্রহণে বা স্বাধীনতা আন্দোলনে আজাদ হিন্দ বাহিনীর নেতৃত্বদানে কিংবা ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে সম্মুখসমরে অবতীর্ণ হয়েছেন। বিবেকানন্দ ঘোষণা করেছিলেন যে, স্বাধীন ভারতবর্ষের ছবিটা যদি নিখুঁত করে গড়ে তুলতে হয়, তাতে যদি কিছু রক্ত ঝরে ঝরুক। সুভাষচন্দ্রও কি বলেননি, “তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব”? সুভাষচন্দ্রের দেশনায়ক হওয়ার ক্ষেত্রে বিবেকানন্দের প্রভাব সুস্পষ্ট।
আজ স্বামী বিবেকানন্দের ১৫২তম জন্মতিথি
গাঁধীর অহিংসা-সত্যাগ্রহ-সর্বোদয় সংশ্লেষিত গণ আন্দোলন, বা উগ্রপন্থী বিপ্লবী যুবকদের আন্দোলনও ছিল বিবেকানন্দের দ্বারা বিশেষ ভাবে প্রভাবিত।
শুধু স্বাধীনতা অর্জনই নয়, দেশগঠন, শান্তিশৃঙ্খলা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও জাতীয় সংহতি অক্ষুণ্ণ রাখার ক্ষেত্রে বিবেকানন্দ প্রখর সূর্যের উত্তাপ ছড়িয়ে বলেন, “বলো ভারতবাসী আমার ভাই, ভারতবাসী আমার প্রাণ।” এই আহ্বান আধুনিক ভারতবর্ষে উত্তরণের মহাঋক্। ‘যৌবনের উপবন, বার্ধক্যের বারাণসী’ তাঁর প্রিয় ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষের জাগরণে উত্থান ও উন্নতি, পুনর্গঠন ছিল তাঁর বিশেষ কাম্য— “নূতন ভারত বেরুক, বেরুক চাষার কুটির থেকে, জেলে, মালো, মুচি, মেথরের ঝুপড়ির মধ্য থেকে, ভুনাওয়ালার উনুনের পাশ থেকে...”। মনে রাখতে হবে, এর আগে বৈদান্তিক সাম্যবাদে বিশ্বাসী বিবেকানন্দ অভিজাত-শোষক অত্যাচারী সামন্ততন্ত্রের অবসান চেয়েছেন আন্তরিক ভাবেই— তোমরা শূন্যে বিলীন হও”।
শিক্ষার মধ্য দিয়ে চৈতন্যানুভূতি ও চৈতন্যের সম্প্রসারণ— তাতেই গড়ে ওঠে যথার্থ মানুষ। কেতাবি ডিগ্রিধারী শিক্ষায় নয়, সর্বস্তরের মানুষ গড়ার শিক্ষাকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন বিবেকানন্দ। সাম্প্রতিক শিক্ষার বিঘ্নিত লক্ষ্য এবং বিপর্যস্ত শিক্ষাকেন্দ্র— সঙ্কটের এই আবর্ত থেকে বিবেকানন্দের ‘ম্যান মেকিং এডুকেশন’-এর হাত ধরেই আমাদের বেরিয়ে আসা সম্ভব। ভারতবর্ষের মানুষের দুর্গতি-অধঃপতনের কারণ রূপে তিনি চিহ্নিত করেন—
ক) নারীশক্তিকে অবহেলা।
খ) সাধারণ মানুষের উপর বেহিসেবি পীড়ন। প্রতীচ্যে নারীশিক্ষা, নারীস্বাধীনতা, নারী সচেতনতার প্রবাহ এবং অতীত ভারতে নারীদের ঐতিহ্যের সমন্বয়ে এ দেশে নিবেদিতার মাধ্যমে নারীশিক্ষাকে জোরদার করা এবং পাশাপাশি শ্রীমা সারদাকে কেন্দ্র করে সদর্থক নারী আন্দোলনে গুরুত্ব আরোপ— উজ্জীবনের মহানায়কের ছিল তীব্র এষণা।
অমৃতস্বরূপ অজ্ঞ-কাতর দরিদ্র মানুষের জীবনে আলো-হাওয়া-জল পৌঁছে দিয়ে, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে স্বাবলম্বী করার দায়িত্ব তিনি অর্পণ করে গিয়েছেন যুবক-যুবতীদের উপর। বিবেকানন্দের সমাজ পরিবর্তনের কাঙ্ক্ষিত ঋত্বিক এরাই। তাদের কাছে তাঁর সহস্রাধিক আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং সঙ্গে সঙ্গে দুর্বার-দুর্মর অগ্নিবর্ষী আহ্বানও— “যুবকবৃন্দ...আর কিছুরই আবশ্যক নেই, আবশ্যক শুধু প্রেম, সরলতা, সহিষ্ণুতা। জীবনের অর্থ বিস্তার, সংকোচই মৃত্যু।”
স্বামীজির আহ্বানে যারা গোটা জীবনকে উৎসর্গ করে সন্ন্যাসী হবেন, তাঁদেরও শুনিয়েছেন সাবধানবাণী।
ক) গেরুয়া ভোগের জন্য নয়, ত্যাগের প্রতীক (শিষ্য শরৎচন্দ্র চক্রবর্তীর সমীপে)।
খ) যাঁরা সন্ন্যাসী তাঁদের পরের কল্যাণের জন্য চেষ্টা করতেই হবে। কারণ, সন্ন্যাসী বলতে তাই বুঝিয়ে থাকে...সাংসারিক মানুষেরা বাঁচতে ভালবাসে। সন্ন্যাসীদের মৃত্যুকে ভালবাসতে হবে। (দ্বিতীয়বার প্রতীচ্যে যাবার প্রাক্মুহূর্তে বেলুড় মঠে সতীর্থদের উদ্দেশে)।
‘আত্মনো মোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ’, ‘পরহিতায়’ জীবনপাত, জীবন সমর্পণ— ‘জীবন উৎসর্গ বৃহতের জন্য’, ‘মৃত্যু যখন অবশ্যম্ভাবী তখন ভাল কাজের মধ্য দিয়ে প্রাণত্যাগই শ্রেয়।’ এ সবই উজ্জীবনের বার্তা।
এক দিকে বিজ্ঞান ও কারিগরি প্রযুক্তির প্রভূত উন্নতি, অন্য দিকে লৌকিক জীবনে অলৌকিকতা, কুসংস্কারের আশ্রয়ে জাগতিক সুখলাভের মিথ্যা উপায় অনুসরণ, তথাকথিত রাজনৈতিক মতাদর্শ, নাস্তিক-দার্শনিকের নিরন্তর অপব্যাখ্যায় প্রকৃত ধর্ম সম্পর্কে মানুষের ধারণা গড়ে ওঠেনি, উঠতে পারেনি। এ ক্ষেত্রেও বিবেকানন্দ বিশেষ ভাবে আমাদের উজ্জীবিত করেন। খুব কম কথায়, সহজে তাঁর উপস্থাপন— অন্তর্নিহিত দেবত্বকে জানাই ধর্ম। ধর্ম মানুষকে পশুত্ব থেকে দেবত্বে উন্নীত করে। অর্থাৎ একই জীবনে অন্তর্বিপ্লব বা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে মানুষের ‘দেবতা’ হয়ে ওঠাকেই স্বামীজি ধর্ম বলতে চান। দেবতা আকাশ থেকে আবির্ভূত হবেন না, মাটি ভেদ করেও উঠবেন না। পরমব্রহ্ম যিনি, তিনি অণু-পরমাণুসহ জীবে জীবে অধিষ্ঠিত।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.