বাংলাদেশে নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে, দশম জাতীয় সংসদ গঠিত হয়েছে, কিন্তু শান্তি ও সুস্থিতি ফেরেনি, সংঘাতের অবসান হয়নি। ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। যে দিক থেকেই বিচার করা হোক, একটা ব্যাপার স্পষ্ট। গত কয়েক মাসে নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে যে রাজনৈতিক অশান্তি দেখা গেছে, তা জনজীবনকে বিপর্যস্ত করেছে, সামাজিক কাঠামোয় প্রবল আঘাত করেছে, অর্থনীতির প্রভূত ক্ষতি সাধন করেছে। এবং সবচেয়ে বড় কথা, একটা টগবগে দেশ ও সমাজ এই ঘটনাবলিতে যেন সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত। বেশির ভাগ পর্যবেক্ষক মনে করেন, অবিলম্বে এমন একটা উপায় বের করা দরকার, যাতে দেশ আরও বড় বিপর্যয়ের পথে না চলে যায়। দেশে এবং দেশের বাইরে অনেকেই তাই নতুন করে বাংলাদেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের পারস্পরিক ‘আলোচনা’ শুরু করার ওপর জোর দিচ্ছে, তাদের মধ্যে আছে পশ্চিম দুনিয়ার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দেশের সরকার, আছে রাষ্ট্রপুঞ্জও। ‘রাজনৈতিক কথোপকথনের বিশেষ গুরুত্ব’ বিষয়ে জোর দিয়ে মার্কিন সেনেট সম্প্রতি একটি প্রস্তাব অনুমোদন করেছে।
দুঃখের কথা হল, এদের মতে, নতুন করে নির্বাচনের আয়োজনই কথোপকথন প্রক্রিয়ার প্রধান ভিত্তি। আমি মনে করি, বাংলাদেশের বর্তমান সংকটকে কেবল নির্বাচনের প্রেক্ষিতে দেখলে মস্ত ভুল হবে। বৃহত্তর প্রেক্ষিতটিকে অগ্রাহ্য করা হলে আওয়ামি লিগ এবং বি এন পি’কে নির্বাচনী প্রতিযোগিতায় শামিল করানোর চেষ্টা ব্যর্থ হবে, এটা প্রায় অবধারিত। বস্তুত উল্টো ফল হতে পারে— দু’পক্ষই আরও বেশি অনমনীয় অবস্থানে চলে যেতে পারে।
প্রথম প্রশ্ন, বি এন পি কেন ভোট বয়কট করল? সত্যিই এই আশঙ্কাতেই যে, ক্ষমতাসীন সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন হলে কারচুপি হবে? বিশ্বাস করা কঠিন। কারণ তা হলে তো কিছু দিন আগেই বিভিন্ন শহরের পুরনির্বাচনে তারা যোগ দিত না। |
ওই সব নির্বাচনে অনেক ক্ষেত্রেই বি এন পি খুব ভাল ফলও করেছিল। তবে কি অন্য কারণ ছিল? তাদের মনে কি অন্য কোনও ভয় কাজ করছিল? সেটা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে বলেই মনে করি। ভোটের আগে নানা জনমত সমীক্ষায় পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল যে, বি এন পি’ই জয়ী হবে। ক্ষমতায় আসার এমন সুবর্ণসুযোগ ছেড়ে দেওয়ার পিছনে আসলে অন্য কারণ ছিল। সেই কারণগুলো ভাল করে বিচার করা দরকার। এবং একটা মূল কথা সেই বিচারের সময় মনে রাখা দরকার, বর্তমান বাংলাদেশের সমস্ত সংকটের মূলটা কিন্তু লুকিয়ে আছে দেশটার জন্মের মধ্যেই, অর্থাৎ উনিশশো একাত্তরের মধ্যে। একাত্তরকে ঠিক ভাবে না বুঝলে আজকের বর্তমানটাকেও বোঝা অসম্ভব। সম্ভবত এ বার বি এন পি’র ভোট বয়কটের সবচেয়ে বড় কারণ: দেশের প্রধান ইসলামপন্থী দল জামাত-এ-ইসলামির সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা। নির্বাচন বানচাল করার জন্য বিরোধীদের সমস্ত রকমের চেষ্টায় জামাত এবং তার ছাত্র সংগঠন ছাত্র শিবির যে ভূমিকা নিয়েছিল, তাতেই এই ধারণা জোরদার হয়। এর আগের দুটি নির্বাচনে সাফল্যের জন্য জামাতের সমর্থন বি এন পি’র দরকার ছিল। কিন্তু এ বার জামাত সেই সমর্থনের মূল্য বুঝে নিতে বদ্ধপরিকর, যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্তদের বিচারের যে প্রক্রিয়া চলছে, ভোটে জিতলে তা অবশ্যই বন্ধ করে দিতে হবে, বি এন পি’র কাছে এটাই ছিল তাদের আপসহীন দাবি। মনে রাখতে হবে, অভিযুক্তদের অধিকাংশই মুক্তিযুদ্ধের সময় জামাতের প্রথম সারির নেতা ছিলেন। সম্প্রতি জামাতের ভোটে দাঁড়ানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে আদালত যে আদেশ দিয়েছে, তা প্রত্যাহার করার কাজেও বি এন পি’র সাহায্য জামাতের দরকার। জামাতের ভয় ছিল, আওয়ামি লিগ ক্ষমতায় ফিরে এলে তাদের নিষিদ্ধ করতে পারে। এই ভয় অমূলক নয়, কারণ দেশের বহু মানুষ এই নিষেধাজ্ঞা চান।
অর্থাৎ জামাতের শর্তগুলি এমন দুটি বিষয়ের সঙ্গে জড়িত, যেগুলি বাংলাদেশের জন্মকাল থেকে দেশের সমাজকে আড়াআড়ি দুটি ভাগ করে রেখেছে। একাত্তরের ঘটনাবলির সুতীব্র অভিঘাত থেকেই এই বিষয়গুলির উদ্ভব। এবং এই জায়গাটা গভীর ভাবে বিচার না করলে আওয়ামি লিগ ও বি এন পি’র মধ্যে অর্থবহ কথোপকথন গড়ে তোলা সম্ভব নয়, তাদের নতুন নির্বাচনে শামিল করাও যাবে না।
যে দুটি বিষয় সমাজকে দু’ভাগে ভাগ করে রেখেছে, সেগুলি হল: এক) যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রয়োজনীয় কি না, অর্থাৎ একাত্তরে যারা নারকীয় অত্যাচারের নেতৃত্ব দিয়েছিল তারা এত কাল যে ভাবে শাস্তি থেকে রেহাই পেয়ে এসেছে, সেই ইতিহাসের অবসান জরুরি কি না; দুই) ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সাম্প্রদায়িক ঐক্যের যে আদর্শ মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকার, যে আদর্শ ১৯৭২ সালে গৃহীত জাতীয় সংবিধানের অন্যতম প্রধান ভিত্তি, রাজনীতিতে ধর্মকে যথেচ্ছ ভাবে ব্যবহার করে সেই আদর্শ লঙ্ঘন করা যায় কি না। দুটি প্রশ্নই স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে জড়িত, তাই দেশের মানুষের বিশ্বাসের সঙ্গেও তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।
১৯৯০ সালে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর থেকে একের পর এক সরকার এই মৌলিক প্রশ্নগুলির মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়েছে। অনেকেরই মতে, আওয়ামি লিগ যুদ্ধাপরাধের বিচার ও ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িকতা ও সামাজিক ন্যায়ের প্রসারে নিজেকে দায়বদ্ধ বলে ঘোষণা করেছিল বলেই ২০০৮-এর নির্বাচনে তার বিপুল জয় সম্ভব হয়। বিশেষ লক্ষণীয়, এই দুটি দাবিতে সবচেয়ে বেশি মুখর হয়েছে কিন্তু তরুণ প্রজন্ম, যাদের জন্ম একাত্তরের পরে। মুক্তিযুদ্ধের অন্তর্নিহিত মূল্যবোধগুলি আজও এতটাই জোরদার।
সুতরাং অস্বাভাবিক নয় যে, ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামি লিগ যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করে। এই সরকারের জনপ্রিয়তার এটাই প্রধান ভিত ছিল, আজও তা-ই আছে। ‘শাহবাগ’ আন্দোলনই এর প্রমাণ। মুক্তিযুদ্ধের সময় নৃশংস অত্যাচারের নায়ক হিসেবে পরিচিত ব্যক্তিকে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনাল লঘু দণ্ড দেওয়ার বিরুদ্ধে তরুণ সমাজের প্রবল প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে এই আন্দোলনের সূচনা হয়। আজ শাহবাগ গণজাগরণ আন্দোলন দেশের সবচেয়ে সরব এবং প্রবল শক্তিগুলির অন্যতম, কার সাধ্য তাকে অগ্রাহ্য করে!
অতএব? যাঁরা বলছেন, যুদ্ধাপরাধ বিচার নিয়ে আর দাবি তোলার দরকার নেই, যা হয়ে গেছে, হয়ে গেছে, ভুলে যাওয়াই ভাল, তাঁদের কথা বাংলাদেশে চলবে না। বিচার শুরু হওয়ার পরে ন্যায়ের দাবি উত্তরোত্তর জোরদার হয়েছে। গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত নাতসিদের যে ভাবে আজও, ঘটনার সাত দশক পরেও, ইহুদিরা খুঁজে খুঁজে বের করছেন, কাঠগড়ায় তুলছেন, ততটা সামর্থ্য হয়তো বাংলাদেশি বিচারপ্রার্থীদের নেই, কিন্তু তাঁদের নিষ্ঠা কোনও অংশে কম নয়। ষাট বছরেরও বেশি আগে ইজরায়েল সৃষ্টির ফলে দেশহারা প্যালেস্তাইনিদের তীব্র আবেগের সঙ্গেও বাংলাদেশের মানুষের আবেগের তুলনা করা চলে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে সহজেই বোঝা যায়, যুদ্ধাপরাধের বিচার এবং ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্ন দুটিতে আওয়ামি লিগ নিজের অবস্থান পালটাতে চাইবে না। জাতীয় রাজনীতির মূলস্রোতে ফিরতে চাইলে, একটি মধ্যপন্থী রাজনৈতিক দল হিসাবে নিজেকে ধরে রাখতে চাইলে বি এন পি’কেই এই বিষয়গুলিতে একটা স্পষ্ট অবস্থান নিতে হবে। লক্ষণীয়, এই দলের সদস্য ও অনুগামীদের একটা বড় অংশই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন বা তার আদর্শগত উত্তরাধিকার বহন করছেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার বা ধর্মনিরপেক্ষতা বিষয়ে দেশের মূলস্রোতের শরিক হতে তাঁদের কিছুমাত্র আপত্তি নেই। জামাতের সঙ্গে দলের আঁতাঁতকে অনেকেই একটা নির্বাচনী কৌশল বলে গণ্য করেছিলেন। সেই কৌশল ব্যর্থ হয়েছে, এখন বি এন পি’র নিজের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নতুন করে বিচার করা উচিত। দেশে এই দলের পক্ষে এখন যথেষ্ট জনসমর্থন আছে, জামাতের সাহায্য ছাড়াই তারা ভোটে জিততে পারে।
অন্য দিকে, দেশে যে রাজনৈতিক সংকট ঘনীভূত হয়েছে, তার সমাধান খুঁজতে আওয়ামি লিগ যদি বি এন পি’কে যথেষ্ট সম্মান দিয়ে আলাপ-আলোচনার পথে যেতে পারে, সেটা দেশের পক্ষে বিশেষ ভাবে মঙ্গলজনক হবে, তার নিজের পক্ষেও। (অবশ্যই, সে জন্য বি এন পি’কেও যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রয়োজন মেনে নিতে হবে এবং ধর্মীয় উগ্রবাদীদের সঙ্গে সংস্রব ত্যাগ করতে হবে।) এ ভাবে আওয়ামি লিগ বহুলাংশে ভোটার-বর্জিত নির্বাচনে ‘জয়ী’ হওয়ার কলঙ্ক অনেকখানি ঘোচাতে পারবে। কিন্তু শুধু তা-ই নয়, দেশের মানুষ আরও অনেক রাজনৈতিক সংঘর্ষ এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কায় ত্রস্ত হয়ে আছেন, শান্তির পরিবেশ তৈরি হলে তাঁরা আওয়ামি লিগের প্রতি বিশেষ ভাবে কৃতজ্ঞ থাকবেন। এই পথে চলার চেষ্টা করা তাই আওয়ামি লিগের গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধতার প্রশ্ন। তারা যদি সেটা করতে পারে, তবে দেশের মানুষ ভবিষ্যতের নির্বাচনে তাদের জয়ী করতে পারেন, অন্তত সেই সম্ভাবনা অনেক বাড়বে।
আর জামাত? তাদের বুঝতে হবে যে, সাধারণ মানুষ তাদের হিংসাত্মক কাণ্ডকারখানা অত্যন্ত অপছন্দ করেন, ওই সব করে নির্বাচন বন্ধ করাও যায়নি। সুতরাং তাদের সামনে একটাই পথ— হিংসা পরিত্যাগ করে, নিজের কলঙ্কিত অতীতের উত্তরাধিকার বর্জন করে, যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া মেনে নিয়ে একটি স্বীকৃত রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজেকে পুনরুদ্ধার করা, সে জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত বিধি ও শর্ত মেনে নেওয়া। তা না হলে জামাত বাংলাদেশের মানুষের মনে সন্ত্রাস সৃষ্টি করতে পারবে, তাঁদের মন জয় করতে পারবে না।
একটা বিষয় জামাতের ভেবে দেখার সময় হয়েছে। নির্বাচনের আগে-পরে জামাতের সদস্য-সমর্থকরা যে হিংসাতাণ্ডব চালিয়েছে, অধিকাংশ মানুষ কিন্তু মনে করেন, সে সব আসলে ভাড়াটে গুণ্ডাদেরই কাজ, যারা নানা দেশি-বিদেশি অর্থসাহায্যে পুষ্ট। জামাতের মনে রাখা উচিত, অতীতে এই গুণ্ডাদের থেকেই কিন্তু জঙ্গি-বাহিনী তৈরি হয়েছে, স্থানীয় ধর্মান্ধ গোষ্ঠী ও বিদেশি ধর্মব্যবসায়ীদের সমর্থনে জঙ্গি সংগঠন গজিয়েছে, দেশের দুর্নাম রটেছে। সাম্প্রতিক অতীতে বাংলাদেশ সরকারের বহু প্রচেষ্টায় এদের উৎখাত করা সম্ভব হয়েছে। বহির্বিশ্বে এ জন্য বাংলাদেশের কম সুখ্যাতি হয়নি। বার বার বাংলাদেশি নাগরিকরা বুঝিয়ে ছেড়েছেন যে দেশ চালানোর নামে ধমরীর্য় রাষ্ট্র তৈরি চলবে না, রাজনীতিতে সম্প্রদায়-মেরু গঠন চলবে না। তাঁরা স্পষ্ট ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, সে দেশে ধর্মান্ধতার কোনও জায়গা নেই। হবে না। |