রাজধানীর মাটিতেই যে তাঁর দলের প্রতি জনসমর্থনে চিড় ধরতে শুরু করেছে, সেটা বিলক্ষণ বুঝতে পারছেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। সেই কারণেই প্রায় কোনও দাবি পূরণ না-হওয়া সত্ত্বেও গত কাল রাতে ধর্না তুলে নিতে হয়েছে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীকে। কেজরিওয়াল নিজে অবশ্য আজ তাঁর সহকর্মীদের বলেছেন, নিম্নবর্গ বা প্রান্তিক মানুষরা এখনও আপের উপরে ভরসা রাখছেন। কিন্তু যে বিধানসভা ভোটে মধ্যবিত্ত ও অভিজাত সম্প্রদায় আপের সমর্থনে এগিয়ে এসেছিল, তারা দ্রুত বিমুখ হচ্ছে।
এই সঙ্কট দূর করার জন্য কেজরিওয়ালের রণকৌশল হল, এমন পরিস্থিতি তৈরি করা যাতে লোকসভা নির্বাচনের আগে কংগ্রেস তাঁর সরকারের উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। কারণ, তিনি বুঝতে পারছেন শাসক দলের প্রধান হয়ে তাঁর বিপদ বেড়েছে। লড়াকু বিরোধী নেতার ভাবমূর্তিই তাঁর সম্পদ। সেই পরিচয়টি খোয়াতে চাইছেন না কেজরিওয়াল। সেই লক্ষ্যে খুব শীঘ্রই আরও বড় আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে নামতে চাইছেন তিনি। আপ সূত্রে বলা হচ্ছে, সংসদের অধিবেশন চলার সময় জন লোকপাল বিলের মতো বিষয় নিয়ে আবার রাজপথে ধর্নায় বসতে পারেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী।
কংগ্রেসের অবশ্য পাল্টা কৌশল হল, কেজরিওয়ালের তীব্র সমালোচনা করলেও সমর্থন প্রত্যাহার না-করে তাঁকে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত করে রাখা। কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশের ভাষায়, “মারব কম। দৌড় করাব বেশি। এটাই হল সাবেকি স্কুল শিক্ষকদের ছাত্র শাসনের নীতি।”
একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার শীর্ষ পদে বসে কেজরিওয়াল যে ভাবে প্রতিষ্ঠান ভাঙার কথা বলছেন, নিজেকে নৈরাজ্যবাদী বলে ঘোষণা করছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে মূল ধারার প্রায় সব রাজনৈতিক দলই। বিজেপি নেতা অরুণ জেটলি যেমন বলেন, “শাসক এবং বিরোধী দু’টিই কি একসঙ্গে হওয়া যায়? আমি প্রতিষ্ঠান আবার আমিই প্রতিষ্ঠান-বিরোধী, এ তো সোনার পাথরবাটি!” কংগ্রেস নেত্রী দীপা দাশমুন্সির কথায়, “সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে হীরক রাজা নিজেই নিজের মূর্তি ভাঙতে উদ্যত হয়েছিল। অরবিন্দ কেজরিওয়ালও কি সেই ভাবে নিজেই অ্যান্টি-সিস্টেম হয়ে মুখ্যমন্ত্রিত্বের সিস্টেমকে ভাঙতে চাইছেন? এ তো এক ধরনের সাংবিধানিক সঙ্কট।”
তৃণমূল নেতা মুকুল রায় বলেন, “তৃণমূলের আন্দোলনে আমজনতার সমর্থন চিরকালই ছিল। এবং আছে। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কখনও সংসদীয় ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে আন্দোলনকে নৈরাজ্যের পথে নিয়ে যাননি। ১৯৮৪ সালে লোকসভায় জয়লাভ থেকে মুখ্যমন্ত্রী হওয়া পর্যন্ত এই দীর্ঘ পথে তিনি সংসদীয় ব্যবস্থার প্রতি আস্থা রেখেই এগিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি প্রশাসনিকতাকে মর্যাদা দিয়েছেন, নৈরাজ্যকে নয়।”
গত দু’দিনের ধর্নায় কেজরিওয়ালের দাবি ছিল, দিল্লি পুলিশকে দিল্লি সরকারের হাতে তুলে দিতে হবে। তিনি তা পাননি। দ্বিতীয় দাবি ছিল, দোষী অফিসারদের সাসপেন্ড করতে হবে। কেন্দ্র তা-ও করেনি। কোনও পুলিশ অফিসারকে বদলিও করা হয়নি। ঘটনার তদন্তের আশ্বাস আগেই দিয়েছিলেন দিল্লির উপ-রাজ্যপাল নাজিব জঙ্গ। ফলে সেটাও নতুন করে কেজরিওয়ালের প্রাপ্তি নয়। শুধু প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রাক্কালে ওই এলাকায় সেনাবাহিনীর মহড়ায় যাতে অসুবিধা না হয়, সে জন্য রাষ্ট্রপতি ও উপ-রাজ্যপালের পরামর্শে দু’জন অফিসারকে সবেতন ছুটি দিয়ে অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে ধর্না তুলে দেওয়ার একটি রাস্তা করে দেওয়া হয়েছিল।
পিছু হটা হচ্ছে জেনেও কেজরিওয়ালকে ওই প্রস্তাব মেনে নিতে হয়েছে। কারণ তিনি বুঝতে পারছেন যে, প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা করতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানহীনতার এক বিপজ্জনক সম্ভাবনার মুখোমুখি তিনি। সরকার গড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার অঙ্গ হয়ে পড়েছেন। এখন সেই ব্যবস্থার বিরুদ্ধেই জেহাদ ঘোষণা করা একটি রাজনৈতিক স্ববিরোধ।
কেজরিওয়াল এটাও বুঝতে পারছেন যে, যত দিন তিনি ক্ষমতায় থাকবেন, ততই সমস্যা বাড়বে। আর তাই তিনি এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাইছেন যাতে কংগ্রেস সমর্থন তুলে নিতে বাধ্য হয়। এবং তিনি শহিদের মর্যাদা নিয়ে লোকসভা নির্বাচনে নামতে পারেন। কিন্তু কংগ্রেস সেই ফাঁদে পা দিতে রাজি নয়।
ফলে কেজরিওয়ালের অবস্থা এখন অভিমন্যুর মতো। তিনি চক্রব্যূহে ঢুকেছেন। কিন্তু বের হওয়ার পথ তাঁর জানা নেই।
|