|
|
|
|
দুই পুলিশের ছুটিতেই ধর্নায় ইতি
নিজস্ব প্রতিবেদন • নয়াদিল্লি
২১ জানুয়ারি |
রেল ভবনের অদূরে ধর্নায় বসে গত কাল বলেছিলেন, আপাতত দশ দিন নড়ছেন না। বাড়ি থেকে সেই মতো জামাকাপড় নিয়ে এসেছেন। অথচ দ্বিতীয় দিনেই আচমকা ধর্নায় ইতি টেনে দিলেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। যদিও তাঁর দাবিদাওয়ার প্রায় কিছুই মানেনি কেন্দ্র।
মহিলাদের সুরক্ষার দাবি সামনে রেখে ধর্নায় বসলেও কেজরিওয়াল আসলে চেয়েছিলেন দিল্লি পুলিশের নিয়ন্ত্রণ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের আওতা থেকে রাজ্য সরকারের হাতে নিয়ে আসতে। সেই দাবি মানা সম্ভব নয় বলে স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। তা হলে কী পেলেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী? সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনায় কর্তব্যে গাফিলতির দায়ে পাঁচ জন পুলিশকে সাসপেন্ড বা বরখাস্ত করার দাবি তুলেছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত দু’জন পুলিশকে আজ ছুটিতে পাঠিয়েছে কেন্দ্র। যদিও দিল্লি পুলিশ সূত্রের দাবি, সেই ছুটিও মাত্র তিন দিনের। কেজরিওয়াল অবশ্য বলেছেন, পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ দ্রুত খতিয়ে দেখতে তাঁদের বিচার বিভাগীয় তদন্তের আশ্বাস দিয়েছেন দিল্লির উপ-রাজ্যপাল নাজিব জঙ্গ। বস্তুত, তাঁর ক্রমাগত দৌত্যেই এই আংশিক সমঝোতা মেনে ধর্না তুলে নেন কেজরিওয়াল। যে প্রসঙ্গে বিজেপি বলছে, এটা সম্মানজনক পশ্চাদপসরণ ছাড়া আর কিছু না। |
|
পুলিশ-আপ খণ্ডযুদ্ধে হাতিয়ার জাতীয় পতাকাও। মঙ্গলবার নয়াদিল্লির রেল ভবনের কাছে। |
দাবি না-মেটা সত্ত্বেও কেন ধর্না তুললেন কেজরিওয়াল? কারণ মূলত তিনটে। প্রথমত, কেন্দ্রের অনমনীয় মনোভাব। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীলকুমার শিন্দে আজ সকালেও ফের জানিয়ে দেন, তদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার আগে কোনও পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। দ্বিতীয়ত, প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজ নির্ঝঞ্ঝাট করতে দিল্লি পুলিশেরই চাপ। আজ বিকেলে আপ নেতৃত্বকে জানিয়ে দেওয়া হয়, আগামিকালের মধ্যে ধর্নার এলাকা খালি করা না-হলে পুলিশ বলপ্রয়োগ করতে বাধ্য হবে। এবং তৃতীয়ত, ধর্নার জেরে গত কাল থেকে রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র অচল হয়ে থাকায় জনতার একাংশের মধ্যেই বিরক্তি। কেউ কেউ এমনও বলতে শুরু করেন, “আম আদমি পার্টি তো আম আদমি কা প্রবলেম বন গয়া!”
অথচ জনতাকে দলে টানতে চেষ্টার কসুর করেনি আপ। গত রাত থেকেই দিল্লিবাসীর মোবাইলে একাধিক বার এসএমএস আসে ‘আপনারা আসুন দলে দলে। আপনাদের নিরাপত্তার জন্যই দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী এই শীতের রাত রাস্তায় কাটাচ্ছেন! আপনারা তাঁর পাশে এসে দাঁড়ান। ধর্নায় যোগ দিন।’
কিন্তু জনতা কতটা সাড়া দিল? ধর্নাস্থলে হাজির অনেকের বক্তব্য, গত কাল ভিড় খুবই পাতলা ছিল। আজ সামান্য বেড়েছিল। এবং সেই দৃশ্য দেখে আপ নেতৃত্বের একাংশের মনে আশঙ্কা তৈরি হয় যে, জনসমর্থনে হয়তো ঘাটতি শুরু হল। প্রকাশ্যে অবশ্য আপের তরফে বলা হয়, পুলিশ তাদের সমর্থকদের ধর্নাস্থলে আসতে বাধা দিয়েছে। সেই কারণে পুলিশের সঙ্গে আপ সমর্থকদের একপ্রস্ত খণ্ডযুদ্ধও হয়েছে আজ। কিন্তু ঘটনা হল, ধর্নাস্থল ঘিরে যে পাঁচটি রাস্তা ছিল, তার মধ্যে একমাত্র রফি মার্গেই বিকেল তিনটে নাগাদ জনতা-পুলিশ সংঘর্ষ হয়। সেখানে ব্যারিকেড ভেঙে ফেলেন আপ সমর্থকেরা। জনতা-পুলিশ মারপিটে ১১ জন আপ সমর্থক আহত হয়েছেন বলে দাবি করেন দলীয় নেতৃত্ব। কিন্তু অন্য রাস্তাগুলিতে সেই অর্থে ভিড় ছিল না বললেই চলে। |
|
বিক্ষোভে দিল্লি পুলিশের ব্যঙ্গচিত্র হাতে এক আপ সমর্থক। পাশে (বাঁ দিকে)
দিল্লির আইনমন্ত্রী সোমনাথ ভারতী। মঙ্গলবার নয়াদিল্লিতে। |
জনসমর্থনে টান, দলের অভ্যন্তরে মতপার্থক্য, মন্ত্রীদের ঘিরে বিতর্ক সব দিক থেকে জেরবার কেজরিওয়াল আজ দিনভর সমাধানের রাস্তা হাতড়ে বেড়ান। এমনকী আজও তাঁর বিতর্কিত আইনমন্ত্রী সোমনাথ ভারতীর একটি নতুন মন্তব্য নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। তিনি বলে বসেন, “অরুণ জেটলি ও হরিশ সালভের মুখে থুতু দেব।” স্পষ্টতই অস্বস্তিতে কেজরিওয়াল আজ কখনও গাড়িতে, কখনও রেল ভবনের রিসেপশনে দলবল নিয়ে বৈঠক করতে থাকেন। ইতিমধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকও সিদ্ধান্তে অনড় থাকার কথা জানিয়ে দেয়। আপ সূত্রের খবর, বিকেল চারটে নাগাদই নেতারা বুঝে যান, আম আদমিকে অসন্তুষ্ট করে এত কম সমর্থক নিয়ে আন্দোলন চালানো কঠিন। এর সঙ্গে যোগ হয় পুলিশের হুঁশিয়ারি।
এই পরিস্থিতিতে সন্ধেয় দিল্লির প্রেস ক্লাবে ফের বৈঠকে বসেন কেজরিওয়াল-সহ আপ নেতৃত্ব। অধিকাংশ নেতাই এ যাত্রা ধর্না তুলে নেওয়ার প্রশ্নে একমত হন। বৈঠক শেষে কেজরিওয়াল ঘোষণা করেন, “সামনেই প্রজাতন্ত্র দিবস। তাই উপ-রাজ্যপাল আমাদের ওই এলাকা থেকে ধর্না তুলে নেওয়ার অনুরোধ করেছেন। পরিবর্তে আমাদের দাবি মেনে নেওয়ার ব্যাপারেও তিনি আশ্বাস দিয়েছেন। মালব্যনগর থানার ওসি এবং পাহাড়গঞ্জ থানার মোবাইল ভ্যান ইউনিটের এক অফিসারকে ছুটিতে যেতে বলা হয়েছে। আংশিক দাবি মানায় আমরা এই ধর্না তুলে নিচ্ছি।”
কিন্তু কেজরিওয়াল যা বলেননি তা হল, ওই অফিসারদের মাত্র তিন দিনের জন্য ছুটিতে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছে দিল্লি পুলিশেরই সূত্র। মুখ্যমন্ত্রী এই দর কষাকষিকে নিজেদের তথা দিল্লিবাসীর জয় হিসেবে তুলে ধরলেও বিজেপি নেতৃত্ব পাল্টা কটাক্ষ করে বলেছেন, “পুলিশকর্মীদের স্রেফ ছুটিতে পাঠানোর জন্য এ ভাবে ধর্নায় বসতে হল মুখ্যমন্ত্রীকে!”
কংগ্রেস নেতৃত্ব গোড়া থেকেই গোটা বিষয়টি বেশ উপভোগ করছিলেন। দল প্রথমেই স্থির করেছিল, যতই চাপ আসুক, কোনও ভাবেই আপের দাবির সামনে মাথা নোয়াবে না কেন্দ্র। উল্টে ‘আপের কার্যকলাপ আম আদমির পরিপন্থী’ এই যুক্তিতে সুর চড়ানো হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রের খবর, গত কাল সন্ধেয় কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকের পরে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীলকুমার শিন্দে এবং সংসদীয় বিষয়ক মন্ত্রী কমল নাথ নিজেদের মধ্যে গোটা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন। তার পর তাঁরা কথা বলেন উপ-রাজ্যপাল নাজিব জঙ্গের সঙ্গে। জঙ্গ রাতেই রাইসিনা হিলে গিয়ে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়কে স্ট্যাটাস রিপোর্ট দেন। এর পরেই সকাল থেকে কেজরিওয়ালের সঙ্গে উপ-রাজ্যপাল তথা কেন্দ্রের দর কষাকষি শুরু হয়। যেখানে কেজরিওয়ালকে স্পষ্ট ভাষায় বুঝিয়ে দেওয়া হয়, তাঁর দাবি মেনে দিল্লি পুলিশের দায়িত্ব রাজ্য সরকারের হাতে তুলে দেওয়া সম্ভব নয়। তার জন্য সংসদে বিল এনে নতুন আইন তৈরি করতে হবে।
তা ছাড়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্তাদের বক্তব্য ছিল, নিছক অভিযোগের ভিত্তিতে দিল্লি পুলিশের অফিসারদের সাসপেন্ড বা বদলি করে দিলে, গোটা বাহিনীরই মনোবল ভেঙে যাবে। কাজেই তা সম্ভব নয়। বিকেলে দিল্লির পুলিশ কমিশনার বি এস বাস্সি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন।
দিনের শেষে সমাধানসূত্র বার হয়, দুই অফিসারকে ছুটিতে পাঠানো হবে। তাঁদের বদলি বা সাসপেন্ড করা হবে না। পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে রাহুল গাঁধীও যুক্ত ছিলেন বলে কংগ্রেস নেতাদের বক্তব্য। মঙ্গলবার সন্ধেয় রাহুলের সঙ্গে দেখা করেন শিন্দে। পরে কংগ্রেসের প্রধান মুখপাত্র অজয় মাকেন বলেন, “এই ধর্নায় সাধারণ মানুষ সমস্যায় পড়েছেন। যা দুর্ভাগ্যজনক। আপ যাতে ইস্তাহারে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালন করতে পারে, তার জন্য তাদের সমর্থন করেছি। আমরা চাই মুখ্যমন্ত্রী তাঁর প্রতিশ্রুতি পালন করুন।”
|
ছবি: পিটিআই। |
পুরনো খবর: মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দের ধর্নায় নাকাল দিল্লি |
|
|
|
|
|