|
|
|
|
মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দের ধর্নায় নাকাল দিল্লি |
অনমিত্র সেনগুপ্ত • নয়াদিল্লি
২০ জানুয়ারি |
মুখ্যমন্ত্রী নিজেই বিরোধী নেতার ভূমিকায়!
প্রশাসনের সর্বময় কর্তা হয়েও আজ দলবল নিয়ে নিজেই বিক্ষোভে বসে পড়লেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল! আর তার ঠেলায় সপ্তাহের প্রথম কাজের দিনটিতেই আটকে গেল রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র, মধ্য দিল্লির বিস্তীর্ণ এলাকা। বন্ধ রইল সংসদ চত্বর, নর্থ ব্লক, সাউথ ব্লক-সহ বিস্তীর্ণ এলাকা। ব্যাহত হল এমনকী মেট্রো চলাচলও। সব মিলিয়ে চরম ভোগান্তির শিকার হলেন সেই আম আদমিই, যাঁদের ভোটে জিতে দিল্লির গদিতে বসতে পেরেছে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টি।
অবশ্য শুধু দিল্লিবাসীকে নাকাল করে বিক্ষোভই দেখাননি। জনতাকে চমকে দিয়ে ধর্নামঞ্চ থেকে সরকারও চালালেন অরবিন্দ! সেখানে বসেই একের পর এক ফাইল দেখেছেন, কয়েকটিতে সইও করেছেন।
লোকপাল বিল থেকে নির্ভয়া কাণ্ড গত দু’বছরে অনেক বিক্ষোভ-আন্দোলনে পথে নেমেছেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। আগেকার সেই সব আন্দোলনের তুলনায় আজকের বিক্ষোভ মাত্রায় ছোট হলেও গুরুত্বের দিক থেকে অপররিসীম বলেই মনে করা হচ্ছে। কর্তব্যে অবহেলার অভিযোগে অভিযুক্ত তিন পুলিশকর্মীকে সাসপেন্ড ও দিল্লি পুলিশের দায়িত্ব দিল্লির সরকারের হাতে তুলে দেওয়ার দাবিতে আজ ধর্নায় বসেন অরবিন্দ ও তাঁর সঙ্গীরা। কিন্তু দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে যে ভাবে অরবিন্দ আজ রাজধানীর একটি বড় অংশ অবরুদ্ধ করে রাখলেন, তা রাজনীতিতে কার্যত নজিরবিহীন বলেই মনে করছেন অনেকে। অরবিন্দ মুখে এটিকে কেন্দ্র-বিরোধী লড়াই হিসেবে ব্যাখ্যা করলেও অনেকেই মনে করছেন, আসলে আজ থেকেই কার্যত লোকসভা নির্বাচনের প্রস্তুতিতে নেমে পড়লেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী। কেন্দ্র তথা কংগ্রেস-বিরোধী এই লড়াই আগামী দিনে আরও তীব্রতর করে তুলতে চাইছেন তিনি ও তাঁর দল।
কেন এই বিক্ষোভ? |
|
আপ কর্মী-সমর্থকদের বিক্ষোভ। সোমবার দিল্লিতে। ছবি: পিটিআই। |
অরবিন্দদের দাবি, দিল্লি পুলিশের কর্তৃত্ব তুলে দিতে হবে আম আদমি পার্টির (আপ) সরকারের হাতে। দলের যুক্তি, দিল্লি পুলিশ কেন্দ্রের অধীন। তাই তারা দিল্লি সরকারের জনপ্রতিনিধিদের কথা শুনতে চায় না। উদাহরণ হিসেবে আপ নেতৃত্ব বলছেন, মন্ত্রী রাখি বিড়লা বা সোমনাথ ভারতী অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ করতে বললেও পুলিশ তা শোনেনি। উল্টে মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে দুর্ব্যবহারের অভিযোগ এনেছে। দিল্লির লেফটেন্ট্যান্ট গভর্নর নাজিব জং ঘটনাটির তদন্তের নির্দেশ দিলেও আপ নেতা যোগেন্দ্র যাদবের মন্তব্য, “আমরা চেয়েছিলাম তদন্ত চলাকালীন অন্তত অভিযুক্ত পুলিশকর্মীদের সাসপেন্ড করা হোক। তা না হলে স্বচ্ছতার সঙ্গে তদন্ত হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু তা করতে রাজি নয় প্রশাসন। তাই আমরা বাধ্য হয়ে দিল্লি পুলিশের কর্তৃত্ব দাবি করে সরব হয়েছি।” যার পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীলকুমার শিন্দে জানিয়ে দিয়েছেন, দিল্লি পুলিশের কর্তৃত্ব কোনও ভাবেই অরবিন্দদের হাতে তুলে দেওয়া হবে না।
পুলিশ-প্রসঙ্গে তাঁদের দাবি মানা না হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সামনে ধর্নায় বসার হুমকি গত শুক্রবারই দিয়েছিলেন অরবিন্দ। সেই মতো আজ সকাল এগারোটা নাগাদ রেল ভবনের সামনে এসে পৌঁছয় মুখ্যমন্ত্রীর গাড়ি। প্রায় চার হাজার পুলিশ তখন গোটা এলাকা কর্ডন করে রেখেছে। আপ সমর্থকেরা যাতে অধিক সংখ্যায় জড়ো হতে না পারেন, সে জন্য তত ক্ষণে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে পটেল চক, কেন্দ্রীয় সচিবালয়, উদ্যোগ ভবন ও রেস কোর্স মেট্রো স্টেশন। রেল ভবনের সামনের পাঁচটি রাস্তাতেও পুলিশ ব্যরিকেড। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে সমস্ত যানবাহন। বেলা বারোটা নাগাদ অরবিন্দ ও তাঁর মন্ত্রিসভার ছ’জনকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে যাওয়ার অনুমতি দেয় দিল্লি পুলিশ। কিন্তু কর্মী-সমর্থকদের বাদ দিয়ে সেখানে ঢুকতে চাননি অরবিন্দ। বেলা সাড়ে বারোটা নাগাদ আপ সমর্থকেরা পুলিশি ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা করে বিফল হন। এ সময় পুলিশের সঙ্গে তাঁদের মৃদু ধস্তাধস্তিও হয়। পরে রেল ভবন সংলগ্ন পার্কে গোবিন্দ বল্লভ পন্থের মূর্তির সামনে ধর্না শুরু করলেন অরবিন্দ। গভীর রাত পর্যন্ত তা চালু রয়েছে।
কিন্তু দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী হঠাৎ কেন এ ভাবে রাস্তায় নামলেন?
কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরকার গড়ার তিন সপ্তাহের মধ্যেই বিদ্যুতে ছাড়, বিনামূল্যে জল দেওয়ার মতো একাধিক জনমোহিনী পদক্ষেপ করেছেন অরবিন্দ। তাঁর কথায়, “২২ দিনে যা কাজ করেছি, তা অনেক সরকারই করতে পারবে না।” মুখ্যমন্ত্রীর ওই মন্তব্য থেকে স্পষ্ট, দল যে আম আদমির জন্য কাজ করছে, সেই বার্তা দিতে মরিয়া অরবিন্দ। কিন্তু পাশাপাশি দল জানে, নির্বাচনী ইস্তাহারে আরও অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছে আপ, যা মুখে বলা ও বাস্তবায়ন করার মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। তার জন্য সময় প্রয়োজন। লোকসভার আগে যে সময় অরবিন্দদের হাতে নেই। তাই কৌশলে অরবিন্দরা এখন কেন্দ্র তথা কংগ্রেস-বিরোধী লড়াইকে এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাইছেন, যেখানে দু’দলের মধ্যে কোনও সমঝোতার পথ খোলা থাকবে না। কংগ্রেস নিজেই সমর্থন তুলে নিতে বাধ্য হয়। সে ক্ষেত্রে ভোটারদের কাছে শহিদের মর্যাদা পাবেন অরবিন্দ। তিনি বলতে পারবেন, কংগ্রেস তাঁদের কাজ করতে দেয়নি।
কংগ্রেসকে তাঁর কৌশলে টেনে আনতে কমনওয়েলথ গেমস দুর্নীতির তদন্ত শুরু করার হুমকি ইতিমধ্যেই দিয়ে রেখেছেন অরবিন্দ। আজও দলীয় মঞ্চ থেকে দফায় দফায় কংগ্রেসের ভূমিকার সমালোচনা করেন আপ নেতৃত্ব। অরবিন্দের এই কৌশল সম্পর্কে কংগ্রেস অবশ্য যথেষ্টই ওয়াকিবহাল। তা ছাড়া তারা খুব ভাল করেই জানে, এই মুহূর্তে
সরকার থেকে সমর্থন তুলে নেওয়ার অর্থই হল দিল্লিতে ফের বিধানসভা নির্বাচন। যেখানে আরও খারাপ ফল হতে পারে বলেই আশঙ্কায় কংগ্রেস। সে কারণে আজ আপ-এর আন্দোলন বা মুখ্যমন্ত্রীর প্রশাসনিক অদক্ষতা নিয়ে সমালোচনা করলেও সমর্থন তোলা প্রসঙ্গে কোনও স্পষ্ট মন্তব্য করতে চাননি কংগ্রেস নেতৃত্ব। দিল্লি প্রদেশ কংগ্রেস নেতা অরবিন্দ সিংহ লাভলি আপ-নেতৃত্বকে কটাক্ষ করলেও সমর্থন তোলা প্রসঙ্গে কোনও স্পষ্ট মন্তব্য করেননি।
আজ দুপুর থেকে যে ধর্না চালু হয়েছে, দাবি মানা না হলে তা আরও অন্তত ন’দিন চলবে বলে জানিয়েছেন অরবিন্দ। তাঁর দাবি, সে ভাবেই প্রস্তুত হয়ে এসেছেন তিনি। বাড়ি থেকে ১০ দিনের মতো জামাকাপড়ও নিয়ে এসেছেন! কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, অরবিন্দ যেখানে ধর্নায় বসেছেন, তার লাগোয়া সংসদ ভবন। কয়েক পা দূরে নর্থ ও সাউথ ব্লক। এ ছাড়া রাষ্ট্রপতি ভবন এবং একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সরকারি দফতরও রয়েছে ওখানে। পাশাপাশি গণতন্ত্র দিবস উপলক্ষে মহড়াও শুরু হয়ে গিয়েছে। গত কাল রাত থেকে ওই এলাকায় পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করলেও আজ মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর সঙ্গীরা তা অমান্য করেই ধর্নায় বসেন। এই অবস্থায় প্রশ্ন উঠছে, এমন একটা এলাকায় কত দিন অরবিন্দকে ধর্না চালাতে দেবে পুলিশ? বিশেষ করে যখন প্রজাতন্ত্র দিবস সামনে। যদিও অরবিন্দের মন্তব্য, “যে দিল্লিতে নারীর সুরক্ষা নেই, সেখানে প্রজাতন্ত্র দিবস পালনের যৌক্তিকতা কী?”
আপ-এর আন্দোলন ও প্রজাতন্ত্র দিবসের কথা মাথায় রেখে দিল্লি পুলিশের সব কর্মীর ছুটি বাতিল করা হয়েছে। সোমবার বেশি রাতে ধর্নাস্থল ঘিরে ত্রি-স্তর নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা হয়েছে, যাতে সেখানে নতুন করে আপ সমর্থকরা পৌঁছতে না পারেন।
সরকারের শীর্ষে বসেও বিরোধী হয়ে ওঠা অরবিন্দের ধর্না ঘিরে দিল্লি পুলিশের উদ্বেগ তবু কমছে না। |
পুরনো খবর: অরবিন্দের ধর্না আজ, নয়া চিন্তা অপহরণের ছক |
উগান্ডার চিঠি-বিতর্ক |
বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না অরবিন্দ কেজরিওয়ালের। দিন কয়েক আগে আপ-সরকারের মন্ত্রী সোমনাথ ভারতী মালব্যনগর এলাকার যে মহিলাদের বিরুদ্ধে মাদক পাচার ও যৌনব্যবসা চালানোর অভিযোগ তুলেছিলেন, তার মধ্যে কয়েক জন ছিলেন উগান্ডার বাসিন্দা। সোমবার দিল্লির ধর্না মঞ্চ থেকে অরবিন্দ দাবি করেন, ওই তল্লাশি চালানোয় উগান্ডা হাইকমিশন তাঁদের প্রশংসা করেছে। এ কথা বলে তিনি একটি চিঠিও দেখান জনতাকে। কিন্তু অরবিন্দের দাবি উড়িয়ে বিদেশমন্ত্রী সলমন খুরশিদ বলেন, “ভারতে উগান্ডার কোনও হাইকমিশনই নেই! তা ছাড়া ওই চিঠিটি গত বছরের জুন মাসের! কেজরিওয়াল-প্রশাসন ভারতের সম্মান নিয়ে খেলা করছে, এটা অত্যন্ত দুঃখজনক।” এর ফলে বন্ধু রাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক খারাপ হতে পারে বলেও আশঙ্কা বিদেশ মন্ত্রকের। |
|
|
|
|
|