একেবারে লাগামছাড়া দৌরাত্ম্য!
আড়াই বছর আগে ক্ষমতার হাতবদলের পরেও কলকাতা ও শহরতলিতে অটোর দাপট বেড়েই চলেছে! এবং বারবার আশ্বাস দিলেও রাজপথ থেকে অলিগলিতে অটোকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পরিবহণ দফতর ও পুলিশ-প্রশাসন কার্যত ব্যর্থ।
সরকার ভাড়া না বাড়ানোয় অর্ধেকের বেশি সরকারি-বেসরকারি বাস বসে গিয়েছে। দিনের বেলায় কিছু বাসের দেখা পাওয়া গেলেও রাত যত বাড়ে, বাসের সংখ্যাও তত কমতে থাকে। বাধ্য হয়ে অটোই ভরসা। গত দেড় বছর ধরে এই তিন চাকার যানই কার্যত একমাত্র গণপরিবহণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার আতঙ্কের কারণও সেটাই। এখন প্রায় নিত্যদিন অটোচালকের হাতে যাত্রী-নিগ্রহের ছবি দেখছে শহর। |
ভাড়া কিংবা রুট নিয়ে অটোচালকদের সঙ্গে যাত্রীদের বচসা দেখা যেত এত দিন। এখন যাত্রীর গায়ে নির্বিচারে হাত উঠছে, লোহার রড পড়ছে মাথায়। যেমন তারাতলা, বেকবাগানের ঘটনায়। এক সপ্তাহের মধ্যে দুই মহিলাযাত্রী শারীরিক ভাবে আক্রান্ত হওয়ার পরেও বেপরোয়া মনোভাব অটো সাম্রাজ্যের। আর এই দুই ঘটনায় অটোচালকদের গ্রেফতার করে দায় সেরেছে পুলিশ ও পরিবহণ দফতর!
অটোর দাদাগিরি ঠেকাতে বিবৃতি দেওয়া ছাড়া যে তাদের বিশেষ কিছু করার নেই, সরকারের ভূমিকাই তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। অটোকে শৃঙ্খলায় বাঁধতে গত আড়াই বছরে একাধিক কমিটি তৈরি করেছেন পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র। তাদের কেউ কেউ সুপারিশও করেছে। তার ভিত্তিতে অনেক প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে সরকার। তবে ওই পর্যন্তই। সরকারকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অটোর শাসন চলছেই।
কেন কিছু করতে পারছে না সরকার?
বাম আমলে প্রায় সব রুটেই শহরের কয়েক হাজার অটোমালিক ছিলেন শাসক দলের শ্রমিক সংগঠন সিটুর সদস্য। তখনও অটোর দৌরাত্ম্য চলত। ২০১১ সালের মাঝামাঝি মহাকরণে ক্ষমতার হাত বদলের পরে তাঁদের সিংহভাগই চেহারা ও পতাকার রং বদলে এখন তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত। নবান্নের কর্তারা জানাচ্ছেন, নতুন পরিবহণ মন্ত্রী অটোকে বাগে আনতে নিজের দলের শ্রমিক সংগঠনের উপরে আস্থা রেখেছিলেন। কিন্তু শ্রমিক নেতারা তাতে জল ঢেলে দিয়েছেন বলে মনে করছেন পরিবহণ দফতরের কর্তারাই। তাঁদের মতে, “শাসক দলের ইউনিয়নের নেতাদের নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়ার অভাব রয়েছে। ফলে নিয়ন্ত্রণও শিথিল হচ্ছে।”
অটোর দৌরাত্ম্য চলছে বলে মানতে নারাজ এই নেতারা। তাঁদের দাবি, “অটোর উপরে আগে কোনও নিয়ন্ত্রণই ছিল না। এখন অবস্থা অনেক ভাল।” তা হলে এমন ঘটনা ঘটছে কেন? তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিইউসি-র রাজ্য সভানেত্রী দোলা সেনের সাফাই, “অটো ইউনিয়নের উপরে আমাদের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। তবে চালকদের সবাই আমাদের সদস্য নন। এখন কড়া হাতে আমরা অটোকে শৃঙ্খলায় বাঁধতে চাইছি বলেই এক শ্রেণির চালক তা বানচাল করার চেষ্টা করছেন। এবং সরকারকে বেকায়দায় ফেলতেই পরিকল্পনা করে এ সব ঘটানো হচ্ছে।” অটোকে কেন্দ্র করে দু’একটি ঘটনার ক্ষেত্রে সরকার কঠোর পদক্ষেপ করছে বলেও তাঁর দাবি। দোলাদেবীর বক্তব্য নিয়ে কোনও মন্তব্য না করলেও আইএনটিটিইউসি-র প্রবীণ নেতা এবং দীর্ঘদিন ধরে অটো ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত বিধায়ক শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় মানেন, অটোর নিয়ন্ত্রণে ইউনিয়নের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। তিনি বলেন, “ইউনিয়ন করলে যাঁদের নিয়ে চলব, তাঁদেরকেও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তাঁদের আড়াল করা যাবে না। সে দিকে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে।” সিটুর দাবি, তাদের আমলে অন্যায় করলে অটোচালককে ইউনিয়ন থেকে সাসপেন্ড করা হত। এখন সে সব উঠে গিয়েছে। সংগঠনের নেতা কিশোর ঘোষ বলেন, “বেকবাগানে যা ঘটেছে, তা খুবই নক্কারজনক।” |
দৌরাত্ম্যের অন্য ব্যাখ্যা দিয়েছেন এক প্রবীণ অটোচালক। সোমবার পার্ক সার্কাসের যে রুটে মহিলাযাত্রীর মাথায় রড মারার ঘটনা ঘটেছে, সেই রুটেরই ওই অটোচালকের কথায়, “এখন ১৬-১৭ বছরের ছেলেরা অটো চালাতে আসছে। তারা কিছুই মানে না। জোরে জোরে গান চালায়। যাত্রীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে। বড়-ছোট মানে না। ওদের শাসন করারও কেউ নেই।”
অটো নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার দায় পরিবহণ দফতরের উপর চাপিয়েছেন পুলিশের কর্তারা। তাঁদের বক্তব্য: কঠোর হতে চাইলেও তাঁরা পারছেন না। বেপরোয়া কোনও অটোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়ছেন ইউনিয়নের নেতারা। তবু আশ্বাসবাণী শুনিয়েছেন কলকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (ট্রাফিক) দিলীপ আদক, “আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি। যে সব এলাকায় আমাদের অতীতে নজরদারি সে ভাবে ছিল না, সেখানে তা বাড়ানো হচ্ছে। অটোচালকদের নিয়মিত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে।”
সরকার, পুলিশ এবং ইউনিয়নের এই টানাপোড়েনের ফলে যাত্রীদের দুর্ভোগ আর নিগ্রহ বেড়েই চলেছে। কোথায় গেলে এই দৌরাত্ম্য থেকে মুক্তি মিলবে, তা কেউ জানেন না। |
অটোর অসুখ |
• চার জনের বেশি যাত্রী তোলা
• কাটা রুটে অটো চালানো
• ইচ্ছেমতো রুট পরিবর্তন
• যখন-তখন ভাড়া বাড়ানো
• জোর করে যাত্রী নামিয়ে দেওয়া
• যাত্রীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার
• রাস্তার যেখানে-সেখানে দাঁড় করানো |
অসুখের কারণ |
• লাইসেন্সবিহীন অটো চালালেও ব্যবস্থা নয়
• ট্রাফিক নিয়ম ভাঙলেও কোনও শাস্তি নয়
• বেশি যাত্রী নিলেও পুলিশ নীরব দর্শক
• সংগঠনের জুজু দেখিয়ে পুলিশ নিয়ন্ত্রণ
• অটোচালকদের উপরে সংগঠনের নিয়ন্ত্রণ না থাকা
• অটোচালকদের জন্য কোনও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা না করা |
|