কাকা-কাকিমা দু’জনেই বেশ অসুস্থ। সদ্য হাসপাতাল থেকে ফিরেছেন দু’জনেই। টেলিফোনে খোঁজ নিই প্রতি দিন, কিন্তু কিছুতেই যাওয়া আর হয়ে উঠছিল না। রবিবার আমার ছুটির দিন। তাই শনিবার রাতেই গিন্নিকে বলে রেখেছিলাম, রবিবার সকালে হরিদেবপুরে কাকা-কাকিমাকে দেখতে যেতেই হবে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রথমে টালিগঞ্জ ট্রামডিপো, সেখান থেকে কবরডাঙার অটো ধরে হরিদেবপুর ছাড়িয়ে ‘বড় মসজিদ’ স্টপ। চেনা রাস্তা। অনেক বার গিয়েছি।
রবিবার সকাল সাড়ে দশটা-পৌনে এগারোটা নাগাদ টালিগঞ্জ ট্রামডিপো লাগোয়া কবরডাঙার অটোস্ট্যান্ডে গিয়ে দাঁড়ালাম। ১০-১৫টা অটো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে। বড় মসজিদের যাত্রী বলতে ওই মুহূর্তে একমাত্র আমিই। অটোস্ট্যান্ডের গায়ে রাস্তার রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো বছর পঞ্চাশের শ্যামবর্ণ বলিষ্ঠ চেহারার এক ব্যক্তি। তাঁকেই প্রশ্ন করলাম, কবরডাঙা রুটের অটো কোনটি?
ওই ব্যক্তি জানতে চাইলেন, “কোথায় যাবেন?” আমি বললাম, ‘‘বড় মসজিদ।’’ তাঁর জবাব, “ঠিক আছে। এখানেই দাঁড়ান। আমি বলে দিচ্ছি, কোনটায় উঠবেন।”
নিশ্চিন্ত হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম। ভাবলাম, ইনিই ‘স্টার্টার’।
আমার পরে পরেই সেখানে এলেন অবাঙালি বয়স্ক এক দম্পতি এবং তাঁদের সঙ্গী আর এক বৃদ্ধা। তাঁরাও উঠবেন কবরডাঙার অটোতে। তাঁদের গন্তব্যও জানতে চাইলেন ওই লোকটি। তাঁদের জবাবে বুঝলাম, আমার মতো তাঁরাও পুরো কবরডাঙা পর্যন্ত যাবেন না। মাঝপথে নামবেন। তাঁদেরও অপেক্ষা করতে বললেন সেই ব্যক্তি।
এর পরেই হুড়মুড় করে একদল মানুষ এসে হাজির হলেন সেখানে। তাঁদের গন্তব্য এক-এক করে জেনে নিলেন সেই লোকটি। সকলেই কবরডাঙা পর্যন্ত যাবেন জেনে গুনে গুনে তাঁদের মধ্যে থেকে চার জনকে নিজের অটোয় তুলে নিলেন। তার পরে চোখের সামনে দিয়ে নিমেষের মধ্যে অটো চালিয়ে বেরিয়ে গেলেন ‘আশ্বস্ত’ করার ছলে অন্তত দশ মিনিট অপেক্ষা করিয়ে রাখা সেই ব্যক্তি।
তার পরে আরও তিন-চারটি অটো পরপর শুধু কবরডাঙার যাত্রীদের তুলে নিয়ে বেরিয়ে যেতে শুরু করল।
তিন অবাঙালি বৃদ্ধ-বৃদ্ধা আর বার্ধক্যের দোরগোড়ায় কড়ানাড়া এই আমি রয়েই গেলাম!
ততক্ষণে কোনও বাসও আসেনি, যে বাসে করে চলে যাব।
এর পরেই একটা অটো আস্তে আস্তে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। বছর ত্রিশ-বত্রিশের অটোচালক মুখ বাড়িয়ে জানতে চাইলেন, “কোথায় যাবেন?” ‘বড় মসজিদ’ শুনে বললেন, “উঠুন।” আমি কিছুটা বিস্মিত। বললাম, “আপনি যাবেন?” অটোচালক বললেন, “যাব। আমি অনেকক্ষণ ধরে আপনার সঙ্গে যে ব্যাপারটা হল, সেটা দেখলাম।
আর আপনি কোনও কথা না বলে যে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন, সেটাও দেখলাম।”
আমি বললাম, “ব্যাপারটা কী হল ভাই? আর আমি একা নই। ওই তিন জন বয়স্ক মানুষও একই ভাবে অপেক্ষা করছেন।”
অটোচালক বললেন, “আপনারা চার জনই উঠে পড়ুন। আর ব্যাপারটা খুব সহজ দাদা। টালিগঞ্জ থেকে কবরডাঙা পর্যন্ত ভাড়া ১০ টাকা। আর বড় মসজিদ আট টাকা। একবারে টালিগঞ্জ থেকে কবরডাঙার চারজন প্যাসেঞ্জার তুলে নিতে পারলে এক ট্রিপে ৪০ টাকা বাঁধা।”
হরিদেবপুরের কিছু পরে আমার তিন সহযাত্রী সাত টাকা করে মোট একুশ টাকা ভাড়া মিটিয়ে নেমে গেলেন। তার পরে ‘বড় মসজিদ’ পর্যন্ত যাত্রী বলতে আমি একাই। কুড়ি টাকার একটি নোট বার করে অটোচালকের হাতে দিলাম। তিনিও বারো টাকা এগিয়ে দিলেন আমার দিকে।
আমি বললাম, এ বার আমার একটা কথা রাখতে হবে ভাই। আপনি আমাকে একটা টাকা ফেরত দিন। আমাদের চার জনকে তোলায় আপনার মোট ভাড়া হল ২৯ টাকা। অথচ, অন্য অনেকের মতো আপনিও কবরডাঙার চার জনকে নিয়ে গেলে ৪০ টাকা পেতেন। অযাচিত ভাবে আপনি এগিয়ে না এলে আমার পৌঁছতে আরও অনেক দেরি হত।
অটোচালক ফের আমাকে বিস্মিত করলেন, “কেন আট টাকা ভাড়ার জায়গায় আপনি ১০ টাকা দেবেন? এই করেই তো আপনাদের মতো লোকেরা আমাদের লোভ বাড়িয়ে দেন!”
অনেক কষ্টে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাজি করালাম। বললাম, “আগের ওই সব অটোচালকদের সঙ্গে দেখা হলে বলবেন, আমি কবরডাঙা পর্যন্ত না গিয়েই ১০ টাকা দিয়েছি। আর একটা অনুরোধ। ফেরার সময়ে আমাকে দেখলে, আর অটোতে জায়গা থাকলে আমাকে একটু তুলে নেবেন।” “নিশ্চিন্ত থাকুন দাদা,” বলে ফের টালিগঞ্জের দিকে অটো ঘোরালেন তরুণ ওই অটোচালক।
মনে মনে ভাবছিলাম, আহা, শহরের সব অটোচালক যদি এমনটা হতেন! |