আধ ঘণ্টা আগের ভিড়, ধাক্কাধাক্কি, পুলিশের ব্যারিকেড, কড়া নিরাপত্তা, ব্যস্ততা উধাও। শীতের ঝিমধরা দুপুরে বন্ধ কালো দরজার সামনে ১০-১২ জনের জটলা। চলছে উঁকিঝুঁকি। কিছুটা এগিয়ে, পিছিয়ে পা উঁচু করে দেখার চেষ্টা কোন ফ্ল্যাটটায় থাকতেন! এরই মাঝে কে যেন ব্যাগ থেকে বার করলেন তাঁর হাসিমুখের একটা ছবি। বসানো হল ‘বেদান্ত’ নামের ফলকটার উপরে, জ্বলে উঠল গোটা দশেক মোমবাতি। সুচিত্রা সেনের আত্মার শান্তি কামনা করলেন তাঁর ভক্তেরা।
সকালে টিভিতে সুচিত্রা সেনের মৃত্যুর খবর পেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিলেন সুভাষগ্রামের বন্দনা সেন। সোজা মিন্টো পার্কের বেসরকারি হাসপাতালে। সেখান থেকে ৫২/৪/১ বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে নায়িকার বাড়িতে দেহ আনা হবে শুনে চলে এসেছেন বাড়ির সামনে। দেখতে পেয়েছেন ফুলে মোড়া গাড়ির ভিতরে রাখা কফিন। তাতেই খুশি বন্দনা। ছোট থেকে সুচিত্রা সেনের সিনেমা দেখে বড় হওয়া এই গৃহবধূর কাছে শুক্রবারটা হয়ে থাকল চির স্মরণীয়।
বেলা ১০টা-সাড়ে ১০টা থেকেই সুচিত্রার বাড়ির গলির বাইরে ভিড় জমাতে থাকেন উৎসাহী মানুষ। ভিতরে ঢোকার অনুমতি নেই। প্রচুর পুলিশকর্মী, পুলিশের বড়, মেজো কর্তারা হাজির। অস্থায়ী রেলিং, দড়ি দিয়ে ব্যারিকেড করে সাংবাদিকদের গতিপথ সীমিত করে দেওয়া হয়েছে। আশপাশের বাড়িতে কাজ করেন, এমন ক’জন ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছেন। |
সুচিত্রা সেনের পাশের বাড়িতে নিরাপত্তারক্ষীর কাজ করেন প্রশান্ত মোদক। বললেন, “যে দিন হাসপাতালে গেলেন, সে দিন দুপুরে দেখেছিলাম ওঁকে। গত এক বছরে ওই এক বারই।” ওই বাড়িতেই ৩০-৩৫ বছর ধরে আছেন পুষ্প পাল। তাঁর কথায়, “আগে দেখতাম। গাড়ি করে আসতেন। কখনও বা ঘরের সামনে ছাদে বসে থাকতেন। ইদানীং বেরোতেন না।” বেদান্ত-র পিছনেই নির্মীয়মাণ একটি বাড়িতে থাকেন রাম। বলেন, “একটু চাষবাস করি এখানে। ওঁর বাড়ির এক পরিচারক মাঝেমধ্যেই আসত এটা-ওটা নিতে। ক’দিন আগেও ধনেপাতা নিয়ে গিয়েছে ম্যাডাম খাবেন বলে।” এমনই টুকরো কথা ভাসছিল সকাল থেকে। সেই সঙ্গে একটা প্রশ্ন, হাসপাতাল থেকে একটি বার বাড়িতে আনা হবে তো?
খবর পেয়ে হাজির সুচিত্রার প্রাক্তন পরিচারিকা সবিতা দেবনাথ। মালকিনের মর্জিমাফিক চা-কফি, চিকেন স্টু বানিয়ে দেওয়া, তাঁর সিরিয়াল দেখার ছেঁড়া ছেঁড়া স্মৃতিতে মশগুল তিনিও।
এরই মধ্যে বেলা ১১টা নাগাদ বাড়ি ফেরেন মুনমুন সেন ও তাঁর স্বামী ভরত দেববর্মণ। সঙ্গে পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তাঁরা বেরিয়ে যান। প্রশ্নটা তখন আরও জোরদার হচ্ছে। এ দিকে, বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে সুচিত্রাকে দেখার ভিড়। বয়স্ক মানুষেরা তো আছেনই, উল্টো দিকে বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজ ক্যাম্পাসের পড়ুয়ারাও ভিড় জমিয়েছেন নায়িকাকে দেখতে। বিধানসভার মুখ্য সচেতক শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়, সাংসদ সুব্রত বক্সীও পৌঁছে যান। বাড়তে থাকে পুলিশকর্মী, কর্তাদের সংখ্যাও। রাস্তার উপরে অস্থায়ী ব্যারিকেড। তোড়জোড় দেখে তত ক্ষণে সকলেই আশ্বস্ত এক বার অন্তত দেখতে পাবেন সুচিত্রাকে।
দুপুর ১টা বাজতে ১০ মিনিট বাকি থাকতে বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে দেহ আনা হয়। ভিড় জমানো মুখগুলো হামলে পড়ে নায়িকাকে দেখতে। সেই সঙ্গে মোবাইলে ছবি তোলার চেষ্টা। সাদা গাড়ির চার দিকে ফুল। ভিতরে কফিন। আগে-পরে গাড়িতে মুনমুন, ভরত, নাতনি রাইমা, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, চিকিৎসক সুব্রত মৈত্র ও নায়িকার আত্মীয়স্বজন। বাড়ির গলিতে সবক’টি গাড়ি ঢুকে যাওয়ার পরেই মূল ফটক বন্ধ করে দেওয়া হয়। আশপাশের বাড়ির জানলা, দরজা থেকে কিছু কৌতূহলী মুখ উঁকি মারছে। কিন্তু স্বেচ্ছায় অন্তরালে থাকা সুচিত্রার ইচ্ছেকে মর্যাদা দিতে শেষ যাত্রাতেও তাঁর মুখ দেখার উপায় ছিল না কারও।
পরিচিত নায়িকার আড়ালে থাকা মুখে বার্ধক্য কতটা থাবা বসিয়েছে, তা দেখতে না পেয়ে হতাশ বুলবুল দত্ত, সুস্মিতা দাস, ভাস্বতী রায়রা তখন ধীরে ধীরে এগোচ্ছেন সুচিত্রা সেনের বাড়িটা এক বার দেখতে। কারণ ভিড়, ধাক্কাধাক্কি, ব্যস্ততা, নিরাপত্তার বাঁধন তখন উধাও। নায়িকাকে স্মরণ করে একটু পরেই জ্বলে উঠবে মোমবাতি। |