সরপুঁটি খেতে খেতে রাতে আড্ডা-গল্প-গান
খন দেড় ঘণ্টা চিতা জ্বলছে ‘রমা’র।
মুখে শাড়িটা গুঁজে একদৃষ্টে দেখছেন আর চোখের জল ফেলছেন তিনি।
উমাদেবী। সুচিত্রা সেনের বড় দিদি। পাশ থেকে নাতনি রাইমা এসে জড়িয়ে ধরলেন মাসি-দিদাকে। “আমরা সবাই আম্মির কথা শুনতাম। কিন্তু আম্মি শুধু মাসি-দিদার কথাই শুনতেন,” বলেন রাইমা।
সুচিত্রা সেনরা ছিলেন পাঁচ বোন। বড় বোন উমা এবং ছোট বোন এসেছিলেন শ্মশানে। ছিলেন ছোট বোনের দুই কন্যা। এক বোনের সবে নি-রিপ্লেসমেন্ট সার্জারি হয়েছে। তাই আসতে পারেননি। আর এক বোনের শরীর খারাপ।
অনেক ক্ষণ খুব চুপচাপ বসে থাকার পরে হঠাৎ স্মৃতির দরজা খুলতে শুরু করলেন উমাদেবী। শুরু করলেন তাঁর রমার কথা।
“আমার থেকে দু’বছরের ছোট ছিল রমা। এটা কী দিন দেখছি বলুন তো! রমার চিতা জ্বলছে, আর বড় দিদি হয়ে আমি দেখছি। ভগবান কী করল!” ফের কেঁদে ফেলেন বৃদ্ধা।
তাঁর কাছ থেকেই জানা গেল, যাদবপুরের বাসিন্দা উমাদেবী প্রায়ই যেতেন সুচিত্রা সেনের ফ্ল্যাটে। গেলে দু’-তিন দিন থেকেও আসতেন। এবং মাঝেমধ্যেই বড় দিদিকে আসার জন্য অনুরোধ করতেন মহানায়িকা।
“আমাকে খালি বলত, দিদি চলে এস না। কী তোমার এত কাজ! আমিও গিয়ে থাকতাম ওর সঙ্গে। আড্ডা হত কত!” বলেন উমাদেবী।
শেষ বার কবে গিয়েছিলেন?
শেষকৃত্যে সুচিত্রার দিদি ও বোন। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।
“এই তো ও হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কিছু দিন আগেই। তার পরে আমি দিঘা বেড়াতে গিয়েছিলাম। আমাকে বলল, এসে দিঘার সব গল্প বোলো। জানেন, একদম হাসপাতালে যেতে চায়নি। দু’টো চোখের ছানি অপারেশনের জন্যই তো ভর্তি হয়েছিল। তার পর থেকেই কী যে হয়ে গেল! মুনমুন বলছিল হাসপাতাল থেকেও ও খালি বলছিল, দিদিকে নিয়ে এস তোমরা” বলতে বলতে উমা মুখ ঢাকেন শাড়ির আঁচলে।
শ্মশানে তখন আর একপ্রস্ত ঘি ঢালা হল চিতায়। সে দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই বললেন, “রমার সব চেয়ে কাছের মানুষ ছিলাম। বাড়ি গেলেই আমাকে বলত, আমার জন্য কী এনেছ? ওর জন্য প্রত্যেক বার ধূপ নিয়ে যেতাম। ঘরে ঢুকেই ঠাকুরের সামনে ধূপ জ্বালিয়ে দিত। ধূপের গন্ধটা ছোটবেলা থেকেই প্রিয় ছিল। খালি জিজ্ঞেস করত, কোথা থেকে ধূপ কেনো তুমি বল তো? আমি বলতাম, তুই জেনে কী করবি?” মৃদু হেসে বলেন উমা।
পেশাদার সাংবাদিক হয়েও আমতা আমতা করছি জিজ্ঞেস করার জন্য, যে ছোট বোন রমার সঙ্গে আর কী কথা হত তাঁর। মুশকিল-আসান করলেন উমাদেবী নিজেই।
“জানেন, এ বছর পুজোর ঠিক পর পর শেষ বার যখন ওঁর বাড়ি গিয়েছিলাম, তার আগে আমাকে বলল, দিদি, আমার জন্য একটু সরপুঁটি আনবে? রমা বলেছে, আমি নিয়ে যাব না, এটা তো হতে পারে না! নিয়ে গেলাম সরপুঁটি। নিজেই ভাজলাম বালিগঞ্জের ফ্ল্যাটে। দু’জন মিলে সরপুঁটি মাছ খেতে খেতে অনেক রাত অবধি চলল আড্ডা। তার পর হঠাৎ আমাকে বলল, একটা ভাল গান করো তো! একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত শুরু করলাম। অনেক রাত অবধি রমা আর আমি একটার পরে একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইলাম। রমা সে দিন খুব খুশি ছিল। গান গাইছিল আর হাসছিল খুব। অত খুশি বহু দিন পর দেখেছিলাম রমাকে। সেই রমা আজ আমাকে ফেলে চলে গেল। এটা কী করলি রমা,” বলতে বলতেই কেঁদে ফেলেন দিদি।
তার পর নিজেই জানালেন, সন্ধেবেলা যখন দুই বোন আড্ডা মারতেন, তখন সুচিত্রা সেন নাকি প্রায়ই শিঙাড়া আনতে বলতেন। “রমা আর আমি একটা করে শিঙাড়া খেতাম। আমি ওর জন্য রসমালাই নিয়ে যেতাম। রেস্ট্রিকশন ছিল, তাই সব খেতে পারত না। কিন্তু শিঙাড়া খেতে ভালবাসত,” বলেন উমাদেবী।
ভিড় করে আসে বোনের স্মৃতি। উমাদেবী জানান, অভিনয়ের পাট চলাকালীন দিদিকে আউটডোরে নিয়ে যেতেন রমা।
“কত আউটডোরে গিয়েছি। ওর সেট-এও যেতাম। আমার বর বিডিও ছিলেন। বদলির চাকরি ছিল। অনেক জায়গায় ঘুরতে হয়েছিল আমাকে। সেই সব জায়গায় আসত রমা। ঘরে ঢুকে একটাই কথা বলত, দিদি, সব দরজা জানলা বন্ধ করে দাও,” গলা ধরে আসে উমা দেবীর।
পাশে এসে তাঁকে সান্ত্বনা দেন সব চেয়ে ছোট বোন।
কথায় কথায় জানা গেল, দুই বোনই রোজ সকাল ৮টায় ডাক্তার সমরজিৎ নস্করকে ফোন করে জানতে চাইতেন কেমন আছেন সুচিত্রা।
“আজ সকালে খবরটা পড়ে ভাবলাম, দিদি যদি বাড়ি ফেরে, তা হলে বোধ হয় সেরে উঠবে। কিন্তু কী হয়ে গেল! কোনও দিন কারও কথা শোনেনি। আজও শুনল না,” বলেন সুচিত্রার ছোট বোন।
দিদি তখনও বলে চলেছেন তাঁর আদরের ‘রমা’র কথা।
“জানেন, কাল ছোট বোনের মেয়ে আর দোলু (রাইমা) গিয়েছিল রমাকে দেখতে। রমা ওদের বলেছে, আমাকে এ বার ছেড়ে দাও তোমরা। আমি আসব তোমাদের কাছে। কিন্তু এখানে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে!”
মুনমুন সেনও তখন বড় মাসির পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন।
মাথায় ঘোমটা টানতে টানতে মুনমুন বললেন, “বড় মাসি ঠিক বলছে। কাল সারা দিন কোনও কথাই বলতে পারেনি। কিন্তু বুধবার আমাকে বলেছিল, আমাকে কেন ছাড়ছ না তোমরা? এ বার আমাকে ছেড়ে দাও,” বলতে বলতে মাসির হাতটা জোরে চেপে ধরেন রমার মেয়ে।
উমা আর মুনমুন দেখছেন একে অন্যকে। দূরে দাউদাউ করে জ্বলছেন রমা ওরফে সুচিত্রা। শাড়ি দিয়ে মা আর মাসি-দিদার কান্না মুছিয়ে দিতে এগিয়ে আসেন রাইমা।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.