লাইট-ক্যামেরা-সাউন্ড তৈরি। অ্যাকশন বলার আগেই উত্তুরে বাতাসের মতো আছড়ে পড়ল খবরটা, ‘তিনি আর নেই’। সাত-সকালের এই আচমকা সংবাদে ‘কাট’ বলার আগেই বন্ধ হল ক্যামেরা, নিভল আলো। মুখে-মুখে ছড়িয়ে গেল কথাটা, আজ স্টুডিও পাড়ায় কোনও শ্যুটিং হবে না।
শুক্রবার ভোরের কুয়াশার তখনও কাটেনি। সবে আড়মোড়া ভাঙতে শুরু করেছে শহর। তার মধ্যেই সকাল সাতটার কলটাইম মেনে তৈরি হচ্ছে ভারতলক্ষ্মী, নিউ থিয়েটার্স কিংবা ইন্দ্রপুরী স্টুডিও। টেকনিশিয়ানরা এসে গিয়েছেন। লাইট-ক্যামেরা-সাউন্ড-সেট তৈরি হয়ে যাচ্ছে দ্রুত। আসতে শুরু করেছেন কলাকুশলীরাও। বাইরের এই ব্যস্ততার ছবিটা আর পাঁচটা দিনের মতোই। কিন্তু অলক্ষে পার্থক্য টেনে দিলেন তিনি। সুচিত্রা সেন।
৩৩ বছর আগে চলে গিয়েছিলেন টালিগঞ্জের অমর জুটির নায়ক। এ দিন চলে গেলেন নায়িকাও। তা শুনে স্টুডিওতে শ্যুটিং তো বন্ধ হল-ই, পরিচিতদের খবর দিতেও ব্যস্ত হয়ে পড়লেন অনেকে। পরিচালক-অভিনেতা কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, অভিনেত্রী চুর্ণী গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো টালিগঞ্জের প্রায় সব অভিনেতা-অভিনেত্রীই শ্যুটিং বাতিল করে শ্মশানে এসেছিলেন। নতুন ছবি ‘বুনোহাঁস’-এর ডাবিং বাতিল করলেন নায়ক দেব ও পরিচালক অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরী। অন্য কাজে শহরে এসেছিলেন মিঠুন চক্রবর্তী। শ্মশানে এলেন তিনি, বনি কপূর। অন্ত্যেষ্টি শেষ হওয়া পর্যন্ত শ্মশানে রইলেন প্রসেনজিৎ-জুন মালিয়া। সব ছবির শ্যুটিং বাতিল করলেন ‘ভেঙ্কটেশ ফিল্মস’-এর কর্ণধার মণি-শ্রীকান্তও।
নায়িকার মৃত্যু-সংবাদ পেতেই স্টুডিও চত্বরে শুরু হয়ে গিয়েছিল পুরনো দিনের কথা। জুনিয়র আর্টিস্ট থেকে অল্পবয়সি টেকনিশিয়ান, কোথায় কোথায় নায়িকা শ্যুটিং করতেন, সেই গল্পে মশগুল। এমনই এক স্মৃতির জায়গা নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওর ১ নম্বর মেকআপ রুম। সুচিত্রা সেনের মেকআপ রুম। এখন অবশ্য তার ভোল বদলে গিয়েছে। কিন্তু পুরনো দিনের লোকেদের কাছে সেই স্মৃতি অমলিন।
নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওয় এ দিন খবর আসতেই সব শ্যুটিং বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। নায়িকার মৃত্যু-সংবাদের খবর জানিয়ে সেঁটে দেওয়া হয়েছে নোটিসও। দীর্ঘদিন ধরে এই স্টুডিওয় শ্যুটিং করা নায়িকাকে শ্রদ্ধা জানানোরও ব্যবস্থা করেছিল টেকনিশিয়ান ও কলাকুশলীদের সংগঠন। নিউ থিয়েটার্স চত্বরে দাঁড় করানো নায়িকার বিরাট ফ্লেক্স। তাতে লেখা “তুমি রবে নীরবে, হৃদয়ে মম।” সামনে ফুলের স্তবক, জ্বলন্ত ধুপকাঠি। কাকতালীয় ভাবে নায়িকার সঙ্গে বয়সের যোগ রয়েছে এই স্টুডিওর। দু’জনেরই জন্ম একই বছরে, ১৯৩১।
নিউ থিয়েটার্সের প্রতিবেশী আর এক স্টুডিও, ইন্দ্রপুরীতে অবশ্য এতটা জটলা ছিল না। বেলা এগারোটায় খাঁ খাঁ করছে স্টুডিও চত্বর। গুটি কয়েক টেকনিশিয়ান-নিরাপত্তা রক্ষী ঘোরাফেরা করছেন। চেয়ার নিয়ে বসে রয়েছেন ম্যানেজার পরমানন্দ ঝা। বললেন, “তিনটি মেগা সিরিয়ালের শ্যুটিং ছিল। খবর পাওয়া মাত্রই সব ক’টির শ্যুটিং বন্ধ করা হয়েছে।” শ্যুটিং বাতিল হয়ে যাওয়ায় বাড়ি ফিরে যাচ্ছিলেন একটি মেগা সিরিয়ালের প্রোডাকশন অ্যাসিস্ট্যান্ট বিপ্লব সরকার। তিনি জানালেন, সকাল আটটায় কলটাইম থাকায় কাজ শুরু হয়েছিল। কিন্তু ন’টার পরে খবর আসতেই তড়িঘড়ি শ্যুটিং বন্ধ হয়।
শ্যুটিং বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিল ভারতলক্ষ্মী স্টুডিও-ও। কিন্তু দু’টি মেগা সিরিয়াল কর্তৃপক্ষের হাতে পর্যাপ্ত এপিসোড না থাকায়, বিকেল পাঁচটার পরে শ্যুটিংয়ের অনুমতি দিয়েছেন। স্টুডিওর ম্যানেজার হিরণ্ময় ঘোষাল কথায় কথায় বললেন, “দু’বার দেখেছিলাম ওঁকে।” কোথায়?
উত্তমকুমার যখন মারা যান, তখন তাঁর ভবানীপুরের বাড়ির সামনে গিয়েছিলেন হিরণ্ময়বাবু। নায়ককে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন সুচিত্রাদেবী। ‘‘সেটা দ্বিতীয় বার। প্রথম বার দেখি, ল্যান্সডাউনে ওঁর আত্মীয়ের বাড়িতে,” বললেন ভারতলক্ষ্মীর ম্যানেজার।
|
সহ প্রতিবেদন: ইন্দ্রনীল রায়। |