চিতার আগুনের ধোঁয়া তখন শ্মশান চত্বরের বাইরে দাঁড়িয়েই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ভিতরে ঢোকার অক্লান্ত চেষ্টায় এক প্রৌঢ় তখনও কাকুতি-মিনতিতে ব্যস্ত। শ্মশানের গেট আগলে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ অফিসারকে বোঝাচ্ছেন, কেন তাঁর ভিতরে থাকাটা দরকার। পকেট থেকে পরিচয়পত্র বার করে দেখালেন, ‘আরে, আমি অনিল মল্লিক। শ্মশানের ডোম! এ সময়ে আমায় অন্তত থাকতে দিন।’
একটু হকচকিয়ে গিয়েও পুলিশকর্মীরা তাঁকে বোঝালেন, শেষকৃত্য ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে। যাঁদের থাকার কথা, সেই ডোমেরা পর্যাপ্ত সংখ্যাতেই ভিতরে মজুত।
কেওড়াতলা শ্মশানের ভিতরে ঢুকতে মরিয়া অজস্র লোককে ঠেকিয়ে রাখতে শুক্রবার সারা দুপুরই পুলিশকে এমন শশব্যস্ত থাকতে হল।
প্রয়াত নায়িকার শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী, সাধারণ লোকের অনুপ্রবেশ এড়িয়ে সুচিত্রা সেনের শেষকৃত্য যত দূর সম্ভব নিভৃতে সারার জন্য চেষ্টার কসুর করেনি পুলিশ। শুক্রবার বেলা দেড়টার মধ্যেই রাসবিহারী অ্যাভিনিউ ও চেতলা রোডে যানচলাচল কার্যত বন্ধ করে দেওয়া হয়। কেওড়াতলা শ্মশান লাগোয়া টালিগঞ্জ রোডে ধাপে ধাপে ব্যারিকেড। কর্তব্যরত অজস্র পুলিশকর্মী। এত বাধা ঠেলে তবু শ্মশানের সামনে পৌঁছে যাচ্ছিলেন অজস্র উৎসাহী।
মোমিনপুরের বৃদ্ধ সুখনন্দন সিংহ অহলুওয়ালিয়া নিজের মনে আউড়ে যাচ্ছেন, প্যারাডাইসে আঁধি দেখেছিলাম, ওরিয়েন্টে দেবদাস! ইন্দ্রাণী কোথায় দেখেছি, মনে করতে পারছি না! এমন হিরোইন ইন্ডিয়ায় আর হবে না! ছলছলে চোখের
এক মহিলার মিনতি, মা-বাবার শেষ সময়ে থাকতে না-পারলেও তো সন্তানেরা এক বার মায়ের মুখটা শেষ বার দেখতে চায়! সুচিত্রা সেন তো আমার মায়েরই বয়সি হবেন! দয়া করে একবারটি ঢুকতে দিন না, দু’মিনিট থেকেই চলে যাব! জনৈক প্রবীণ ইনস্পেক্টর তাঁকে জোড়হাতে নিরস্ত করলেন।
শোক ছাপিয়ে কৌতূহলও কম নয়! কারও অফিস গড়িয়াহাট, কারও বাড়ি সুভাষগ্রাম। অন্তরালে থাকা মোহিনী নায়িকাকে চর্মচক্ষে দেখার আশায় না এসে পারেননি! আমি অমুক কাউন্সিলরের পরিচিত কিংবা তমুক সাংসদের পুত্র আমায় চেনেন, বলেও শ্মশান-চত্বরে চিতার সামনে দাঁড়ানোর ছাড়পত্র জোগাড় করতে অনেকেই মরিয়া চেষ্টা জারি রেখেছেন। এর মধ্যেই স্থানীয় এক রাজনৈতিক কর্মীরা কয়েক জন বোঝালেন, আমরা তো এই ব্লকেই পার্টি করি! তবু ঢোকার চেষ্টা করছি না! এটাই ডিসিপ্লিন। হালিশহরের মেয়ে, কাছাকাছি এলাকার বধূ রিক্তা মুখোপাধ্যায় তবু পিছু হটতে রাজি নন। দাদা, মহানায়ককে শেষ দেখা দেখতেও তো এখানেই এসেছিলাম। গোলাপের তোড়া হাতে টালিগঞ্জের অভিনেতা বলে ঢোকার চেষ্টা করছিলেন এক প্রবীণ। সগর্ব দাবি, আমি কিন্তু উত্তমকুমারের সঙ্গেও সিন করেছি!
পুলিশ তবু ছাড়ার পাত্র নয়। প্রয়াত নায়িকার পরিবার, ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির লোকজন ও গুটিকয়েক ভিআইপি বাদ দিলে কারও জন্যই ছাড়পত্র নেই। টালিগঞ্জের এক চলচ্চিত্র পরিচালককেও চিনতে না-পেরে ভিতরে ঢুকতে দেয়নি পুলিশ। তিনি ব্যাজার মুখে ব্যারিকেডের ওপারে সেলফোন নিয়ে ব্যস্ত। মেয়র পারিষদ পার্থপ্রতিম হাজারি, সুশান্ত ঘোষদেরও প্রথমটা চিনতে পারেনি পুলিশ। বুঝিয়ে-সুঝিয়ে সিনিয়র অফিসারদের বলে-কয়ে তাঁরা ঢুকলেন। তরুণ নায়ক সোহমের সঙ্গে থাকা এক যুবককেও সবিনয় নিরস্ত করল পুলিশ।
তবু শ্মশানের উল্টো দিকের ‘বিপজ্জনক বাড়ি’র ছাদ-বারান্দায় লোকের অভাব হয়নি। মিঠুন বা দেবকে দেখে উল্লাসও শোনা গিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এক বার বেরিয়ে জনতাকে শান্ত হতে বললেন। ব্যারিকেডের কাছ ঘেঁষে তাঁর সান্ত্বনা, আমি স্যরি, আপনারা ওঁকে দেখতে পেলেন না। তবে এটাই ওঁর শেষ ইচ্ছে, ওঁর পরিবারেরও। জনতার অনুরোধে ব্যারিকেডের রেলিংয়ের গা থেকে সাদা চাদর খুলে দিতে পুলিশকে নির্দেশ দিলেন ‘দিদি’।
ভিতরে ঢুকতে নিষেধ থাকলেও, চেতলা সেতুর উপরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন অবশ্য ভাগ্যবান। শেষকৃত্যের ছবি তুলতে সংবাদমাধ্যমের আলোকচিত্রীদের জন্য সেটাই মোক্ষম অবস্থান। ক্যামেরাধারীদের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে অনেকেই সেতুতে ঝুঁকে লেলিহান চিতা ও তারকাদের ভিড়ের দিকে চেয়ে থাকলেন।
|
শ্মশানের ভিড়ে এক উত্তম-সুচিত্রা |
হঠাৎ তাঁরা ঘিরে ধরলেন মুনমুন সেনকে। কেওড়াতলা মহাশ্মশানের ডোমেরা। “দিদি, প্রণাম নেবেন। ভাল করে কাজটা যাতে হয়, সাধ্যমতো চেষ্টা করছি,” বললেন আনন্দ মল্লিক। তার পর সমস্বরেই তাঁরা দেখালেন লুঙ্গির ওপর সস্তা কালো কোট পরে দাঁড়ানো এক বৃদ্ধকে। “মুনমুনদি, উনি ভোমলু মল্লিক। উত্তমকুমারকে উনি পুড়িয়েছিলেন। ওঁর ছেলে পোড়াচ্ছে আপনার মা-কে।” সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে গিয়ে বৃদ্ধের হাত দু’টি ধরেন মুনমুন। বলেন, “আপনি উত্তমকুমারের সময় ছিলেন। আপনার ছেলে আমার মায়ের সময়। কী আর বলব।” শ্মশানের ভিড়ে কোথাও যেন এক হয়ে গেলেন উত্তম-সুচিত্রা। |