কফিনের ঢাকনা খুলতেই দেখা গেল সেই মুখ। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে যা ছিল সবার চোখের আড়ালে।
সোনালি জরিপাড়ের সাদা বেনারসীতে সারা শরীর ঢাকা। বুকের উপরে সোনালি রঙের চাদর। সাদা শাড়ির ঘোমটার ঢাকার আড়াল থেকে এক চিলতে বেরিয়ে রয়েছে কপাল থেকে চিবুক। অত্যন্ত প্রশান্ত মুখ। কোনও কষ্টের লেশমাত্র নেই তাতে।
কফিনের ভিতরে শায়িত সুচিত্রা সেন। গলা বাড়িয়ে যাঁর মুখ এক বার চোখের দেখা দেখতে তখন রীতিমতো ব্যাকুলতা চার দিকে। মন্ত্রী, অভিনেতা-অভিনেত্রী থেকে শুরু করে আমলা ও পদস্থ পুলিশ অফিসারেরাও কে নেই সেই দলে!
মাত্র মিনিট তিনেকের দেখা। তাতেই বোঝা গেল, মুখের উপর অংশ আজও রয়েছে প্রায় একই রকম। ঠোঁটের নীচের দিকটায় বয়সের ছাপ। এত সামনে থেকে তাঁকে দেখে বাকরুদ্ধ সবাই। |
কেওড়াতলা শ্মশানে সুচিত্রার দেহ দাহ করা হবেএ খবর জানাজানি হতে শুক্রবার বেলা সাড়ে ১০টা থেকেই ভিড় বাড়তে শুরু করেছিল। তবে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে আগেভাগেই এলাকার দখল নিয়ে নেয় পুলিশ। দাহপর্ব নির্বিঘ্নে শেষ করতে শ্মশানে পৌঁছে যান কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়, অরূপ বিশ্বাস, অতীন ঘোষেরা। দেহ যে চন্দনকাঠে দাহ করতে হবে, তা সকাল ৯টা নাগাদ শোভন চট্টোপাধ্যায়কে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিলেন মমতা। মৃতদেহ দাহ করতে মোটামুটি ২০০ কেজি কাঠের প্রয়োজন হয়। কলকাতার বাজারে ওই পরিমাণ চন্দনকাঠ কয়েক ঘণ্টার মধ্যে জোগাড় করা যে এক রকম অসম্ভব, তা বুঝতে পেরেছিলেন শোভনবাবু। বড়বাজার-সহ কলকাতার অধিকাংশ বাজারের দশকর্মা ভাণ্ডার থেকে সব চন্দনকাঠ কিনে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। সব মিলিয়ে জোগাড় হয় ১৪০ কেজি চন্দনকাঠ। কেনা হয় ৫০ কেজি ঘি এবং ১৪ কেজি ধুনো। চন্দনকাঠের সঙ্গে শিরিষ ও বাবলাকাঠ মিলিয়ে চিত্তরঞ্জন মেমোরিয়াল পার্কের ভেতরে (যেখানে বাসন্তীদেবীর স্মৃতি সৌধ রয়েছে, তার পাশে) তৈরি হয় চিতা।
দুপুর ১টা ১০ মিনিটে দেহ নিয়ে গাড়ি পৌঁছয় সেখানে। পরিবারের আত্মীয়স্বজনেরা কাঁধে করে সেই কফিন বয়ে নিয়ে আসেন চিতার কাছে। কফিন রাখা হয় সাদা কাপড়ে ঢাকা টেবিলে। পিছনে পিছনে আসেন মুনমুন-রাইমারা। তাঁদের পিছনে ঢোকেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুব্রত মুখোপাধ্যায়, ফিরহাদ হাকিম, রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রসেনজিৎ, দেব, দেবশ্রী রায়, জুন মালিয়া-সহ টালিগঞ্জের শিল্পীরা। বেজে ওঠে বিউগল। পুলিশের জওয়ানেরা গান স্যালুট দেন। কফিনের উপরে মালা দিয়ে প্রথম শ্রদ্ধা জানান মুখ্যমন্ত্রী। তার পরে মেয়ে মুনমুন এবং কলকাতার পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ করপুরকায়স্থ। |
ছোট্ট ওই অনুষ্ঠান শেষ হতেই ১টা ২৭ মিনিটে কফিনবন্দি দেহ নিয়ে যাওয়া হল চিতার পাশে। উপস্থিত অতিথিদের মধ্যে গুঞ্জন, কফিনবন্দি অবস্থাতেই কি দেহ দাহ করা হবে? কয়েক মিনিটের মধ্যেই থেমে যায় গুঞ্জন। খোলা হল কফিনের ঢাকনা। দেখা গেল, সাদা কাপড়ে মুড়ে রাখা হয়েছে দেহ। মায়ের গালে হাত ঠেকিয়ে আদর করলেন মুনমুন।
ঘড়িতে ১টা ৩৫। দেহ তোলা হল চিতার উপরে। চিতা ঘিরে দাঁড়িয়ে মেয়ে মুনমুন ও নাতনি রাইমা ও রিয়া। ছিলেন জামাই ভরত দেববর্মণও। সব কিছু তদারকিতে ব্যস্ত মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। হাজির ছিলেন নায়িকার শেষ কয়েক দিনের সঙ্গী চিকিৎসক সুব্রত মৈত্র, সমরজিৎ নস্করেরাও। মন্ত্র পড়া শুরু করলেন পুরোহিত বালানন্দ শাস্ত্রী। মুনমুনের চোখে জল। মায়ের পা ছুঁয়ে শেষ বারের মতো প্রণাম সেরে একটা কাঠ চাপিয়ে দিলেন দেহের উপরে। পরে শ্মশানের কর্মীরা দেহ ঢেকে দেন চন্দন কাঠে। ঢালা হয় ঘি। মায়ের দেহ প্রদক্ষিণ করে চিতায় আগুন দেন মুনমুন। ঘড়িতে তখন ১টা ৪২ মিনিট।
এর মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী এসে মুনমুনকে প্রশ্ন করেন, ‘তুমি কিছু খাবে?’ মুনমুন বলেন, ‘আমার তো অশৌচ।’ বিকেল চারটে নাগাদ শ্মশানে আসেন মিঠুন চক্রবর্তী। জলন্ত চিতার সামনে জোড়হাতে প্রণাম জানিয়ে গোটা কয়েক চন্দনকাঠ ছুড়ে দেন চিতায়। পরে তিনি বলেন, “সিনেমার স্টার বলতে আমরা যা বুঝি, উনি ছিলেন তার দশগুণ।” এসেছিলেন বনি কপুরও। তিনি বলেন, “শ্রী (শ্রীদেবী) আর আমি এ খবর শুনে শোকাহত।”
বিকেল ৫টা ৩৫। পাইপ দিয়ে জল ঢেলে চিতা নেভালেন মুনমুন। হাতে মায়ের চিতাভস্ম। চোখের জল আর বাঁধ মানেনি তার পরে। |