শেষের দিকে ‘আইটিইউ সাইকোসিস’ হয়েছিল সুচিত্রা সেনের।
অর্থাৎ, দীর্ঘ অসুস্থতাজনিত এক ধরনের মানসিক অবসাদ। একটানা আইটিইউ কিংবা আইসিইউয়ে থাকলে অধিকাংশ রোগীর মনে এই জাতীয় ভয়, বিষণ্ণতা ভর করে। তার প্রভাব এমনই যে, সেটা কাটাতে অনেক ক্ষেত্রে কাউন্সেলিং দরকার হয়। কারণ, মন দুর্বল হয়ে পড়লে রোগীর নিজের বাঁচার ইচ্ছেও ক্রমশ এতই কমতে থাকে যে, চিকিৎসা-বিজ্ঞানের হাজারো চেষ্টাতেও কোনও ফল হয় না।
তিন-চার দিন ইস্তক মহানায়িকা এমন সমস্যাতেই আক্রান্ত হয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন ডাক্তারেরা। রোগের সঙ্গে লড়ার মানসিক তাগিদটাই যেন ওঁর চলে গিয়েছিল। তাই কাউন্সেলিংয়ের জন্য এক মনোবিদকে ডাকার কথাও হয়েছিল। এই আশায় যে, ঠিকঠাক কাউন্সেলিং করালে হয়তো চিকিৎসা থেকে মুখ ফেরানোর মানসিকতা খানিকটা কাটবে সুচিত্রার। হয়তো সময়ে ওষুধ খাওয়ানো যাবে, রাজি করানো যাবে নন-ইনভেসিভ ভেন্টিলেশনে। বুকের ফিজিওথেরাপি-ও করানো যাবে।
পরিকল্পনা মতো বৃহস্পতিবার রাতে নতুন চিকিৎসা-সূচিও তৈরি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সে সবের কিছুই আর কাজে লাগল না। শেষের শুরুটা হল কী ভাবে?
হাসপাতাল সূত্রের খবর: বৃহস্পতিবার বিকেলের দিকটায় সুচিত্রা তুলনায় ভাল ছিলেন। একটু-আধটু কথাও বলছিলেন। এমনকী, মেডিক্যাল বোর্ডের এক ডাক্তারকে খুব ক্লান্ত স্বরে প্রশ্নও করেছিলেন, “পেশেন্ট হিসেবে কত নম্বর দেবেন আমায়?” সেই ডাক্তার রসিকতা করে বলেন, “আপনি রেগে গেলে ভয় করে। তবে অন্য সময়ে আপনি ডাক্তারদের খুব বাধ্য। তাই ফুল মার্কস।”
শুনে মৃদু হেসে চোখ বন্ধ করেছিলেন মহানায়িকা। ধীরে ধীরে বলেছিলেন, “জোর করবেন না। সবটা যেন গ্রেসফুল হয়। বিকৃত করে তুলবেন না আমাকে।”
এবং বৃহস্পতিবার সন্ধের পরেই অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে। তবে শেষ রাত পর্যন্ত সম্পূর্ণ জ্ঞান ছিল। ডাক্তারেরা জানিয়েছেন, কষ্ট সইবার ক্ষমতা ওঁর বরাবরই অসীম। কিন্তু শেষ রাতে সহ্যশক্তির পরীক্ষায় যেন নিজের ক্ষমতাকেও ছাপিয়ে গিয়েছিলেন! শ্বাসকষ্টে ছটফট করেছেন। নন ইনভেসিভ ভেন্টিলেশন বা বুকের ফিজিওথেরাপি শেষ তিন দিন কোনওটাতেই রাজি হননি বলে ফুসফুস কার্বন-ডাই-অক্সাইডে ভরে গিয়েছিল। তার উপরে রাতে শুরু হয় পেটের যন্ত্রণা। এ-ও জানান, বাঁ পা ভাল ভাবে নাড়াতে পারছেন না!
সারা শরীর জুড়ে এত কষ্ট। তবু বার বার মাথা ঝাঁকিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন, কোনও চিকিৎসাই আর নেবেন না। অবিরাম জপ করতে থাকেন। আর মাঝে-মধ্যে বলতে থাকেন, ‘বাড়ি যাব।’
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বৃহস্পতিবার সন্ধের পরে হাসপাতালে গিয়ে ওঁকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। তাতে বিশেষ কাজ হয়নি। ডাক্তারেরা জানিয়েছেন, শেষ দিকটায় সুচিত্রার কারও সান্নিধ্যই ভাল লাগছিল না। বরং ডাক্তার-নার্সদের ব্যস্ততা দেখে চোখে-মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। এমনকী, রাতে এক নার্স রাইলস টিউবের মাধ্যমে খাওয়ানোর চেষ্টা করলে তাঁকে হাতের মৃদু ধাক্কায় সরিয়ে দেওয়ারও চেষ্টা করেন। মেডিক্যাল বোর্ডের এক ডাক্তার তখন বলেন, “ম্যাডাম, আপনি তো বলেছিলেন আমাদের উপরে আপনার ভরসা আছে! আমাদের চিকিৎসা করার সুযোগটা দিন। চোখের সামনে আপনাকে এ ভাবে কষ্ট পেতে দেখা সম্ভব নয়।”
সুচিত্রা সেন তবু চোখ খোলেননি। শুধু হাত নেড়ে সকলকে ইঙ্গিত করেন ওঁর কাছ থেকে সরে যেতে। রাতে যখন আইটিইউয়ে তুঙ্গ তৎপরতা, তখন এক বার চোখ খোলেন। বলেন, “এ যন্ত্রণা আর সহ্য হয় না। আমায় একটু শান্তিতে থাকতে দাও তোমরা।”
গলা ভাঙা। চোখের কোল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। ‘ম্যাডাম’-এর চোখের জল সযত্নে মুছিয়ে দেন এক নার্স। সেবিকা নিজেও তখন ঝরঝরিয়ে কাঁদছেন।
বস্তুত, শুক্রবার ভোর থেকে যেন যুদ্ধ চলেছে মধ্য কলকাতার বেসরকারি হাসপাতালটির তিনতলা জুড়ে। ডাক্তার, নার্স, হাসপাতালকর্মীরা ছুটোছুটি করছেন, সরঞ্জামে বোঝাই একের পর একর ট্রলি ঠেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আইটিইউয়ের ভিতরে, কানে ফোন নিয়ে করিডরে ডাক্তারদের উদ্বিগ্ন পায়চারি। মেডিক্যাল বোর্ডের সদস্যদের মধ্যে ঘন ঘন টেলি-কনফারেন্স। ওরই মধ্যে বোর্ডের অন্যতম চিকিৎসক সমরজিৎ নস্করের বাড়ি থেকে খবর আসে, তাঁর বাবা আচমকা পড়ে গিয়েছেন। সুচিত্রার বেডের পাশে ঠায় মোতায়েন সমরজিৎবাবু পারিবারিক বিপদের খবর পেয়েও ওখান থেকে সরতে চাননি। অন্যান্য ডাক্তার ও নার্সরা মিলে তাঁকে জোর করেই বাড়ি পাঠান। সুচিত্রা-কন্যা মুনমুন সারা রাত হাসপাতালে কাটিয়ে ভোর বেলা বাড়ি চলে গিয়েছিলেন। নার্স তাঁকে মোবাইলে না-পেয়ে ল্যান্ডলাইনে ফোন করেন। মুনমুন তড়িঘড়ি হাসপাতালে ফিরে আসেন।
ক্রমে ঘনিয়ে আসে অন্তিম লগ্ন।
আইটিইউয়ের বিশেষ শয্যাটিকে ঘিরে তখন অন্তত আট-ন’জনের ভিড়। একটা-একটা করে মুহূর্ত পেরোচ্ছে, আর ডাক্তার-নার্সদের মুখগুলো ক্রমশ ম্লান হচ্ছে। পাল্স রেট হঠাৎ অনেকটা কমে গেল। সকলের চোখ সঙ্গে সঙ্গে কার্ডিয়াক মনিটরের দিকে। রেখাগুলো ওঠা-নামা করতে করতে আচমকা একেবারে স্থির! সঙ্গে সঙ্গে হার্ট পাম্প। তাতে খানিক সাড়াও মিলল। তা হলে কি এখনও কিছুটা আশা রয়েছে?
সামান্যতম ভরসা পাওয়ার প্রত্যাশায় ওই মুহূর্তে প্রত্যেকে তাকিয়ে পরস্পরের মুখের দিকে। মুনমুন কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে আর্তস্বরে ডাকছেন, ‘মা, মা।’ চলে এসেছেন নাতনি রাইমা, অঝোরে চোখ দিয়ে জল পড়ছে, ফোঁপাচ্ছেন। মাত্র ক’টা মুহূর্ত। তার পরেই ফের স্থির কার্ডিয়াক মনিটরের রেখা। যুদ্ধ শেষ।
সমবেত দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয়ে ওঠে আইটিইউয়ের একচিলতে ঘর। কিন্তু যাঁকে ঘিরে চিকিৎসকদের এত উদ্বেগ, এত ব্যস্ততা, সামনে শায়িতা সেই মানুষটির মুখে তখন দীর্ঘ যন্ত্রণাভোগের কোনও চিহ্নই নেই!
অন্তিম শয়ানে নিবিড় প্রশান্তিই ঘিরে রইল মহানায়িকাকে। |