যন্ত্রণায় ওঁকে কাতরাতে দেখেও এত দিন কাঁদতে পারেননি। বুকে পাথর চেপে ছিলেন।
কারণ, উনি বিছানায় শুয়ে শুয়েই ইশারায় বলে দিয়েছিলেন, ওঁর সামনে কোনও কান্নাকাটি চলবে না। তাই বৃহস্পতিবার মাঝরাতে ওঁর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে দেখেও নিজেকে সামলে নিয়েছেন। কিন্তু শুক্রবার দুপুরে আর পারলেন না। বেলভিউয়ের তিনতলায় আইটিইউ ২০৭-এর সামনে দাঁড়িয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন নার্স শিখা পাঠক।
বয়স ষাট ছুঁইছুঁই। প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর এই হাসপাতালে রয়েছেন। যত বার সুচিত্রা সেন ভর্তি হয়েছেন, তত বার ওঁর দেখাশোনার ভার পেয়েছেন। এ বারও গত চব্বিশ দিন ধরে মহানায়িকার নিয়মিত দেখভাল করেছেন শিখাদেবী। এ দিন দুপুরে আইটিইউ ২০৭-এর শূন্য শয্যার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, “কী কপাল! ’৮০ সালে উত্তমকুমার যে দিন এই হাসপাতালে মারা গেলেন, সে দিনও শেষ বার ওঁকে সাজিয়েছিলাম আমি। আজও মায়ের দেহ সেই আমাকেই সাজাতে হল!”
মা। এই নামেই সুচিত্রাকে ডাকতেন শিখাদেবী। সম্পর্কটা তেমনই হয়ে গিয়েছিল। কখনও-সখনও সুচিত্রাও তাঁকে ‘মা’ বলে পাল্টা সম্বোধন করতেন। চোখের জল মুছতে মুছতে বললেন, “ওঁকে স্নান করালাম। নতুন কাপড় পরিয়ে চুল আঁচড়ে দিলাম। নতুন বিছানার চাদরে শোয়ালাম। কী অপূর্ব দেখতে লাগছিল!”
আগে যত বার সুচিত্রা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, শিখাদেবীদের মনে হয়েছে, সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যাবেন। কিন্তু এ বার পরিস্থিতি গোড়া থেকেই যেন অন্য রকম ছিল। “এই কেবিনটা ওঁর খুব প্রিয় ছিল। আগে মাঝে-মধ্যে আমরা ওঁকে ধরে ধরে দেওয়ালজোড়া জানলার সামনে দাঁড় করিয়ে দিতাম। বাইরে তাকিয়ে একের পর এক রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করে যেতেন। অনেক বই পড়তেন। এ বার পারেননি।” জানাচ্ছেন শিখা পাঠক। বলেন, “এ দফায় শরীরটা বাড়াবাড়ি রকমের খারাপ ছিল। উঠতেই পারেননি। এক দিন যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে ইশারায় সারদা মায়ের ছবি চাইলেন। ছবি হাতে দিতেই বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, কী শান্তি! জ্বালা জুড়িয়ে গেল!” এন্ডোট্র্যাকিয়াল টিউব ঢোকানোর সময়েও সুচিত্রার যন্ত্রণা ভোলাতে শিখাদেবী সারদা মায়ের ছবি হাতে পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। “অত কষ্টেও তাকিয়ে হাসলেন।” স্বর বুজে আসে শিখার।
কথাবার্তার মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন সিস্টার মেরি জর্জ। মধ্য কলকাতার বেসরকারি হাসপাতালটির আর এক প্রবীণ সিস্টার, যিনি সুচিত্রাকে দেখাশোনার দায়িত্ব ভাগ করে নিয়েছিলেন শিখাদেবীর সঙ্গে। মেরির চোখে ‘অন্য জগতের মানুষ’ ছিলেন সুচিত্রা। “অধ্যাত্মবাদ নিয়ে অনেক আলোচনা করতেন। চা, স্যুপ, পাকা পেঁপে, ফলের রস, ডিম আর স্যালাড খুব পছন্দ ছিল।” স্মৃতিচারণ করেন মেরি। ধ্বস্ত গলায় বলেন, “মনে হচ্ছে, আমার আত্মার একটা অংশ হারিয়ে গেল। হামেশাই সিস্টারদের বলতেন, সবাই চা নিয়ে বসুন, আমরা এখন চায়ের আড্ডা দেব। একে-ওকে ডেকে জিজ্ঞাসা করতেন, তুমি খেয়েছো? ঘুম হয়েছে, নাকি আমার জন্য জেগে থাকতে হয়েছে?” এমনকী যিনি ফিজিওথেরাপি করছেন বা যিনি এক্স-রে করছেন, কাজের পরে তাঁর হাত ধরে নমস্কার জানাতেন মহানায়িকা।
এই মানুষটাই কেমন পাল্টে যান গত দু’-তিন দিনে। কী রকম?
সিস্টারেরা জানান, কথা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। যেন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলেন। ওষুধ খাওয়াতে গেলে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেন। কখনও মা, মা বলে কেঁদে উঠতেন। কখনও অস্ফুটে বলতেন, ‘আর পারছি না। এ বার যাব।’
সব শেষ হয়ে যাওয়ার পরে এ দিন দুপুরে হাসপাতাল জুড়ে ভাঙা হাটের ছবি। তিনতলায় উঠতে গত ক’দিনের কড়াকড়িও শিথিল। বহু বছর ধরে অন্তরালে থাকা মহানায়িকার শেষের ক’দিনের ঠিকানা হয়ে উঠেছিল যে কেবিন, পৌঁছনো গেল তার সামনে। বেডসাইড টেবিলের উপরের তাকে গোলাপি রঙের একটা জলের জাগ, পাশে ছোট কাচের গ্লাসটিতে তখনও হালকা কমলা রঙের ওষুধের অবশিষ্ট। শয্যার উপরে কোঁচকানো বেডকভার। পুবের জানলা দিয়ে হাল্কা রোদ বিছানায় এসে পড়েছে। এক পাশে কাঠের চেয়ার। উত্তরের দেওয়ালে অক্সিজেন, স্যালাইন, নন ইনভেসিভ ভেন্টিলেশন চালানোর জায়গা, মনিটর। দেওয়ালে লাগানো টেবিল ফ্যান।
দুপুর গড়াতেই অবশ্য শুরু হয়ে গেল নতুন করে কেবিন সাজানোর পালা। নতুন কোনও অতিথির জন্য।
জীবন তো থেমে থাকে না! |