অমি বলে ডাকত
ছর তিরিশ আগে বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে রমার বাড়িতে গিয়ে মহিলাদের একটি পাক্ষিক পত্রিকা সম্পাদনার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। সুচিত্রাকে সব সময়ের জন্য একটি গাড়ি, অফিসে একটি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘর এবং মাসে ২৫ হাজার টাকা বেতন দিতে তৈরি ছিল ওই সংস্থা।
সেটাই ওর বাড়িতে আমার প্রথম যাওয়া। কিন্তু রমা বলল, “তোমাকে না বলতে খারাপ লাগছে। তবু বলছি, আমি সত্যিই পারব না।” পরে রমা আমাকে বলেছিল, “যে কাজ জানি না, সেই দায়িত্ব নিলে অন্যায় হবে।” এ-ই হল সুচিত্রা সেন। নিজের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন, অসম্ভব পরিমিতিবোধ। আমাকে খোলাখুলি বলেছিল, “দর্শকদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারব না, বুঝেই সিনেমা ছেড়ে দিয়েছি।”
তবে সিনেমা ছাড়ার পাঁচ-ছ’বছরের মধ্যে ফের এক বার অভিনয় করার প্রবল ইচ্ছে হয়েছিল ওর। রমা চেয়েছিল, আমি যেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসের নাট্যরূপ দিই। ওটা ছিল ওর খুব প্রিয় উপন্যাস। এ কথা ও নিজের মুখে বলেছিল আমাকে। এর একটা প্রেক্ষাপটও ছিল। চতুরঙ্গ ছবি করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন পূর্ণেন্দু পত্রী। কিন্তু প্রযোজক আত্মহত্যা করায় সব কিছু ভেস্তে যায়। রমা তার পর আমার লেখা ‘রবীন্দ্রনাথের তিন কন্যা’ নাটক দেখে এসেছিল। তার পরই বলেছিল, “তুমি স্ক্রিপ্ট করো। যত টাকা লাগে, আমি দেব। আমি কোনও দিন পেশাদারি থিয়েটারে কাজ করিনি। কিন্তু এখন ইচ্ছে করছে, এক বার নাটকে অভিনয় করি।”
কিন্তু আমি তখন সুচিত্রা সেনের রূপে, সুচিত্রা সেনকে বন্ধু হিসেবে পেয়ে মুগ্ধ। আমার আর নাট্যরূপ লেখা হয়নি, রমারও মঞ্চে নামার সাধ অপূর্ণই থেকে গিয়েছে।
আমাদের সম্পর্কের শুরু হয়েছিল কিন্তু তিক্ততা দিয়ে। উত্তমকুমারের মৃত্যুর পরদিন আমি সহকর্মী এক সাংবাদিককে সুচিত্রার বাড়িতে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু সুচিত্রা কোনও কথা বলেননি। অথচ শুনলাম, অন্য একটি সংবাদপত্রের সঙ্গে অনেক কথা বলেছেন। আমার মেজাজ সপ্তমে উঠল। বাড়ির নম্বরে টেলিফোন করলাম। অন্য এক জন ফোন ধরলেন। তাঁকে বললাম, উনি আমাদের সাংবাদিকের সঙ্গে যা করলেন, তার পর আমিও দেখে নেব, এই সুচিত্রা সেন কী ভাবে টিকে থাকেন।
অফিস থেকে বেরনোর মুখে টেলিফোন অপারেটর জানালেন, মিসেস সেন নামে এক জন আমার সঙ্গে কথা বলতে চান। রাত তখন ১১টা। প্রথমে আমাদের রিপোর্টারের সঙ্গে দেখা না করার জন্য খুব নরম গলায় দুঃখপ্রকাশ, তার পর উত্তমকুমার সম্পর্কে প্রচুর কথা। আমি যত কড়া গলায় কথা বলছি, মহানায়িকার গলা তত নরম হচ্ছে। ফোন রাখার সময়ে বুঝলাম, আমার রাগ অনেকটাই কমে গিয়েছে। তার পর থেকেই আমাদের বন্ধুত্বের শুরু।
আমাকে যেমন ও ‘অমি’ বলে ডাকত, তেমন আমি ওকে ‘রমা আমার’ বলে ডাকতাম। ওটা ছিল একটা মজা। ‘রমা আমার’ উল্টে দিলেও ‘রমা আমার’-ই হয়। ও আমাকে সে জন্য বলত, ফাজিল। খোলাখুলি বলছি, যৌনতা বাদ দিয়ে সব রকম সম্পর্ক ছিল আমাদের। বললে আজ হয়তো অনেকেই বিশ্বাস করবেন না, কিন্তু আমাকে নিজের হাতে ও খাইয়ে পর্যন্ত দিয়েছে।
এক দিন ওকে বললাম, আমার বাড়িতে আসবে? রমা বলল, অবশ্যই। তুমি বল, কবে যাব।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, আর কাকে ডাকব বল? ও বলল, তোমার বাড়িতে তোমার যাকে খুশি তাকে ডাকবে। এই নিয়ে আমার কী বলার আছে? আমি জানালাম, ঠিক আছে, তোমারই এক নায়ককে বলব। বসন্ত চৌধুরী। সেও আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। রমা আর বসন্ত দু’জনেই এল রানিকুঠি গভর্নমেন্ট কোয়ার্টার্স-এ আমার ফ্ল্যাটে। রাত দশটা পর্যন্ত তুমুল আড্ডা। রমাকে জানালাম, এর পর যে দিন তুমি আসবে, সে দিন আমার আরও বন্ধুবান্ধবদের ডাকব। পর দিন আমার ২০-২২ জন বন্ধু এসেছিল। তার মধ্যে ছিল শ্যামল, মানে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। আড্ডার মধ্যে রমা একটা লিচু শ্যামলের হাতে দিল। শ্যামল সেটা সোজা চালান করে দিল জামার পকেটে। বলল, “আমি কি এতই বোকা যে এই লিচু খেয়ে নেব? আরে বাবা, এটা সুচিত্রা সেন নিজে হাতে আমাকে দিয়েছেন। এটা বুকে রেখে দেওয়ার জিনিস।” আমার বাড়িতে রাত একটা পর্যন্ত চলা আড্ডাতেও রমা প্রাণবন্ত ভাবে যোগ দিত। যাঁদের গাড়ি ছিল না, তাঁদের নিজের গাড়িতে করে বাড়ি পৌঁছে দিত। আমার স্ত্রী সুনন্দার সঙ্গে অন্যদের প্লেটে খাবার বেড়ে দিত, বাসন-কোসন ধুতো। কোনও দিন কোনও অহঙ্কার বা দেমাক দেখিনি।
দু’এক বার কোনও রকম নেমন্তন্ন ছাড়াও রমা আচমকা আমার বাড়ি চলে এসেছে। এক দিন সকালে আমি ফ্ল্যাটে একা। কলিংবেল বাজতে দরজা খুলে দেখি, আমার সামনে দাঁড়িয়ে সুচিত্রা সেন। গটগট করে ঢুকে বলল, “আমি আজ তোমার এখানে থাকব, খাব, ঘুমোব।” আমি ঘাবড়ে গেলাম। ছেলে স্কুলে গিয়েছে। সুনন্দা বাড়ির কাছেই ছোটদের একটি স্কুলে পড়াত। রমাকে ঘরে বসিয়ে বাইরে থেকে তালা দিয়ে বেরিয়ে সুনন্দাকে ডেকে আনলাম। সুনন্দা এসে রান্নাবান্না করল। রমা খাওয়াদাওয়া, গল্পগুজব করে ঘুমিয়ে পড়ল আর আমি অফিসে বেরিয়ে গেলাম।
আমি রমার বাড়িতে গেলেই বিদেশি সিগারেটের কার্টন নিয়ে যেতাম। ও তার থেকে তিন-চার প্যাকেট আবার আমাকে দিয়ে দিত। এমনিতে রমা ছিল, যাকে বলে চেন স্মোকার। কিন্তু ওকে মদ ছুঁতে অন্তত আমি কোনও দিন দেখিনি। তবে আমি বা অন্য বন্ধুবান্ধব গেলে বিয়ার, স্কচ খাওয়াত। আর কোল্ড ড্রিঙ্কস তো থাকতই। এক বার আমার জন্মদিনে সাতসকালে এক লিটার শিভাস রিগ্যাল নিয়ে রমা হাজির। আমার হাতে বোতলটা তুলে দিয়ে বলল, “আজ এটা তোমার জন্য এনেছি।”
মাঝেমধ্যেই আমরা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যেতাম হাওড়ার কোনও জায়গায় কিংবা ময়দানের বইমেলা বা আকাদেমি অব ফাইন আর্টস-এ। প্রায় দিনই রানিকুঠি থেকে বেরিয়ে রমার বাড়ি ঘুরে অফিস যেতাম। ওর খুব শখ ছিল, আমার সঙ্গে বোলপুর যাবে। রমার ছোটবেলা কেটেছে বোলপুরেই। ওর বাবা ছিলেন সেখানকার স্যানিটারি ইনস্পেক্টর। প্রায়ই বলত, ট্রেনে তো যেতে পারব না। চল, গাড়ি নিয়ে শেষ রাতে বেরিয়ে পড়ি। সেটা আর শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠেনি।
নয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে আমাদের বন্ধুত্ব যে টাল খেল, সে জন্য আমিই দায়ী। রমার বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়ি তখন ভাঙা শুরু হয়েছে, ফ্ল্যাটবাড়ি করার জন্য। সেটা আমি খবর করে দিয়েছিলাম। তার পর থেকে ওকে ফোন করলে আর সেই উষ্ণতা পাইনি। আমিও তার পর যোগাযোগ বন্ধ করে দিই। সম্ভবত ওই খবর করাটা ও মেনে নেয়নি। সে ক্ষেত্রে বলব, ভুল আমারই হয়েছিল।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.