পোজ দিয়ে বললেন, চলবে?
খন বিকেল।
মায়াবী আলোর নীচে তাঁকে প্রথম দেখলাম। তন্বীর টিকালো নাক, কথা বলা চোখ। ঠোঁটের কোণে এক টুকরো হাসি। বীরেশ্বর বসুর ‘শেষ কোথায়’ ছবির নায়িকা। মায়াবী আলোয় দেখছি বলে মুগ্ধ হতে হবে নাকি! আমি সে বান্দাই নই। তবু দু’একটা স্ন্যাপ নিলাম।
আলাপ হল আরও এক বছর পরে, ১৯৫৩ সালে। তার আগে ঘটল এক মজার ঘটনা। বিশিষ্ট সাংবাদিক বাগীশ্বর ঝার খুব কাছের লোক ছিলাম আমি। একদিন বেশ রাতে আমি আর ঝা’জি বারট্রাম স্ট্রিটের একটা বইয়ের দোকান থেকে বেরোচ্ছি, হঠাৎ দেখি লাইট হাউস সিনেমা হলের সামনে একটা গাড়ির ভিতরে সুচিত্রা, তাঁর স্বামী দিবানাথ সেন ও আর এক ভদ্রলোক। এবং এটাও বুঝলাম আমাকে দেখতে পেয়েছেন সুচিত্রা। কেলেঙ্কারিটা ঘটল ক’দিন পরে। ‘নতুন খবর’ কাগজে বের হল ‘সুচিত্রাভিনেত্রী গভীর রাতে এক পুরুষের সঙ্গে কলকাতার রাস্তায়।’ পাশাপাশি এ-ও শুনলাম সুচিত্রা আমার উপরে চটে লাল। তাঁর ধারণা আমিই খবরটা ফাঁস করিয়েছি।
আমি তখন ইংরেজি সাপ্তাহিক সিনে অ্যাডভান্স-এর চিফ ফোটোগ্রাফার। আর তখনই আমার উপরে ভার পড়ল সুচিত্রার ছবি তোলার। আমি তো ভয়ে কেঁচো। সাংবাদিক সরোজ সেনগুপ্তের সঙ্গে গেলাম সুচিত্রার বালিগঞ্জ প্লেসের বাড়িতে। সাহস করে কথাটা তুলতেই তাজ্জব বনে গেলাম। মিসেস সেন বললেন, “রাগ তো করিইনি, উল্টে অ্যাজ আ ফোটোগ্রাফার আপনাকে আমার ভাল লেগে গেছে।”
 
ঘরের বৌয়ের সাজ। লাস্যের চেনা ভঙ্গি। সাত পাকে বাঁধা’র শ্যুটিং খুনসুটির মেজাজ।  
সেই থেকেই আমি বালিগঞ্জ প্লেসের নিয়মিত অতিথি। আলাপ হয়ে গেল দিবানাথ সেনের সঙ্গেও। আজ পর্যন্ত চার জনকে আমি সুচিত্রার সঙ্গে আলাপ করিয়েছি। বাগীশ্বর ঝা, হরিশ্চন্দ্র নামে এক ফোটোগ্রাফার, মেগাফোন-এর মালিক কমল ঘোষ এবং ইম্প্রেসারিও বারীন ধর। এর মধ্যে ঝা’জি আমাকে না জানিয়ে দু’টো কাজ করেছিলেন। সুচিত্রার কাছে তাঁর জীবনী লেখার মালমশলা চেয়েছিলেন, আর সুচিত্রার বোন রুনার সঙ্গে আমার বিয়ের ঘটকালি করতে গেছিলেন। দু’টোতেই ব্যর্থ।
কমল ঘোষ ঠিক করল তার মেগাফোন রেকর্ড-এ সুচিত্রাকে দিয়ে গাওয়াবে। আমাকে বলল, “তুমি বললে ঠিক রাজি হয়ে যাবে।” এবং সত্যিই রাজি হয়ে গেলেন সুচিত্রা। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় রবীন চট্টোপাধ্যায়ের সুরে দুটো গান গাইলেন। ‘আমার নতুন গানের নিমন্ত্রণে আসবে কি’ আর ‘বনে নয় আজ মনে হয়’। ২৭ জুলাই, ১৯৫৯। গায়িকা সুচিত্রা কিন্তু এগোতে পারলেন না। তাঁর গান কখনও কোথাও বাজতে শুনিনি।
এরই কিছু আগে-পরে বারীন ধর এসে ধরল একটা অনুষ্ঠান মঞ্চে সুচিত্রা সেনকে চাই। আমি বলতেই উনি রাজি হয়ে গেলেন। তবে একটা শর্ত ছিল, বিধান রায়ের টিবি ক্লিনিকের জন্য ১০০১ টাকা চাঁদা দিতে হবে। সেদিন বুঝলাম ওঁর মধ্যে কত বড় সমাজসেবী লুকিয়ে আছে। প্রস্তাবটা যখন ওঁকে দিই, তখন পাশে বসে ছিলেন বিকাশ রায়। বিকাশবাবু বললেন, “তুমি যে কী করো রমা, ধীরেনের কথায় মঞ্চে উঠতে রাজি হয়ে গেলে? তোমার কি প্রেস্টিজ নেই?” সুচিত্রা কিন্তু সে কথায় আমল দিলেন না।
এই রূপ ওঁর আর একবার দেখেছি। ৩১ ডিসেম্বর ১৯৬৩, ভারত-চিন যুদ্ধে হতাহত সেনাদের উদ্দেশে ক্রিকেট খেলা হয়েছিল। সেখানে একটা ব্যাট নিলাম হয়। সুচিত্রা সেন সেই ব্যাট তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেনের কাছ থেকে ৫০০১ টাকায় কিনে নেন। রাজ্যপালের ত্রাণ তহবিলের জন্য নিউ এম্পায়ারে হরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘বেঙ্গল স্টার শো’তেও তিনি ছিলেন।
সময় যত গড়িয়েছে কী ভাবে যেন আমি ওঁর ঘরের লোক, কাছের লোক হয়ে গেছি। ফলে বহু ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছি। দাম্পত্যকলহ সব পরিবারেই হয়। সুচিত্রা-দিবানাথ তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। তবে দিবানাথের কান ভাঙানোর লোক ছিল একটু বেশিই। অসিত চৌধুরী ছিলেন সুচিত্রার খুব ভাল বন্ধু। মাথা গরম দিবানাথ একদিন কাটলেট কাটার ছুরি দিয়ে আক্রমণ করে বসলেন অসিত চৌধুরীকে। সুচিত্রা কোনও রকমে সামাল দেন ব্যাপারটা। সজ্জন অসিতবাবুও এ নিয়ে জলঘোলা করেননি।
আজ দু’জনে মন্দ হলে মন্দ কী...‘ফরিয়াদ’ ছবিতে সুচিত্রার ঠোঁটে ছিল এই গান।
তেমন তেমন মুহূর্তে সাহসী হতে পিছপা হননি পর্দার বাইরেও। ক্যামেরায় ধরা তেমনই তিনটি ফ্রেম।
বাঁ দিকে ধর্মেন্দ্রর সঙ্গে। ডান দিকে উত্তমকুমার। সব ক’টি ছবিই তুলেছিলেন ধীরেন দেব।
মনে পড়ে মুম্বইয়ের কথা। আমি মুম্বই যাচ্ছিলাম কাজে। সুচিত্রা বললেন, “আমিও যাচ্ছি।” ২ জুন, ১৯৫৫। আমরা মুম্বই উড়ে গেলাম। মজাটা হল এয়ারপোর্টে নেমে। আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন অ্যালবার্ট সিংহ। মালা সিংহের বাবা। আমি ওঁদের বাড়িতেই উঠি। তাই দেখে দমে গেলেন সুচিত্রা। প্লেনে বারবার জিগ্যেস করেছিলেন, “থাকা হবে কোথায়?” বলিনি। আর এখন চলে যাচ্ছি আর এক নায়িকা মালার বাড়ি।
মালাদের বাড়িতে থাকলেও বান্দ্রা থেকে রোজ পৌঁছে যেতাম মেরিন লাইনসের ওয়েস্ট এন্ড হোটেলে। সেখান থেকে সুচিত্রার সঙ্গে লোকেশনে। সুচিত্রা তখন বিমল রায়ের ‘দেবদাস’-এ পার্বতী করছেন। দেবদাস হয়েছেন দিলীপকুমার। দিলীপ খালি চেষ্টা করতেন সুচিত্রার ঘনিষ্ঠ হওয়ার। আর তাই দেখে চটে যেতেন বৈজয়ন্তীমালা। বৈজয়ন্তী মোটেও সহ্য করতে পারতেন না সুচিত্রাকে। ‘ফিল্মফেয়ার’ পুরস্কার নিয়ে খোলাখুলি ঝগড়া করেছিলেন। ওঁর দাবি ছিল, উনিই নায়িকা।
আর একটা গল্প কখনও বলিনি। ‘বোম্বাই কা বাবু’ ছবির শ্যুটিং হচ্ছে কুলু উপত্যকায়। পরিচালক রাজ খোসলা প্রকাশ্যে বিরক্ত করতে লাগলেন সুচিত্রাকে। সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যেতে রাজকে সপাটে চড় মারলেন সুচিত্রা। গোটা ইউনিট হতভম্ব। আসলে মুম্বইয়ের নায়ক-পরিচালক-প্রযোজক কেউই আঁচ করতে পারেননি সুচিত্রা কী ধাতুতে গড়া। আর মুম্বইতে আমার কী পরিচয় ছিল জানেন? ‘সুচিত্রার চামচা’। এমনকী দিলীপকুমারও আমাকে এ কথা বলেছিলেন। কারণ মুম্বইতে একমাত্র আমিই ওঁর কাছে পাত্তা পেতাম। অনেকে বলেন ধীরেন দেব সুচিত্রার ‘এক্সক্লুসিভ’ ফোটোগ্রাফার। বাজে কথা, কখনও তা ছিলাম না। তবে অনেক বেশি দাবি করতে পারতাম। সে দাবি কখনও কখনও সাহসের সীমাও ছাড়িয়ে যেত।
দেবদাসের শ্যুটিংয়ে
বৈজয়ন্তীমালার সঙ্গে।
দেবী চৌধুরাণীর সেটে।
ছবি: সোনালী গুপ্ত বসু-র সৌজন্যে প্রাপ্ত।
একবার বললাম, আপনার এমন একটা ছবি তুলতে চাই যা দেখে বাঙালি ছোঁড়াদের মাথা ঘুরে যাবে। উনি হেসে বললেন, “কী চাস খুলে বল তো”? আমি বললাম, “আপনাকে এলিজাবেথ টেলর বানাতে চাই। কাঁধ বা বুকের উপরের দিকে কোনও আবরণ থাকবে না।” কোনও উত্তর না দিয়ে সুচিত্রা সেন ঢুকে গেলেন স্নানের ঘরে। তারপর আমাকে ডাকলেন শোবার ঘরে। ঢুকে দেখি সুচিত্রা দাঁড়িয়ে আছেন। বুকের মাঝামাঝি থেকে কোমরের নীচ পর্যন্ত তোয়ালে জড়ানো। বাকি শরীর অনাবৃত। চুলটা খোঁপা করা। কাঁধ, বুক, বিভাজিকা চোখ পুড়িয়ে দিচ্ছে। বললেন, “এতে চলবে?” আমি কোনও উত্তর না দিয়ে কেবল শাটার চালাচ্ছি। উনি পোজ দিচ্ছেন। সাহস পেয়ে বললাম, গালে একটা ‘নো কিস’ বসিয়ে দেব? হেসে বললেন, “যা খুশি কর।” ছোট্ট মুনমুনকে বলতেই ও লিখে দিল। ব্যস, কেল্লা ফতে।
সেই ভালবাসার টানে আজও ওঁর বাড়িতে যাই। মাঝে মাঝেই বলেন, “কীরে, এ বার আমাকে শুইয়ে একটা সাদা চাদর চাপা দিয়ে ছবি তোল। রটিয়ে দে ‘বুড্ঢি মর গয়া’। দেখবি প্রচুর টাকা পাবি।” অনেকেই ভাবেন উনি বুড়ি হয়ে গেছেন। একেবারে ভুল ধারণা। ভোটার কার্ডের জন্য ছবি তুলতে আসার সময় দুটো কাগজ তাঁর ছবি তুলেছিল। একটা ছবিতে ভুল অ্যাঙ্গল আর লাইটের অভাবে তাঁকে ডাইনি লাগছিল। অন্য ছবিটা যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা কি বলবেন ‘বুড্ঢি মর গয়া’?
সুচিত্রা কখনওই চাননি মুনমুন অভিনেত্রী হোক। উনি বলতেন, “আমার মেয়ে পড়াশোনা করবে। অন্য কিছু হবে।” মুনমুন প্রচুর পড়াশোনা করল। পড়ালো। তারপর অভিনেত্রী হল। মডেলও হল। তবে বিলেতে নয়, এ দেশে। আজ যখন লোকে বলে নাতনিদের অভিনেত্রী হওয়ায় ওঁর মত আছে, আমার হাসি পায়।
লোকে বলে, সুচিত্রা নাকি আমাকে অনেক দিয়েছেন। হ্যাঁ দিয়েছেন। তবে নিউ আলিপুরে জমি নয়, টাকা নয়। তার চেয়েও দামি জিনিস, ভালবাসা।

(২৬ ডিসেম্বর ১৯৯৮, আনন্দলোকে প্রকাশিত লেখাটির নির্বাচিত অংশের পুনর্মুদ্রণ)



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.