|
|
|
|
লাইট, সাউন্ড, ক্যামেরা... ঈশ্বর |
শান্তনু ঘোষ • কলকাতা |
ফোনটা আসত পুজোর ঠিক কয়েক দিন আগে। রিসিভারটা কানে দিলেই অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসত একটা গলা। ‘কাউকে একটু পাঠিয়ে দেবেন। পুজোটা নিয়ে যাবে। প্রণাম নেবেন...’
যিনি বলতেন, তিনি মহানায়িকা সুচিত্রা সেন। আর ফোনটা যিনি ধরতেন, তিনি বেলুড় মঠের ম্যানেজার মহারাজ।
শেষ চার-পাঁচ বছর আগেও দুর্গাপুজোর দশ-বারো দিন আগে বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়িটা থেকে এমনই ফোন এসেছে বেলুড় মঠের ম্যানেজার মহারাজের কাছে। তার পরেই বেলুড় থেকে মহানায়িকার বাড়িতে যেতেন স্বামী সুদেবানন্দের মতো নির্দিষ্ট এক বা দু’জন সন্ন্যাসী। যাওয়ার সময়ে তাঁরা সঙ্গে নিতেন শ্রীরামকৃষ্ণের প্রসাদ সন্দেশ, ফল। সঙ্গে থাকত সারদাদেবীর প্রসাদী শাড়ি। সুদেবানন্দের কথায়, “লোকসমাজের আড়ালে গিয়ে গীতা, কথামৃতের মতো একাধিক ধর্মের বই পড়েই সুচিত্রা সময় কাটাতেন। ঠাকুর-মা-স্বামীজির উপরে নতুন কোনও বই প্রকাশিত হলেই তা ওঁকে পাঠানো হত।” |
|
ভরত মহারাজের অন্ত্যেষ্টিতে। বেলুড় মঠে। |
সিনেমার জগৎ থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে, নিজেকে আড়াল করে রাখা ‘মিসেস সেন’ ছিলেন রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের এক পরম ও বিশেষ ভক্ত। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি নিজেকে আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে যুক্ত রেখেছিলেন।
সিনেমার জগৎ থেকে অবসরের পরে, লোকচক্ষুর আড়ালে গিয়ে তৈরি হয়েছিল সুচিত্রাদেবীর এক নতুন জগৎ। যেখানে প্রতিটি মুহূর্ত তিনি কাটিয়েছেন ঈশ্বরের সেবা করে। তাই নিজের মনের মতো করে সাজিয়েছিলেন বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়ির ঠাকুরঘর। সারা ঘরে স্থান পেয়েছিল দেবদেবীর ছবি। মহানায়িকার নতুন বাড়ির ঠাকুরঘরে এক বার বিশেষ পুজোর আয়োজন হয়। সেখানে তৎকালীন সারদাপীঠের সম্পাদক স্বামী রমানন্দ-সহ আরও কয়েক জন সন্ন্যাসী গিয়ে কালী কীর্তন গেয়েছিলেন। রমানন্দ বললেন, “বেশ কয়েক বার ওঁর বাড়ি গিয়েছি। কিন্তু উনি সে সব বিষয়ে জানাজানি পছন্দ করতেন না। তাই আমিও এ বিষয়ে আর কোনও কথা বলতে চাই না।”
১৯৭০ সাল নাগাদ সারদাদেবীর মন্ত্রশিষ্য তথা বেলুড় মঠের তৎকালীন ম্যানেজার মহারাজ স্বামী অভয়ানন্দের (ভরত মহারাজ) সান্নিধ্যে আসেন সুচিত্রা। ভরত মহারাজের সঙ্গেই মহানায়িকার ঘনিষ্ঠতা ছিল সব থেকে বেশি। তিনিই সুচিত্রাকে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের দশম প্রেসিডেন্ট স্বামী বীরেশ্বরানন্দের কাছে নিয়ে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। এর পরে ১৯৭৩ সালে তাঁর কাছে দীক্ষা গ্রহণ করেন সুচিত্রা। পরবর্তী কালে মায়ের গুরুর কাছেই দীক্ষা গ্রহণ করেন মুনমুনও।
সিনেমা জগতে থাকার সময় থেকে শুরু করে ১৯৭৮ সালে অন্তরালে যাওয়ার পরেও মাঝেমধ্যেই সকলের অলক্ষ্যে বেলুড় মঠে আসতেন সুচিত্রা। কখনও আসতেন সাধারণের জন্য মঠ বন্ধ হওয়ার পরে। কখনও বা খুব ভোরে। আবার কখনও মুখ ঢেকে, কালো কাচের গাড়িতে চেপে। মঠে এসে শ্রীরামকৃষ্ণের মন্দির, সারদাদেবীর মন্দির ও অন্যান্য মন্দিরে প্রণাম সেরে এসে বসতেন তৎকালীন ম্যানেজার মহারাজের ঘরে। প্রসাদ নিয়ে ফের সকলের অলক্ষ্যেই ফিরে যেতেন বালিগঞ্জে।
বেলুড় মঠ সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১২ সালের গরমের দিনে এক বার রাত ১২টার সময় মঠে এসেছিলেন সুচিত্রা। কিন্তু জিটি রোডের উপর মন্দিরের বন্ধ গেট খুলতে প্রথমে রাজি হননি দারোয়ান। আসলে তিনিও সর্বদা নিজেকে আড়াল করে রাখা মহানায়িকাকে চিনতেই পারেননি। রামকৃষ্ণ মিশনের প্রবীণ সন্ন্যাসী স্বামী বিমলাত্মানন্দ বলেন, “পরে আমাদের এক মহারাজকে ফোন করে সুচিত্রা জানান তাঁর আসার কথা। তখন সেই মহারাজ গিয়ে তাঁকে নিয়ে আসেন।” বিভিন্ন মন্দিরে ঘুরে, প্রায় সারা রাত সারদাদেবীর মন্দিরের সামনে বসে ছিলেন সুচিত্রা। খুব ভোরে কেউ জানার আগেই তিনি নিঃশব্দে চলে গিয়েছিলেন।
|
স্বামী বীরেশ্বরানন্দ |
|
স্বামী অভয়ানন্দ |
১৯৮৫ সালে স্বামী বীরেশ্বরানন্দের প্রয়াণের পরে গভীর রাতে এসে তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে গিয়েছিলেন মহানায়িকা। আবার ১৯৮৯ সালে ভরত মহারাজের প্রয়াণের পরেও মঠে এসে তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে গিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট স্বামী রঙ্গনাথানন্দের কাছেও মাঝেমধ্যে সন্ধ্যারতির পরে আসতেন সুচিত্রা। তবে সব ক্ষেত্রেই তাঁর আসার খবর জানতে পারতেন নরেন মহারাজ, মাখন মহারাজের মতো হাতে গোনা কয়েক জন সন্ন্যাসী। মহানায়িকার ইচ্ছে মতোই তাঁরাও সকলের কাছে সেই খবর গোপন রাখতেন।
রামকৃষ্ণ মিশন সূত্রে জানা যায়, শুধু ভরত মহারাজই নন। টানা ১৯ বছর যিনি স্বামী বীরেশ্বরানন্দের সচিব ছিলেন, সেই স্বামী প্রমেয়ানন্দের (রামগোপাল মহারাজ) সঙ্গেও যোগাযোগ, আসা-যাওয়া ছিল সুচিত্রার। ১৯৯৭ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বেলুড় মঠের ম্যানেজার মহারাজ ছিলেন স্বামী প্রমেয়ানন্দ। পরে তিনি সহ-অধ্যক্ষ হন। শেষ কয়েক বছর আগেও ওই সন্ন্যাসীকেই ফোন করে পুজোর প্রণামী নিয়ে যাওয়ার জন্য কাউকে পাঠাতে অনুরোধ করতেন সুচিত্রা।
টানা ১০ বছর সুচিত্রার বাড়ি থেকে প্রণামী আনতে যাওয়া সন্ন্যাসী (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বললেন, “ওঁর এতটাই ব্যক্তিত্ব ছিল যে কোনও দিন আগের জীবনের কথা জানতে চাইতে পারিনি। যেটুকু সময় থাকতাম, শ্রীরামকৃষ্ণ, মা সারদা ও স্বামীজির বাণীর ব্যাখ্যা শুনতেন। তখন ঘরে অন্য কেউ থাকতেন না।”
ওই সন্ন্যাসীই জানালেন, বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়িটির দু’টি দরজাই থাকত তালা বন্ধ। তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই নীচ থেকে দারোয়ান ফোন করে খবর দিতেন। এর পরে অন্য এক জন এসে দরজা খুলে উপরে নিয়ে যেতেন। ১৯৯৭ সাল নাগাদ রামকৃষ্ণ মিশন সেবা প্রতিষ্ঠান হাসপাতালের সন্ন্যাসীদের যাতায়াতের জন্য স্বামী রমানন্দকে একটি গাড়ি দেন সুচিত্রা। তখন থেকে সারদাপীঠের সম্পাদক থাকা পর্যন্ত স্বামী রমানন্দের সঙ্গেও সুচিত্রার বিশেষ যোগাযোগ ছিল। সেই সময়েই জগদ্ধাত্রী পুজোর আগে তাঁর বাড়িতে প্রতি বছর প্রণামী আনতে যেতেন সারদাপীঠের কর্মী প্রদীপ রায়চৌধুরী। প্রদীপবাবু বললেন, “জন্মাষ্টমীর দিন আমি রমানন্দ মহারাজের সঙ্গে বালিগঞ্জের বাড়িতে গিয়েছিলাম। সে দিন আমাকে পিঠে হাত বুলিয়ে পাশে বসে খাইয়ে দিয়েছিলেন। ওঁর ব্যবহার ছিল একেবারে মায়ের মতো।”
শেষ দিনগুলো হাসপাতালে থাকার সময়েও আধ্যাত্মিক বই পড়তে চাইতেন। ভক্তিমূলক গান শুনতেন। হাসপাতালের বেডে শুয়েও নার্সকে জিজ্ঞেস করেছেন কল্পতরু উৎসবের কথা ভক্তিমতী সুচিত্রা।
|
লোকসমাজের আড়ালে গিয়ে গীতা, কথামৃতের মতো একাধিক ধর্মের বই পড়েই
সুচিত্রা সময় কাটাতেন। ঠাকুর, মা, স্বামীজির উপরে নতুন বই প্রকাশিত
হলেই তা ওঁকে পাঠানো হত।
স্বামী সুদেবানন্দ |
|
|
|
|
|
|