|
|
|
|
চুল তার কবেকার... |
গোষ্ঠকুমার |
সে বহু দিন আগের কথা। মিসেস সেনের সঙ্গে হঠাৎই আমার অসম্ভব আন্তরিক সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল। বিয়েতে মুনমুনকে সাজিয়েছিলাম তারও অনেক পরে। আসলে উনি যখন শেষ দিকে অভিনয় করছেন, তখন ‘চতুরঙ্গ’ ছবিটা হওয়ার কথা। আর ওই ছবিতে আমার ওঁকে সাজানোর কথা ছিল। সাজিয়েওছিলাম, কিন্তু মাত্র এক দিন। কারণ এক দিন শু্যটিং-এর পরেই ছবির প্রযোজক মারা যান। বন্ধ হয়ে যায় ছবির কাজ।
কিন্তু ওঁর সঙ্গে আমার সুন্দর একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল তত দিনে। সেই সব ঘরোয়া আন্তরিক মুহূর্তর স্মৃতির কোলাজ না-হয় আমার নিজের সংগ্রহেই রেখে দিলাম। নাই-বা জানালাম। তবে আমি যে হেতু নিজেও এক জন শিল্পী, তাই আজ ওঁর সম্বন্ধে বলতে গিয়ে ওঁর রূপ, সৌন্দর্য, ওঁর হেয়ারস্টাইল, ভঙ্গি...সেই সব কথাই বলতে ইচ্ছে করছে।
বিশেষ করে ওঁর হেয়ারস্টাইল। আমাদের শিল্পীদের কাছে ক্যানভাসে ছবি আঁকা শেষ হওয়ার পরেও মন খুঁতখুঁত করে ছবির ফ্রেম নিয়ে। সঠিক ফ্রেমে বাঁধানো না হলে যেমন ছবি খোলে না, তেমনই হেয়ারস্টাইল।
ঠিকঠাক হেয়ারস্টাইলে সজ্জিত হতে না পারলে ব্যক্তিত্ব, চরিত্র, কোনও কিছুই সে ভাবে প্রস্ফুটিত হতে পারে না। যা একেবারে মাপে মাপে মিলে গিয়েছিল মিসেস সেনের সঙ্গে।
সেই সময়ে অন্য নায়িকাদের থেকে যা ওঁকে সব দিক থেকে আলাদা করে দিয়েছিল।
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের অপূর্ব সংমিশ্রণ ছিল ওঁর চেহারায়, সৌন্দর্যে। যে কারণে সব ধরনের সাজে, পোশাকে, মেজাজে মানিয়ে যেত। |
|
সাবিত্রী, সুপ্রিয়ার সৌন্দর্যের মধ্যে কিন্তু সেই বৈচিত্র ছিল না। সাবিত্রী ছিলেন পুরোপুরি ঘরোয়া আর সুপ্রিয়া প্রথাভাঙা সুন্দরী। কিন্তু গ্রাম থেকে শহুরে, সব চরিত্রই জলে-রঙে গাঢ় হয়ে মিলে যেত মিসেস সেনের সব ছবিতে। ভেবে দেখুন, ‘সপ্তপদী’র রিনা ব্রাউন। স্কার্ট-টপ, সঙ্গে ঘাড় পর্যন্ত ছাঁটা ওয়েজকাট চুল। ফুটবল মাঠে উত্তমকুমারের দিকে রেগে গিয়ে পা ঠোকা, যাকে বলে পুরোদস্তুর অ্যাংলো ইন্ডিয়ান লুক।
আবার ঠিক এর বিপরীতে রাখুন ‘হারানো সুর’। নিজে ডাক্তার, কিন্তু স্বামীর হারানো স্মৃতি ফিরিয়ে আনার জন্য উনি একটি বাচ্চা মেয়ের গভর্নেস হয়ে চলে এসেছেন উত্তমকুমারের কাছে। মধ্যবিত্ত বাঙালি সৌন্দর্যে সাবেকি এলো খোঁপায় কে বলবে ইনিও সেই রিনা ব্রাউন!
ওঁর হেয়ারস্টাইল প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে মনে পড়ে যাচ্ছে, আমি যখন বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়িতে যেতাম, কী প্রাণোচ্ছল, ছটফটে আচরণ করতেন মিসেস সেন। যেন বাড়ির প্রাণখোলা দিলদরিয়া এক বৌদি। সব সময় হাসছেন, হইহই করছেন। সেই সময়ে দুঃস্থ মহিলাদের দিয়ে হাতের কাজ করাতেন মিসেস সেন। মুনমুনও থাকত।
লম্বা চুল সব সময় খোলা। উনি কখনও চুল ছোট করে কাটেননি। সিনেমায় যেখানে ছোট চুলে ওঁকে দেখা গেছে, জানবেন তা সম্পূর্ণই উইগ। ব্যক্তিজীবনে ওঁর চুল সব সময় টানা লম্বা। সামনের দিকটায় একটু কেটেছিলেন শেষের দিকে।
মিসেস সেনের হেয়ারস্টাইল প্রসঙ্গে আর একটা কথা না বললেই নয়। ‘সাত পাকে বাঁধা’ ছবিটা যদি লক্ষ করেন দেখবেন, স্বামীর সঙ্গে মধুচন্দ্রিমায় গেছেন, সেই সময়ে কী সাধারণ করে চুলটা জাস্ট ঘাড়ের কাছে বাঁধা, মুখে নতুন বিয়ের ঔজ্জ্বল্য...উচ্চবিত্ত বাড়ির মেয়ের সাধারণ বাড়িতে বিয়ে হওয়ায় যে রকম একটু টোন-ডাউন করে সাজা দরকার, ঠিক তেমনি...আসলে উনি জানতেন, চরিত্রের সঙ্গে মিশে যেতে গেলে কেবল পোশাক-অভিনয়ই নয়! সঙ্গে হেয়ারস্টাইল, যাবতীয় অ্যাকসেসারি এমনকী ঠোঁটের ভঙ্গিটা পর্যন্ত কতটুকু ব্যবহার করতে হবে।
ওঁর মতো সাজগোজের সেন্স সেই সময়ে অন্য কোনও নায়িকার ছিল না, এ কথা খুব জোর দিয়ে বলতে পারি। ইন ফ্যাক্ট, ‘সাত পাকে বাঁধা’র জন্য উনি যখন আবার বিএফজেএ-র অ্যাওয়ার্ডে গেলেন তখন, রূপই আলাদা। বুফো করে চুল বাঁধা, কী আধুনিক! দৃষ্টিতেও কী অসম্ভব তেজ!
সেই একই রূপ দেখেছি ‘ফরিয়াদ’, ‘আলো আমার আলো’য়। আবার ‘কমললতা’র কথা ভাবুন, সম্পূর্ণ বিপরীত।
সত্যি বলছি সেই সময়ের নিরিখে ইন্দো-ওয়েস্টার্ন লুক নিয়ে সবচেয়ে বেশি এক্সপেরিমেন্ট করেছিলেন মিসেস সেন, যা আজও সমকালীন বলা যায়। ‘মমতা’ ছবিতে সেই ফ্রেঞ্চরোল করা খোঁপাই হোক, কি ‘আঁধি’র ডাকসাইটে স্টেপ কাট্ সঙ্গে ঘোমটা সবই যেন ওঁকেই মানায়।
তবে আজও আমার চোখে ভাসে বালিগঞ্জ সাকুর্লার রোডের সেই হাসিখুশি নারীর রূপ। হয়তো সত্যিকারের অভিনেত্রী বলেই আন্তরিক মুহূর্তগুলো এমন ছবির মতো ফ্রেমে আজও আটকে আছে।
জল রং বা তেল রং বা যে মিডিয়ামেই বলুন, আজও সে ছবি আমার মনের ক্যানভাসে অমলিন।
|
অনুলিখন: নিবেদিতা দে। |
|
|
|
|
|