শরীর চলে গেল, কণ্ঠ পড়ে রইল
মার জামাই বাড়িতে এসে দুপুরবেলা টিভি খুলে দেখছিল। আমি এক বারের জন্যও তাকাইনি। আমার পক্ষে সম্ভবই নয় সুচিত্রা সেনের শেষকৃত্য দেখা।
খবরটা পেয়েই শরীরটা খুব খারাপ লাগছে। প্রেশার বেড়ে গেছে। মনে হচ্ছে কথা বললেও টায়ার্ড লাগবে। আমাদের সবাইকে একদিন যেতে হবে। এটাই নিয়ম। চলে যাওয়া স্বাভাবিক ঘটনা। তবু পৃথিবীতে সুচিত্রা নেই, মানব কী করে?
অথচ আমার সঙ্গে শেষ দেখা প্রায় বাইশ বছর আগে। আমার মেয়ের বিয়ে ছিল ’৯১-এর নভেম্বরে। তার জন্য বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়িতে ওকে নেমন্তন্ন করতে গিয়েছিলাম। প্রকাশ্য বিয়ে-টিয়েতে ও আসবে না জেনেও গিয়েছিলাম। আমাদের বন্ধুত্বটা এতই জোরালো ছিল। এর পরেও কয়েক বার ফোনে কথা হয়েছে। আশ্চর্য হয়ে দেখেছি, আমরা যেমন টিভিতে পুরনো গান-টান চালিয়ে দেখি, সুচিত্রা কেমন যেন নির্মোহ হয়ে গিয়েছিল। টিভি চালাতই না। পুরনো ছবি-টবিও দেখত না।
অনেকের মনে হয় ও খুব রহস্যময়ী ছিল। জীবনের শেষ দিন অবধি সেই রহস্যটা বজায় রেখেছিল। আমার কিন্তু মনে হয়েছিল একটা কারণ হতে পারে নায়িকা ছাড়া অন্য কোনও ভূমিকায় ও হয়তো প্রকাশ্যে আসতে চায়নি। আরও একটা কারণ হতে পারে, ওর মনটা অন্য দিকে চলে গিয়েছিল। ধর্মের দিকে ওর ঝোঁক ভীষণ বেড়ে গিয়েছিল। আশির দশকের মাঝামাঝি একদিন আমাকে ফোন করে বলল, “সন্ধ্যা, আমার সঙ্গে একটু বেলুড় মঠে যেতে হবে। ভরত মহারাজ তোমাকে দেখতে চেয়েছেন।” আমি, আমার স্বামী শ্যামল গুপ্ত, সুচিত্রা সবাই দল বেঁধে গেলামও। ছিলেন অসিত চৌধুরীও। সেই প্রথম আমার বেলুড় মঠ যাওয়া। বেলুড় মঠে ওকে দেখে আমার অবাকই লেগেছিল। যে মহানায়িকাকে আমি এত বছর চিনতাম, সেই গ্ল্যামারের দুনিয়া থেকে এত তাড়াতাড়ি ওর বিবর্তন হয়ে গেছে, ভাবতেও পারিনি। এক বার ওর বাড়িতে লক্ষ্মীপুজো হয়নি। আমার বাড়িতে প্রতি বারই হত। সে বার সুচিত্রা, ওর ছোট বোন রুনা আর মুনমুন আমাদের বাড়িতে এসেছিল। সুচিত্রা এসেছিল পুরো উপোস করে। অঞ্জলি দিল, সন্ধেবেলা খেল।
শেষের দিকে এক-আধ বার মনে হতো ওকে ফোন করি। তার পরেই ভাবতাম আমার বন্ধু যখন নিজের জন্য এ রকম একটা জীবন বেছে নিয়েছে, সেই ইচ্ছেকে বিরক্ত করা ঠিক নয়।
ওর লিপ-এ আমার যে কত গান আছে, তার ঠিক-ঠিকানা নেই। আমাদের যুগলবন্দি নিয়ে মানুষ উচ্ছ্বসিত ছিল। সেই সময় সবার মুখে মুখে ফিরত, উত্তমবাবু মানে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। আর সুচিত্রা মানে সন্ধ্যা। এত ভাল লিপ দিত সুচিত্রা যে, এক এক সময় আমি অবাক হয়ে ভাবতাম, গানটা কি ও-ই গেয়েছে? আবার ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’-তে যেখানে আমি অভিনয় করে বলেছি ‘তুমিই বলো’, বা শেষে ওই যে ‘লা লা লা লা’, ওটা লোকে ভেবেছে বুঝি সুচিত্রার গলা। বোঝেনি। বসুশ্রী-তে সেই সময় বিশাল প্রোগ্রাম হত। উত্তমবাবু নিয়মিত আসতেন। এক বার তো আমি আর উত্তমবাবু ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’ ডুয়েট গাইলাম। কী রিঅ্যাকশন তার! এত বছর পরেও ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়।
সবাই উত্তম-সুচিত্রা পর্দার জুড়ির কথা বলে। আমার পর্দার বাইরেও ওদের দারুণ লাগত। অদ্ভুত একটা বন্ধুর মতো সম্পর্ক ছিল ওদের মধ্যে। সুচিত্রা তো দেখতাম ‘উতু’ বলে ডাকত। উত্তমবাবু ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ করলেন। যেখানে মান্নাবাবু আর আমার দু’জনের গলায় গানটা ছিল ‘আমি যামিনী, তুমি শশী হে’। আমি এক দিন সুচিত্রাকে ফোন করে বললাম, একটু প্রোজেকশন রুমে আসবে? গানটা শুনে বলবে কে বেটার গেয়েছে? খুব সিরিয়াসলি নয়, মজা করে বলা। কিন্তু সুচিত্রা বলল, “আসছি।” প্রোজেকশন রুমে শুনেটুনে বলল, “তুমি বেটার গেয়েছ।” ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’-তে আরও একটা গান ছিল, ‘আমি যে জলসাঘরে’। সেটাতেও দু’একটা জায়গা ছিল যেখানে আমার গায়কির ও খুব তারিফ করেছিল।
সুচিত্রা নিজে রবীন চট্টোপাধ্যায়ের সুরে দুটো গান রেকর্ড করেছিল। আমি কখনও ওর গায়কি সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত হতে পারিনি। কিন্তু গানটা খুব ভাল বুঝত। এত ভাল লিপ যে দিত, তার পেছনে রহস্য বোধহয় গানটা বোঝা আর ওর আন্তরিকতা। স্টুডিওয় শ্যুটিং শেষ হওয়ার পর রেকর্ড বাজিয়ে অনবরত শুনত। আর লিপ প্র্যাকটিস করত। আমি অনেক নায়িকার গলায় গান গেয়েছি। কিন্তু সুচিত্রা অসামান্য ছিল। শুধু চোখমুখের এক্সপ্রেশন দিয়ে ও একটা গানকে এমন বিশ্বাসযোগ্য করে দিত যে, ভাবাই যায় না। কোনও মুভমেন্ট নেই, অথচ মনে হচ্ছে ও-ই গাইছে।
আমাদের প্রথম আলাপ ব্যারাকপুরের এমপি স্টুডিওতে। ‘সবার উপরে’ ছবিতে প্রথম সুচিত্রার লিপে গান গাই। সেটা ছিল ‘জানি না ফুরাবে কবে’। রেকর্ডিং করছি স্টুডিওতে। মিউজিক ডিরেক্টর রবীন চট্টোপাধ্যায় এসে আলাপ করিয়ে দিলেন। কিন্তু আমাদের জুটির রিয়্যাল জয়যাত্রা শুরু ‘অগ্নিপরীক্ষা’ থেকে। ওটা রিলিজ হয়েছিল ‘সবার উপরে’-র ঠিক এক বছর আগে। কিন্তু ‘সবার উপরে’-র গান রেকর্ডিং হয়েছিল আগে। বাঙালির ঘরে ঘরে অসামান্য সুন্দরী গর্বিতা মেয়েটি পৌঁছে গেলেন ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবি থেকে।
আমাদের প্রথম হিট গান ‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু’। পর্দায় ওর লিপ দেওয়া দেখে আমি হাঁ হয়ে গেছিলাম। এত নির্ভুল! অমর হয়ে গিয়েছিল ওই গানটা। অথচ অনুপম ঘটক যখন সুর করেছিলেন, তখন ডিরেক্টর বিভূতি লাহা একেবারেই খুশি হতে পারেননি। উনি রীতিমতো হম্বিতম্বি করে মিউজিক ডিরেক্টরকে বললেন, এটা কী গান হয়েছে? তখনকার দিনের মিউজিক ডিরেক্টরদের যথেষ্ট মেরুদণ্ড ছিল। আজকালকার মতো নয়। উনি পাল্টা ডিরেক্টরকে বললেন, আপনি কী করবেন আপনি ভাবুন। আমি এটা নিয়ে যথেষ্ট কনফিডেন্ট। ছবির রেকর্ডিস্ট খুব সম্ভবত ছিলেন যতীন দত্ত। উনিও বললেন, ওঁর ভাল লেগেছে। গানের একটা জায়গায় ছিল ‘কুহু কুহু’। ওঁরা ডিরেক্টরকে বললেন, এই জায়গায় সন্ধ্যার গলার কাজটা দেখুন। কী করে বলছেন গানটা কিছু হয়নি? ডিরেক্টর শেষ পর্যন্ত মেনে নিলেন। বাকিটা ইতিহাস।
আমাদের বন্ধুত্বেরও সেই শুরু হয়ে গেল। এর পর ‘সাত পাকে বাঁধা’ করে মস্কো ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল থেকে সুচিত্রা সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার জিতল। তখন ও থাকত নিউ আলিপুরে। দিবানাথবাবু তখনও ওর জীবনে ছিলেন। আমি গেলাম। সুচিত্রা দেখেই বলল, দিবানাথের তোমার গান খুব ভাল লাগে। আমি বললাম, “আজ ও সব ছাড়ো। তোমাকে অনেক অভিনন্দন!” বলে বেলফুলের একটা বড় মালা নিয়ে গিয়েছিলাম। সেটা গলায় পরিয়ে দিলাম। আর বিদেশি পারফিউম ওর জন্য নিয়েছিলাম। সেটা স্প্রে করে দিলাম। সুচিত্রা-রা তখন কোথাও একটা বেরোচ্ছে। বলল, “করেছ কী! গলায় মালা, এত ভাল পারফিউম, তুমি তো আমাকে রানির মতো করে দিলে!”
আজ বিষণ্ণ ভাঙা মনে ওর স্মৃতি হিসেব করতে গিয়ে মনে হচ্ছে, রানির মতোই তো ও চলে গেল। যাওয়ার আগে হাসপাতালেও কী লড়াইটাই না করে গেল! সাংবাদিক আমার কাছে জানতে চাইছেন, জীবনের যে কোনও একটা গান ওকে উৎসর্গ করতে হলে আমি কোনটা বাছব? এক কথায় বলা খুব মুশকিল। এত সব হিট গান আছে আমাদের জুড়িতে যে, কোনও একটা গান বাছি কী করে? তবু অনেক ভেবেটেবে মনে হচ্ছে ‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু’টাই হতে পারে। সুচিত্রা-সন্ধ্যা বন্ধুত্বের তো সেই শুরু।
অনেকে বলত, সন্ধ্যা তুমি কণ্ঠ, ও হল শরীর। আজ শরীরটা চলে গেল। এ দুর্ভাগা কণ্ঠটাই শুধু পড়ে থাকল।

যুগলবন্দির এক ডজন
গানে মোর ইন্দ্রধনু
অগ্নিপরীক্ষা: ১৯৫৪
কে তুমি আমারে ডাকো
অগ্নিপরীক্ষা: ১৯৫৪
ঘুম ঘুম চাঁদ
সবার উপরে: ১৯৫৫
জানি না ফুরাবে কবে এই পথ চাওয়া
সবার উপরে: ১৯৫৫
এই মধুরাত শুধু ফুল পাপিয়ার
সাগরিকা: ১৯৫৬
কিছুক্ষণ আরও না হয় রহিতে কাছে
পথে হল দেরি: ১৯৫৭
আমার জীবনে নেই আলো
সূর্যতোরণ: ১৯৫৮
নয় নয়, এ তো খেলা নয়
চাওয়া পাওয়া: ১৯৫৯
কিছু খুশি কিছু নেশা
স্মৃতিটুকু থাক: ১৯৬০
এই পথ যদি না শেষ হয়
সপ্তপদী: ১৯৬১
আমি স্বপ্নে তোমায় দেখেছি
বিপাশা: ১৯৬২
দু’চোখের বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে
শ্রাবণ সন্ধ্যা: ১৯৭৪

গৌতম ভট্টাচার্যের নেওয়া সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.