অন্দরে অন্য রূপ: ঘরনি সুচিত্রা তখন রাঁধেন-বাড়েন
সুচিত্রা সেনকে কোনও দিন ‘ম্যাডাম’ বলে ডাকিনি। কোনও দিন ‘রমাদি’ও বলিনি। একটা বিশেষ আত্মীয়তাবোধে ওঁকে ‘কাকিমা’ বলে ডেকে এসেছি বরাবর। সেই ‘কাকিমা’ আমার কাছে চিরপ্রণম্য হয়ে থাকবেন।
আমাদের ছায়াবাণী পিকচার্সের ব্যানারে ওঁর বেশ কিছু ছবি ছিল। ‘হারানো সুর’, ‘সপ্তপদী’, ‘গৃহদাহ’, ‘কমললতা’, ‘আলো আমার আলো’। ‘হসপিটাল’ আর ‘উত্তরফাল্গুনী’ও...। ১৯৭২ সালে ‘আলো আমার আলো’ ছবিটি ছায়াবাণীর সঙ্গে ওঁর শেষ কাজ। আর সেই সময় থেকেই আমি কাকিমার হিসাবরক্ষক এবং ইনকাম ট্যাক্স ল’ইয়ার হয়ে যাই। ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত টানা ওঁকে কাছ থেকে দেখেছি।
দেখে-শুনে যেটা বুঝেছি, সুচিত্রা সেন মানে বহুমুখী গুণের আধার এক মানবী। মানবী না বলে দেবীও বলা যায়। খুব মানবিক অনুভূতি ছিল ওঁর। আমি ছিলাম নিতান্ত অভাবী। কষ্ট করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি কিছুটা লেখাপড়া শিখে। তখন উনিই আমায় প্রথম ওঁর ল’ইয়ার করেন এবং কাজের সুযোগ দেন। প্রথম কেরিয়ার তৈরির সময় অনেক সুপরামর্শ পেয়েছি। হিসাব দেখাশোনার কাজ করতে গিয়েই উপলব্ধি করেছি যে, কাকিমা খুবই বাস্তববাদী মানুষ। বিষয়আশয় কী করে রক্ষা করা যায়, কী ভাবে পয়সাকড়ি অপব্যয় না করে তার সদ্ব্যবহার করতে হয়, সেটা নিয়ে ওঁর ধ্যানধারণা ছিল খুব পরিষ্কার। খুব অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছিল। স্কুল-কলেজের তথাকথিত শিক্ষা পাওয়ার অবকাশ উনি পাননি। কিন্তু মনেপ্রাণে কী অসম্ভব শিক্ষিত ছিলেন!
নায়িকাদের মধ্যে একমাত্র কানন দেবীই কিছু সম্পত্তি রক্ষা করতে পেরেছিলেন। কিছু বিনিয়োগ করেছিলেন। জীবনটা নিশ্চয়তার মধ্যে কেটেছিল। বাকিদের কারও নাম বলব না, সকলেই কমবেশি অর্থাভাব দেখেছেন। যেটা কাকিমাকে দেখতে হয়নি। কাজ করার পাশাপাশি সঞ্চয়ী ছিলেন যে! সেই কারণেই ১৯৫৫ সালে বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে অমন একখানা প্রাসাদোপম বাড়ি করতে পেরেছিলেন। কী সুন্দর করে সাজিয়ে রাখতেন সেই বাড়ি! এখনও চোখে লেগে আছে। শেষমেশ ওই বাড়ি যে রিয়েল এস্টেটের হাতে তুলে দেওয়া হল, সেটাও আমার ধারণা, ওঁর হিসেবি মনেরই পরিচয়।
অনেকেরই ধারণা উনি উন্নাসিক, অহংকারী। ওঁর সেই ডায়লগটার মতোই বোধহয়, ‘আমাকে টাচ করবে না’। এটা কিন্তু ভুল ধারণা। শ্যুটিংয়ে যখন আসতেন, টেকনিশিয়ানদের সঙ্গে কী যে আন্তরিক ব্যবহার করতেন! নিজের ভারিক্কি ব্যক্তিত্ব ধরে রেখেই করতেন। ইউনিটে কে কখন খেল না খেল, কার শরীর খারাপ, কার ছেলেমেয়ের কেমন পড়াশোনা চলছে সব খবরই থাকত নখদর্পণে। সঞ্চয় যেমন করেছিলেন, তেমন প্রয়োজনে খরচ করতেও কার্পণ্য করতেন না। কার মেয়ের বিয়েতে টাকা লাগবে, কার বাবা-মা অসুস্থ, কে অভাবে পড়ে সংসার চালাতে পারছে না সকলকে আর্থিক সাহায্য করার চেষ্টা করতেন। তখনকার দিনে তো আয়ের এত রাস্তা ছিল না। এখন যেমন টিভি শো, অজস্র বিজ্ঞাপনী এন্ডর্সমেন্ট, মন্দির কি শোরুমের উদ্বোধন, সবেতেই টাকা। তখন নায়িকারা তেমন পেতেন না। কাকিমা বছরে দু’টো ছবি করতেন। ছবি প্রতি পারিশ্রমিক ছিল বড়জোর ষাট-সত্তর হাজার টাকা। যদিও সেই আমলে এই অঙ্কটাও ছিল অনেক। কিন্তু সেটাকে ঠিক ভাবে রাখতে তো হবে! কাকিমা রেখেছিলেন।
এরই মধ্যে মাঝে মাঝে দুর্বিপাকেও পড়েছেন। যেমন বেশ কিছু প্রযোজক তাঁকে দিয়ে কাজ করিয়ে পারিশ্রমিকের টাকা জোগাড় করতে পারেননি। কেঁদেকেটে এসে পড়েছেন কাকিমার কাছে। কাকিমাও মাফ করে দিয়েছেন। এই ধরনের লোকসান বেশ কয়েক বার হয়েছে তাঁর জীবনে। দু’টো ছবির কথা আমার এখনই মনে পড়ছে, যার জন্য উনি পুরো পারিশ্রমিক পাননি। ‘দত্তা’ আর ‘প্রণয়পাশা’। কিন্তু এ সব নিয়ে যে খুব খেদ প্রকাশ করতেন, তা-ও নয়। সব কিছু ছাপিয়ে কোথাও একটা ভক্তিমতী মন ছিল।
প্রৌঢ়ত্ব আসার অনেক আগেই ঠাকুরঘর, পুজোআচ্চা এ সব নিয়ে আধ্যাত্মিক সাধনায় ঢুকে গিয়েছিলেন। আমাকেও রামকৃষ্ণ মিশনে দীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। সত্যি বলছি, ওঁকে আমি মহানায়িকা বলে দূরে রাখতে চাই না। আমার জীবনে মায়ের মতো জড়িয়েছিলেন যে। বিয়ের সময় নিজে এসে আমাদের স্বামী-স্ত্রীকে আশীর্বাদ করে গিয়েছিলেন।
আর খাওয়াদাওয়া? বাড়িতে গেলে নিজে হাতে রান্না করে পাত পেড়ে খাওয়াতেন। পাঁঠার মাংস, মুরগির মাংসের নানা রকম পদ রাঁধতে জানতেন। আর ভেটকি মাছটা রাঁধতেন অপূর্ব। বলা যায়, উনি হলেন ভেটকি মাছ স্পেশালিস্ট। ওঁর খুব প্রিয় মিষ্টি ছিল, পান্তুয়া। তবে নানা রকম রাঁধতে জানলেও নিজের খাওয়া ছিল অল্প। সবই খেতেন। কিন্তু খুব অল্প পরিমাণে। সেটাই ছিল ওঁর ডায়েট। এখনকার দিনের নায়িকাদের মতো ডায়েট চার্ট অনুসরণ করতে ওঁকে দেখিনি।
এক দিকে বড় জাতের শিল্পী, অন্য দিকে নিপুণ ঘরণী। এই দুইয়ের এমন চমৎকার মিশেল ইন্ডাস্ট্রিতে সচরাচর চোখে পড়ে না। মনে হয় ঈশ্বরের অপার আশীর্বাদ ওঁর উপর ছিল। এক কথায় বলতে গেলে উনি তো ‘সিঙ্গল মাদার’। সিনেমায় সময় দিয়ে, ঘর-সংসার করে মুনমুনকেও চমৎকার তৈরি করেছিলেন। এত আধুনিক মন কী ভাবে যে উনি পেয়েছিলেন, সেটাই হল সব চেয়ে বড় রহস্য।
তবে হাসি-মস্করা খুব একটা করতেন না। সে সব যতটুকু, ওই উত্তমকুমারের সঙ্গেই। উত্তম-সুচিত্রার ছবিতে আমার মনে হয়, দর্শক বেশি করে উত্তমকেই দেখতে যেতেন। সুচিত্রা সেনের জনপ্রিয়তা ছিল উত্তমের পরে। এটা নিয়ে ওঁর মধ্যে কোনও হীনমন্যতা আমার চোখে পড়েনি। ওঁকে আমি কাছ থেকে দেখেছি ওঁর কেরিয়ারের শেষ পর্বে। ‘প্রণয়পাশা’র পর আর ছবি করবেন না, সেটা আমায় বলেওছিলেন অনেক আগে। ঠিক সেটাই হল। জনপ্রিয়তার শিখর থেকে বিদায় নিয়েও তিনি শেষ পর্যন্ত সমান ভাবে জনপ্রিয় রয়ে গেলেন। আশ্চর্য তো সেটাই!
লেখক ছায়াবাণী প্রাইভেট লিমিটেডের কর্ণধার, মহানায়িকার ইনকাম ট্যাক্স ল’ইয়ারও।

অনুলিখন: সংযুক্তা বসু।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.