|
|
|
|
|
|
 |
পুস্তক পরিচয় ২... |
|
ঘরগেরস্থিতে রাজনীতি-অর্থনীতি ওতপ্রোত |
রুশতী সেন |
ঘরগেরস্থির রাজনীতি, সেলিনা হোসেন। কারিগর, ৩০০.০০ |
আটটি প্রবন্ধের এই সংকলন তার নামের সুবাদেই বাড়তি আগ্রহ তৈরি করে পাঠকের মনে। নামপ্রবন্ধটির বিন্যাসে দেখি ধরনটি অভিধানের, তবে চলনটি যেন বার্তাবহ প্রবন্ধের। বাংলা ভাষায় যত নারীকেন্দ্রিক বিশেষ্য-বিশেষণ আছে, তার ব্যাপারে পাঠককে ওয়াকিবহাল করেছেন সেলিনা হোসেন। ‘সতী’ শব্দের পুংলিঙ্গ যে পুরুষের জন্য সতীর অনুরূপ কোনও অর্থের ভার তৈরি করে না (২৫-২৬), নারীকে গণিমতের মাল বলা যে কতখানি অসম্মানজনক (৪৪), মৌসুমি বিয়ের মতো একটি স্নিগ্ধ উচ্চারণের আড়ালে নিহিত আছে নারীর কতখানি বঞ্চনাযন্ত্রণার কাহিনি (৭০), এমন সব কম চেনা, বেশি চেনা ধারণাগুলিকে পরিচিত করতে করতে এগোন লেখক। যেন বাকি বইটির জন্য প্রস্তুত করেন পাঠকের মনকে। ‘প্রান্তিক নারী ও নিরাপত্তা’, ‘নারীপ্রগতির ভিন্ন দিক’, ‘নারী জীবন ও নারী অধ্যয়ন’, ‘দুর্নীতি ও নারী’, ‘সংস্কৃতি ও নারী’, ‘নারীর প্রজ্ঞা’ এবং ‘ঘরগেরস্থিতে নোনাজল’ নামের প্রবন্ধগুলি পড়তে পড়তে লেখকের সঙ্গে পাঠকের সহমত-অসহমতের প্রশ্নটা বড় হয়ে ওঠে না। যিনি লিখছেন, তাঁর মনের অবস্থান এতটাই ন্যায্য যে তাঁর সঙ্গে ছোটবড় যুক্তি তর্ক গল্পের সূত্রে পাঠকের প্রাপ্তি বাড়তে পারে। প্রথম প্রবন্ধ ‘ঘরগেরস্থির রাজনীতি’ যেন সমে ফেরে বইয়ের শেষ প্রবন্ধ ‘ঘরগেরস্থিতে নোনাজল’-এ এসে। আবার ‘...প্রজ্ঞা’ আর ‘...নোনাজল’-এর পাশাপাশি অবস্থান যেন বাড়তি মাত্রা যোগ করে বইটিতে। মুক্তিযুদ্ধের সমকালীন এবং তার আগে-পরের নারী নির্যাতন যখন মূর্ত হয় সেলিনার বিন্যাসে, পাঠকের মনে পড়ে শাহীন আখতারের তালাশ নামের আশ্চর্য উপন্যাসটির কথা।
লেখক তাঁর যুক্তিগ্রাহ্য বিন্যাস-বিশ্লেষণকে কোনও সমগ্রের সান্ত্বনায় যুক্ত করেননি। বরং মান্যতা দিয়েছেন অনুপুঙ্খের গুরুত্বকে। ‘সংস্কৃতি ও নারী’র মতো প্রবন্ধে নাম-না-জানা খড়কুটো মানুষদের মুখের কথায়, তাদের দিনযাপনের বর্ণনায় পাঠকের জন্য সৃজন করেছেন বাড়তি প্রেরণা। কথকতার এমন ধরতাই যখন লেখকের অবলম্বন, তখন দু-একটি ব্যাপারে বিশেষ সতর্কতা জরুরি। যে সব প্রশ্ন উঠে এল অনুপুঙ্খ বিন্যাসের সুবাদে, তার সব ক’টির উত্তর তো নাই মিলতে পারে আলোচ্য বইটির দুই মলাটের পরিসরে। এমন অমিল বইটির তাত্পর্য কমায় না, বরং খুলে দেয় আরও বাদ-প্রতিবাদ, যুক্তি-তর্কের পরিসর। নিজের বক্তব্যে সেলিনা হোসেন একান্ত আত্মবিশ্বাসী। সাহিত্য সৃজনের দীর্ঘ পরিক্রমা, সংস্কৃতির সঙ্গে তাঁর গভীর সম্পৃক্তি ওই আত্মবিশ্বাসকে ন্যায্যতা দেয়। কিন্তু চর্চার বিষয়টি তো তাঁর খুবই গুরুত্বপূর্ণ! তাই জীবনে পুরোপুরি প্রমাণ হয়নি যে বার্তা, তা যদি দুই মলাটের মাঝমধ্যিখানে নিশ্চিত প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়, তবে সে বার্তার প্রামাণ্যতা নিয়ে সংশয় জাগে।
‘নারীর প্রজ্ঞা’ শীর্ষক প্রবন্ধে সেলিনা লিখেছেন, ‘দেখা গেছে কখনো কোনো নারী রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার পুরুষতন্ত্রের কাছে বন্দি হন। তার প্রমাণ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। তাঁরই সময়ে ১৯৭৪ সালে ভারত পরমাণু শক্তির বিকাশ ঘটায়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে পরমাণু শক্তি হিসেবে প্রথম আত্মপ্রকাশ করে ভারত।’ (১৭৫)। এ কথা অবশ্যস্বীকার্য যে নারীর মানসিক গঠনের এবং ঘরে-বাইরে নারীর ক্ষমতায়নের প্রেক্ষিতে ইন্দিরা গাঁধীর সমগ্র জীবন একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার বিষয়। কিন্তু পূর্বোক্ত রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের নিরিখে তিনি যে সিদ্ধান্তের স্বাধীন গ্রাহক নন, পুরুষতন্ত্রের ঘেরাটোপে বন্দিমাত্র, সে প্রমাণ কোন সুবাদে মিলল? তিনি নারী বলে? তবে তো যা প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে এত লেখালেখি, তাকে ধরে নিয়েই বিশ্লেষণের সূচনা! বিন্যাসের এমন বিচ্যুতি কি পুরুষতন্ত্রের ভিত শক্ত করে না? ব্যাপ্ত করে না সে তন্ত্রের বিদ্রূপ কিংবা চোরা হাসি?
একই প্রবন্ধে ‘নারীর বিবেচনায় ধর্ম ও ধর্মান্ধতা’ শিরোনামে নিজের মায়ের কাছে শোনা একটি জবরদস্ত গল্প পাঠককে শুনিয়েছেন সেলিনা। তার পরেই লিখেছেন, ‘ধর্ম নারীর কাছে পবিত্র বিশ্বাস। ধর্মান্ধতা দিয়ে এই বিশ্বাসকে কলুষিত করে পুরুষ।’ (পৃ ১৮০)। যে গল্পটি সদ্য শুনে পাঠক মুগ্ধ হয়েছেন, সেখানে নিশ্চয় কৃষকের তুলনায় কৃষকপত্নীর দৃষ্টি স্বচ্ছতর। কিন্তু শুধুমাত্র বাংলা সাহিত্যের সঞ্চয় থেকেই তো সেলিনার মন্তব্যের বিপরীতে অজস্র দৃষ্টান্ত আছে বিভূতিভূষণের দৃষ্টিপ্রদীপ-এ জিতুর জ্যাঠাইমা থেকে বুদ্ধদেব বসুর কালো হাওয়া-য় হৈমন্তী পর্যন্ত! তাঁরা সবাই কি বানানো?
তবে কথা একটা থেকেই যায়। যে চৌহদ্দির ভিতরে-বাইরে নারীর আজন্ম বেড়ে ওঠা আর জীবনচর্যা, সেখানে মানসিক ব্যাপ্তির সুযোগে পুরুষের সঙ্গে তার ফারাক আজও অস্বীকার করা যায় না। অন্দরের ভিতরকার ক্ষমতায়নে নারী যে পরবর্তিনীর প্রতি বিরূপ অথবা নির্দয় হয়, সেই মনোভাবে কি মিশে থাকে না তার আবাল্য বঞ্চনার এমনকী নিগ্রহের স্মৃতি? সংসারের ঘেরে সে নিগ্রহকে নিগ্রহ বলে শনাক্ত করাই নারীর পক্ষে সময়ে সময়ে দুরূহ হয়ে পড়ে। এ সংকট আর পাঁচ জনের চেয়ে বেশি বই কম জানেন না সেলিনা হোসেন। সেই জানার সূত্রেই গড়ে উঠেছে আলোচ্য বইটির অনেক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। আবার সেই জ্ঞানের অসহায়তাই হয়ত কোথাও টেনে দিয়েছে বিশ্লেষণের সীমা।
নামপ্রবন্ধে ‘জাতের মেয়ে কালোও ভালো’র ব্যাখ্যা লক্ষ করবার মতো (৪৯-৫০)। গাত্রবর্ণে সাদা-কালোর বিভাজনে যে নারীর দুর্ভোগ পুরুষের চেয়ে বেশি, তার প্রমাণস্বরূপ মসীময় কৃষ্ণ আর অনিন্দ্যসুন্দরী রাধার রূপকল্পে ব্যাখ্যা শেষ। দ্রৌপদীর জীবনভর দুর্ভোগ কোনও ভাবে তাঁর কৃষ্ণা নামটির সঙ্গে যুক্ত কি না, সে প্রশ্ন ওঠেনি। ওঠেনি আজ থেকে এক শতকেরও কম আগে মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে কালো ছেলে নিয়ে বর্ষীয়সীদের আহ্লাদের প্রসঙ্গ সোনার আংটি আবার বাঁকা আর সোজা! মেয়ে হলে তবে তুলনীয় আংটিটা তামার কিংবা টিনের কিংবা নিকেলের, তখন উঠতে পারে বাঁকা-সোজার অর্থাত্ কালো-ফর্সার প্রসঙ্গ! বাংলার ঘরে ঘরে জ্ঞান হওয়ার আগে থেকেই শিশুকন্যা তার শ্রুতিতে যে সব ছড়া বহন করে, তার অন্যতম হল ‘শাশুড়ি ননদ বলবে দেখে বউ হয়েছে কালো
শ্বশুর ভাসুর বলবে দেখে ঘর করেছে আলো!’ নারীর ক্ষমতায়নের অপব্যাখ্যা শিখতে শিখতে, নারীদের একতার সম্ভাবনা যে প্রায় অসম্ভবের নামান্তর, এমন ধারণা অস্থিমজ্জায়, শ্রবণে, কথনে নীরবতায় বহন করতে করতে শিশুকন্যা বাল্যকৈশোর পেরিয়ে নারী হয়ে ওঠে। ওই স্নিগ্ধ শ্বশুর ভাসুর আর রুক্ষ শাশুড়ি ননদের রূপকল্প যে নির্বিকল্প ধ্রুবসত্য নয়, এমন চৈতন্য বাদ দিয়ে ঘরে-বাইরে নারীর ক্ষমতায়ন সার্থক হতে পারে না। কথাটা নতুন নয়। সেলিনা হোসেনের অজানাও নয়। হয়ত খুব বেশি জানা বলেই এ বইতে কথাটাকে তিনি খুব বিস্তৃত পরিসর দেননি। কিন্তু ঘরগেরস্থিতে সব চেয়ে জোরদার কূটনীতি বোধহয় পুরুষের (যিনি আজও বেশিরভাগ সংসারের মূল উপার্জনকারী) কাল্পনিক উদারতায় আর নারীর (যিনি আজ অনেক ক্ষেত্রে উপার্জনক্ষম হলেও, একুশ শতকের এই দ্বিতীয় দশকেও সাধারণত সংসারের মূল উপার্জনকারী নন, খুব বেশি হলে উপার্জনে সহায়ক) বানিয়ে তোলা সংকীর্ণতায় নিহিত আছে। বলা বাহুল্য, ঘরগেরস্থির অর্থনীতির বেশ বড়সড় ভূমিকা এখানে। কী ঘরে কী বাইরে, অর্থনীতিকে বাদ দিয়ে এক পা এগনোরও পথ নেই রাজনীতির! |
|
|
 |
|
|